দেশ স্বাধীনের পর ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই প্রথম বাংলাদেশকে ‘সোনার বাংলা’ গড়ার প্রত্যয় ঘোষণা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন ‘দেশের সাধারণ মানুষের সন্তানদের শিক্ষিত করতে না পারলে দেশকে সোনার বাংলায় রূপান্তর করা সম্ভব নয়।’ সেই প্রত্যয়েই পাকহানাদার বাহিনীর আগুনে পোড়া ১৮ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুনঃনির্মাণ, ৭১-এর মার্চ-ডিসেম্বরকালীন ছাত্রবেতন মওকুফ, ৩৬ হাজার ১৬৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ, এক লাখ ৫৭ হাজার ৭৪২ শিক্ষকের চাকরি সরকারিকরণ, ড. কুদরত-ই-খুদা কমিশন গঠন, পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ, শিক্ষকদের ৯ মাসের বন্ধ বেতন প্রদান এবং বাজেটেও শিক্ষা খাতের সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেন তিনি। যা ছিল প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে যুগান্তকারী এক অধ্যায় ও সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ের প্রাথমিক সোপান।
বঙ্গবন্ধুর সেসব সিদ্ধান্তই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের এক শৃঙ্খলিত পদক্ষেপ। এরপর ৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে একটি নির্দিষ্ট সময়কালব্যাপী প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে ঘটেনি কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। পরবর্তীতে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের দায়িত্বে আসার পর থেকেই রাষ্ট্রীয় সব সেক্টরের উন্নয়নের পাশাপাশি অধিক গুরুত্বের সঙ্গে সব শিক্ষার মূল ভিত্তি— প্রাথমিক শিক্ষায় ঘটেছে অভাবনীয় পরিবর্তন। এই পরিবর্তনের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ও এর অধীন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর-ডিপিই। উল্লেখ্য, বর্তমান সরকারের নির্বাচনি ইশতেহারেও জাতির সঙ্গে অঙ্গীকারবদ্ধ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার। সেই অঙ্গীকার বাস্তবায়নের পথও মসৃণ নয়, বন্ধুর। এরই মধ্যে জাতিগতভাবে সামনে রয়েছে একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার পরীক্ষাও। সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণের চ্যালেঞ্জেও ইতোমধ্যেই মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষায় সূচকভিত্তিক সাফল্যের সাক্ষাত লাভ করেছে খাতটি। এ সাফল্য বর্তমান সরকার, সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ও এর অধীন প্রাথমিক শিক্ষা অধিপ্তরের।
ডিপিই সংশ্লিষ্টরা জানান, ক্ষমতায় আসার পর থেকেই প্রাথমিক শিক্ষাকে অগ্রাধিকার ও এ খাতের ধারাবাহিক অগ্রগতির লক্ষ্যে বাস্তবভিত্তিক বহুমুখী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে বর্তমান সরকার। বাড়ানো হয়েছে শিক্ষকদের পদমর্যাদা ও জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য। মিড ডে মিল ও উপবৃত্তির মাধ্যমে কমানো হয়েছে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর হার। বিশেষভাবে সক্ষম শিক্ষার্থীদেরও প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতে কাজ করছে সরকার। ফলে ৩৬ শতাংশ বেড়েছে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনের হার। প্রাথমিক শিক্ষার অগ্রগতির কথা জানিয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, আগামীতে আমাদের সন্তানরা পৃথিবীর যে কোনো দেশকে চ্যালেঞ্জ করতে পারবে। বিগত দিনে শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে আগ্রহী করার জন্য ছিল না বৃহৎ কর্মপরিকল্পনা। স্বাধীনতার পর বিনামূল্যে পাঠদান ও বই বিতরণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও শিক্ষকদের সচ্ছলতার বিষয়টিও দেখা হয়নি। কিন্তু বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই একের পর এক প্রাথমিক শিক্ষায় বাস্তবমুখী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। যার সুফল ইতোমধ্যেই পাওয়া যাচ্ছে।
ডিপিই সূত্র বলছে, শিক্ষার উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন শিক্ষকের পদমর্যাদা বৃদ্ধি করা। পদমর্যাদা বৃদ্ধি পেলে যোগ্য ও দক্ষ শিক্ষক পাওয়া যাবে। এ লক্ষ্য প্রাথমিকে তৃতীয় শ্রেণির পরিবর্তে দ্বিতীয় শ্রেণিতে উন্নীত করা হয়েছে শিক্ষকদের মর্যাদা। সহকারী শিক্ষকদেরও বেতনের গ্রেড উন্নীত করা হয়েছে। ১৬তম গ্রেডের পরিবর্তে ১৩তম গ্রেডের বেতন পান তারা। বর্তমানে প্রাথমিকের শিক্ষকতার প্রতি তরুণদের ধারণা পাল্টে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থীরাও এখন প্রাথমিকের শিক্ষক হচ্ছে।
সার্বিক অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রাথমিকের চাকরিতে স্বাচ্ছন্দ্য এনেছে ডিপিই। শিক্ষকরা যেন নিজ উপজেলায় বদলি হতে পারেন, সেজন্য তৈরি হয়েছে অনলাইন বদলি নীতিমালা। এ পদ্ধতির অধীনে প্রত্যেক শিক্ষক নিজ বাড়ির আশেপাশের বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সুযোগ পাচ্ছেন। প্রাথমিকের শিক্ষার উন্নয়নে বাড়ানো হয়েছে শিক্ষক সংখ্যা। গত একযুগে প্রাথমিকের শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে দুই লাখ ৩৮ হাজার ৫৭৯ জন। এর মধ্যে সহকারী শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে দুই লাখ ৩৩ হাজার ৩৭৪ জন। প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ পেয়েছে পাঁচ হাজার ২০৫ জন।
প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনের হার বেড়েছে ৩৬ শতাংশ : এক সময় প্রাথমিকে শেষ হতো অর্ধেকের মতো শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন। বর্তমানে এ ধারায় পরিবর্তন এসেছে। বিগত একযুগে এ হার কমেছে ৩৬ শতাংশ। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ২০০৯ সালে দেশের প্রাথমিকে শিক্ষার্থী সমাপনের হার ছিল ৪৯ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০২২ সালে এটি বেড়ে হয়েছে ৮৬ দশমিক ০৫ শতাংশ।
মিড ডে মিল ও উপবৃত্তির ব্যবস্থা : সন্তানের বয়স ৭ থেকে ১০ বছর হলেই কৃষি বা অন্য কোনো কাজে নিয়োজিত করার প্রবণতা ছিল গ্রামীণ সমাজে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সরকার দুই বছর মেয়াদি প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা চালু করেছে। শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে ৭৫ শতাংশ উপস্থিতির ওপর ভিত্তি করে উপবৃত্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ টাকা সরাসরি সরকারি কোষাগার থেকে অভিভাবকদের মোবাইলে পৌঁছে যাচ্ছে। বিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীর স্কুলে মিড ডে মিলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর ফলে স্কুলে আকৃষ্ট হচ্ছে শিশুরা।
বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি : একসময় বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের সমাজের বোঝা হিসেবে বিবেচনা করা হতো। সমাজের সেই ধারণাও পাল্টে গেছে। বর্তমানে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য নানা ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সরকার। তাদের বিশেষভাবে সক্ষম মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাদের প্রয়োজনীয় উপকরণ হুইল চেয়ার, ক্র্যাচ, শ্রবণ যন্ত্র, চশমা সরবরাহের জন্য বাজেট বরাদ্দ রাখে ডিপিই।
ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষা প্রদান : ২০১৭ সাল থেকে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো ও সাদরি এই পাঁচ ভাষার শিক্ষার্থীদের হাতে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করা হয়। ২০১৭ সালে প্রায় ৫০ হাজার বই বিতরণ করা হয়। বর্তমানে দুই লাখ ১২ হাজার বই বিনামূল্যে পাচ্ছেন তারা।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুতি : স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ ও চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রণয়ন করা হয়েছে নতুন শিক্ষাক্রম। প্রাথমিক শিক্ষার শিখন শেখানো কার্যক্রম ও মূল্যায়নকে আধুনিক, প্রযুক্তিনির্ভর ও প্রকল্পভিত্তিক করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে প্রোগ্রামিং সম্পর্কে ধারণা দেয়ার জন্য তৃতীয় শ্রেণি থেকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি ও কোডিং পদ্ধতি। প্রতিটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে একটি করে সারা দেশে এক লক্ষাধিক ল্যাপটপ দেয়া হয়েছে। ৭০ হাজার বিদ্যালয়ে মাল্টিমিডিয়াসহ ইন্টারনেট সুবিধা ও সাউন্ডসিস্টেম সরবরাহ করা হয়েছে। ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরি ও ব্যবহারের ওপর এক লাখ ২৫ হাজারের বেশি শিক্ষার্থীকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। দেশের সুবিধাবঞ্চিত অঞ্চলের ৬৫০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ডিজিটাল ক্লাসরুম স্থাপন করা হয়েছে। ৫০৯টি উপজেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কম্পিউটার ও ল্যাংগুয়েজ ল্যাব স্থাপনের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় প্রতিটি বিদ্যালয়ে পাঁচটি করে কম্পিউটার দেয়া হবে। প্রাথমিক শিক্ষা সম্পর্কিত বিশাল তথ্য ভাণ্ডারকে নির্দিষ্ট প্লাটফর্মে আনার জন্য একটি সার্ভার স্টেশন ও ডিজাস্টার রিকভারি সেন্টার স্থাপনের পরিকল্পনাও নেয়া হয়েছে। এখানে সব তথ্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
জানতে চাইলে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রাথমিক শিক্ষার পরিকল্পনার কথা জানিয়ে ডিপিইর মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত আমার সংবাদকে বলেন, প্রতিটি শিশুই সম্ভাবনাময়ী। শিশুকে দক্ষ ও যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে পারলেই আগামীর বাংলাদেশ স্মার্ট হবে। এই শিশুরাই আগামীর চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করবে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ডিপিই প্রস্তুত রয়েছে। যদিও আমাদের কিছু সংকট রয়েছে। সেই সংকট উত্তরণের জন্যও আমরা কাজ করছি।