অবৈধ আয়ে স্ত্রীর নামে জমি কেনেন ডিবি পরিদর্শক

মো. মাসুম বিল্লাহ প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২৯, ২০২৪, ০১:০০ এএম
অবৈধ আয়ে স্ত্রীর নামে জমি কেনেন ডিবি পরিদর্শক
  • সপরিবারে বাস করছেন যুক্তরাষ্ট্রে
  • পুলিশ দম্পতির বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
  • দেখানো ব্যবসায় পাওয়া যায়নি নথি
  • রাজধানীতে একাধিক প্লট ও বাড়ি

অবৈধ অর্থ উপার্জনকারীদের মানুষ ঘৃণা করে। এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষের আরও কঠোর হওয়া জরুরি
—ড. তৌহিদুল হক
অপরাধ বিশেষজ্ঞ, ঢাবি

সাবেক কুমিল্লা গোয়েন্দা পুলিশের অফিসার ইনচার্জ (ওসি) এ কে এম মনজুর আলম ও তার স্ত্রী মিসেস নার্গিস আক্তারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রাথমিক তদন্তে অবৈধ সম্পদ অর্জনের প্রমাণ পাওয়ায় মামলা দায়ের করেছে। দেশে অঢেল সম্পদ থাকলেও বর্তমানে সন্তানদের নিয়ে তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন। স্বামীর অবৈধ অর্থে রাজধানী ঢাকা এবং মানিকগঞ্জে একাধিক প্লট ও মিরপুরে নিজস্ব জমিতে বাড়ি তৈরি করছেন সাবেক এই গোয়েন্দা কর্মকর্তার স্ত্রী।

প্রাথমিক তদন্তে ডিবি কর্মকর্তা ও তার স্ত্রীর অবৈধ সম্পদ অর্জনের প্রমাণ পায় দুদক। এরপর মামলার অনুমোদন চেয়ে আবেদন করা হয়। চলতি মাসের ১৩ তারিখে দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে মামলার অনুমোদন দেয়া হয়। গতকাল বুধবার দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয় কুমিল্লার সহকারী পরিচালক পাপন কুমার সাহা বাদী হয়ে মামলাটি করেন। মামলায় আসামি করা হয় মিসেস নার্গিস আক্তার ও তার স্বামী সাবেক কুমিল্লা গোয়েন্দা পুলিশের ওসি এ কে এম মনজুর আলমকে। 

মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, আসামিরা যোগসাজশে অসৎ উদ্দেশ্যে ২৫ লাখ ১৩ হাজার ৯১৬ টাকা জ্ঞাত বহির্ভূত সম্পদ অর্জনপূর্বক ভোগদখলে রেখেছেন। যা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আইন ২০০৪ এর ২৭(১) ও দণ্ডবিধির ১০৯ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। দুদক সূত্রে জানা যায়, আসামি দম্পতি বর্তমানে স্বামী-সন্তানসহ আমেরিকায় বসবাস করছেন। স্ত্রী নার্গিস আক্তার একজন পৃথক আয়করদাতা। তিনি মৎস্য এবং হস্ত ও কুটির শিল্পের ব্যবসা করেন। অনুসন্ধানকালে দুদক নার্গিস আক্তারের নামে ৭৩ লাখ ৫৯ হাজার টাকার স্থাবর এবং ১৪ লাখ ছয় হাজার ৯১৬ টাকার অস্থাবরসহ মোট  ৮৭ লাখ ৬৫ হাজার ৯১৬ টাকায় সম্পদের তথ্য পায়। এ সম্পদ অর্জনে তার ব্যবসা থেকে আয়, কৃষি আয়, জমি বিক্রির আয়, গৃহ সম্পত্তির আয়, নিরাপত্তা জামানতের সুদ বাবদ আয়, মৎস্য আয় ও ব্যাংক ঋণ বাবদ মোট ৯১ লাখ ৪৮ হাজার ৮০০ টাকা আয়ের তথ্য পাওয়া যায়। তার আয়কর নথি পর্যালোচনায় সম্পদ অর্জনকালীন তার পারিবারিক ও অন্যান্য ব্যয় বাবদ ১৯ লাখ ৪৬ হাজার ৫০০ টাকা ব্যয়ের তথ্য পাওয়া যায়। 

এ ছাড়া মৎস্য খামার ভাড়া বাবদ তিনি ২০১৫ সালে ৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা পরিশোধ করেছেন। ফলে তার মোট ব্যয় দাঁড়ায় ২৮ লাখ ৯৬ হাজার ৫০০ টাকা। আয় থেকে ব্যয় বাদ দিলে নার্গিস আক্তারের মোট সম্পত্তি থাকার কথা ৬২ লাখ ৫২ হাজার ৩০০ টাকার। কিন্তু অনুসন্ধানে তার মোট ৮৭ লাখ ৬৫ হাজার ৯১৬ টাকার সম্পদ পায় দুদক। ফলে নার্গিস আক্তার ২৫ লাখ ১৩ হাজার ৬১৬ টাকার আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনপূর্বক তা ভোগদখলে রেখেছেন। 

দুদক সূত্রে আরও জানা যায়, নার্গিস আক্তারের সম্পত্তির মধ্যে রয়েছে, ঢাকা জেলার সাভার থানার গেন্ডা এলাকায় ১৩ দশমিক ৫০ শতাংশ কৃষি নাল জমি, মানিকগঞ্জ জেলার সাটুরিয়া খানার আয়নাপুর ৫ দশমিক ৫০ শতাংশ নাল জমি, ঢাকা মহানগরীর মিরপুর থানার পাইকপাড়া এলাকায় চার কাঠা নাল জমি, ঢাকা মহানগরীর মিরপুর থানার পাইকপাড়া এলাকায় জমিতে নির্মাণাধীন দালান এবং ডাজ বাংলা ব্যাংক ও এবি ব্যাংকের বিভিন্ন শাখায় তার ১২ লক্ষাধিক টাকা রয়েছে। মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, ওই সম্পদসমূহ নার্গিস আক্তার তার নিজের নামে অর্জিত দেখালেও মূলত সম্পদগুলো তার স্বামীর অর্থে ক্রয় করা। নার্গিস আক্তার নথিতে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের ব্যবসা দেখালেও বাস্তবে তার ব্যবসার আয়ের কোনো রেকর্ডপত্র, ভাউচার, হিসাবপত্র পাওয়া যায়নি। ফলে নার্গিস আক্তার ও তার স্বামী অসৎ উদ্দেশ্যে পরস্পর যোগসাজশে ২৫ লাখ ১৩ হাজার ৬১৬ টাকার জ্ঞাত-আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করে তা ভোগদখলে রেখেছেন বলে প্রমাণ পায় দুদক। তদন্তকালে জ্ঞাত-আয় বহির্ভূত আরও সম্পদ পাওয়া গেলে তা মামলায় অর্থভুক্ত করা হবে বলেও এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক আমার সংবাদের এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জনের মতো প্রতিনিয়ত সামাজিক কলঙ্কের অভিযোগ আমরা শুনে থাকি। স্ত্রীর নামে সম্পদ ক্রয় করে তার উৎসের বিবরণ দিতে পারে না। তখন সেই সম্পদ নিয়ে নানা ধরনের প্রশ্ন তৈরি হয়। বিভিন্ন সময়ে দেখা যায়, দুদকের মামলা হলে তারা সপরিবারে বিদেশে অবস্থান করে। আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটে অবৈধভাবে যারা অর্থ উপার্জন করে তাদের হয়ত সময়ের প্রেক্ষাপটে সামাজিকভাবে ক্ষমতার ভয়ে কিছু বলে না। কিন্তু মানুষ মনে মনে ঘৃণা করে, একপর্যায়ে এ ধরনের মানুষের জন্য অন্য যারা সমমানের কর্মকর্তা তাদের সম্মান নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। অন্যদিকে সমমানের কর্মকর্তারা অবৈধ আয় করার জন্য উৎসাহ পায়।’