ফুটপাত ও সড়কে হকার উচ্ছেদ

কঠোর হচ্ছে ট্রাফিক পুলিশ

মো. মাসুম বিল্লাহ প্রকাশিত: মার্চ ২১, ২০২৪, ১১:২৯ পিএম
কঠোর হচ্ছে ট্রাফিক পুলিশ
  • যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা মতিঝিল, গুলিস্তান ফার্মগেট ও মিরপুরের অর্ধেক সড়ক হকারের দখলে
  • হাঁটার জন্য দুই হাজার ৬০০ কিলোমিটার ফুটপাতের প্রয়োজনীয়তার বিপরীতে রয়েছে মাত্র ৫১৫ কিলোমিটার

ফুটপাত দখলমুক্ত করতে পারলে সরকারের ২২ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হবে
—সাইদুর রহমান
নির্বাহী পরিচালক, রোড সেফটি ফাউন্ডেশন

রমজানে ঢাকার সড়কে ব্যবসায়ীদের বসতে দেয়া হবে না
—মো. মুনিবুর রহমান অতিরিক্ত কমিশনার ট্রাফিক বিভাগ, ডিএমপি

ঢাকা শহরের ফুটপাতগুলোয় যেন পা ফেলার জায়গা নেই। নানাভাবে এগুলো দখল করা হয়ে আছে। শহরের সব ফুটপাত ও সড়ক দখল করে রেখেছে ব্যবসায়ীরা। এ কারণে ফুটপাত দিয়ে চলাচল করা দুরূহ হয়ে পড়েছে। হকারদের কারণে ফুটপাত দখল হয়ে যাওয়ায় সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন কর্মব্যস্ত মানুষ, শিক্ষার্থী, নারী ও শিশুরা। কোনোক্রমে পথচারীদের তা ব্যবহার করার সুযোগ ও উপায় নেই। চলতে গেলেই সব সময় বিপাকে পড়তে হয় তাদের। 

ফুটপাত আর রাস্তার একাংশ দখল করে, অর্থাৎ হাঁটার অধিকারকে তোয়াক্কা না করে হকারদের ব্যবসা করাটা সবার যেন গা-সওয়া হয়ে গেছে। নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের চলাচল রাজধানীর অন্যতম ব্যস্ততম এলাকা মতিঝিল, গুলিস্তান, যাত্রাবাড়ী, মিরপুর ও ফার্মগেটে দিন-রাতের সব সময়ই গিজগিজ করে মানুষ। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার নিয়মিত চিত্র এটি। মাঝেমধ্যে ফুটপাত ও সড়ক দখলমুক্ত করতে চালানো হয় অভিযান। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। দিন শেষে আবার দখল হয়ে যায়। এত পথচারী চলাচল করে অথচ সেসব ফুটপাত ধরে হেঁটে চলাচল করার কোনো সুব্যবস্থা নেই। দখলদারিত্ব থেকে মুক্তি পাচ্ছে না ফুটপাতগুলো। পুরো ফুটপাতজুড়েই গিজগিজ করছে দোকান। ফুটপাত দিয়ে হাঁটার মতো পরিস্থিতি নেই কোনোভাবেই। তাই বাধ্য হয়ে পথচারীরা নেমে এসেছেন মূল সড়কে। যে কারণে যান চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে, সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। সে  সঙ্গে থাকছে পথচারীদের দুর্ঘটনার আশঙ্কাও। 

সরেজমিনে দেখা যায়, যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা, মতিঝিল, গুলিস্তান, ফার্মগেট ও মিরপুরের বিভিন্ন এলাকার সড়ক অর্ধেক দখলে রয়েছে হকারদের।

রাজধানীর যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তার মূল সড়ক দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন ইমরান নামের এক পথচারী। পেছনেই সিএনজি অটোচালক হর্ন বাজিয়ে বলছিলেন, ‘একটু সাইড দিয়ে হেঁটে যান’। ইমরান বলছেন, ‘কোথায় যাব! ফুটপাতসহ রাস্তার মধ্যে দোকান, রাস্তায় গাড়ি, বিপাকে আমাদের মতো পথচারী।’ ইমরান বলেন, পুরো যাত্রাবাড়ীর ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাওয়ার কোনো পরিস্থিতি নেই। সবগুলো ফুটপাতে অতিরিক্ত দোকান, তার মধ্যে মানুষের হেঁটে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

এদিকে পবিত্র রমজান মাসে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ে ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার মো. মুনিবুর রহমান বলেন, রমজান মাসে কোনো ব্যবসায়ী সড়কে যাতে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড পরিচালিত করতে না পারেন, সে জন্য তারা কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছেন। রমজানে বেলা সাড়ে ৩টায় অফিস ছুটি হয়। কিন্তু দেখা যায়, ইফতারের আগ পর্যন্ত অধিকাংশ যানবাহন তড়িঘড়ি করে গন্তব্যস্থলে রওনা হয়। এতে শহরের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন ইন্টারসেকশনে অযাচিত যানজট তৈরি হয়।

যানজট এড়াতে তিনি অফিস ছুটির সময়, অর্থাৎ বেলা সাড়ে ৩টা বা এর কাছাকাছি সময় থেকে বাসার উদ্দেশে রওনার জন্য নগরবাসীকে আহ্বান জানান। এ ছাড়াও দেখা যায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রুটের সড়কের পাশে গাড়ি পার্ক করা, যা সড়কের প্রশস্ততা কমিয়ে দেয়; যানবাহন চলাচল বাধাগ্রস্ত করে। রমজানের শুরু থেকে ট্রাফিক বিভাগ পার্কিংয়ের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে বলেও জানান তিনি। নির্ধারিত বাসস্টপেজে না দাঁড়িয়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়কের টার্নিং পয়েন্টে যাত্রীরা দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন। এতে সড়কে যান চলাচল ব্যাহত হয়; যানবাহনের গতি অনেক কমে যায়। যাত্রীদের গণপরিবহনে চলাচলের ক্ষেত্রে নির্ধারিত স্টপেজে গিয়ে অপেক্ষার জন্য অনুরোধও করেছেন ট্রাফিকের এই কর্মকর্তা। অনেক স্টপেজে যাত্রী থাকেন না। কিন্তু গণপরিবহনগুলো দীর্ঘ সময় ধরে স্টপেজে অবস্থান নেয়। এতে যানজট তৈরি হয়।

মুনিবুর রহমান আরও বলেন, পাশের বিভিন্ন ইউনিট থেকে যানবাহন অযাচিতভাবে ডিএমপি এলাকায় প্রবেশ করে যানজট তৈরি করে। ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের সদস্যদের এ বিষয়ে কড়াভাবে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ডিএমপি এলাকায় ভারী যানবাহন প্রবেশের নির্দিষ্ট সময়সীমাও আছে। নির্ধারিত সময়সীমার বিষয়টি সবাইকে  মেনে চলতে হবে। এ ছাড়াও বিভিন্ন সময় ঢাকা শহরের ছোট-বড় সড়কে মেরামতের কাজ চলে। জনসাধারণের দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে রমজান মাসে এসব সড়ক চলাচল উপযোগী করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে।

বেসরকারি এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ঢাকায় মানুষ হাঁটার জন্য দুই হাজার ৬০০ কিলোমিটার ফুটপাতের প্রয়োজনীয়তার বিপরীতে মাত্র ৫১৫ কিলোমিটার ফুটপাত রয়েছে। ৪৪ শতাংশ সড়কেই কোনো ধরনের ফুটপাত নেই। বিদ্যমান ফুটপাতের ৭০ শতাংশই দখল হয়ে আছে হকারদের দ্বারা। এর মধ্যে ২২ শতাংশের অবস্থা অত্যন্ত নিম্নমানের, যা দিয়ে হাঁটা যায় না। আর ব্যবহার উপযোগী আছে মাত্র আট শতাংশ, যা দিয়ে জনবহুল ঢাকায় চলাচল খুবই কষ্টকর।

দুই সিটি কর্পোরেশনের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, রাজধানীতে ১৬৩ কিলোমিটার ফুটপাতের মধ্যে ১০৮.৬০ কিলোমিটারই  প্রভাবশালীদের দখলে। এছাড়া নগরীর দুই হাজার ২৮৯.৬৯ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে ৫৭২.৪২ কিলোমিটারে বসছে পণ্যের পসরা। কোথাও অবৈধ স্থাপনার কারণে, কোথাওবা বিভিন্ন পণ্য রেখে দেয়ায় বিড়ম্বনায় পড়েন পথচারীরা। ফলে  ফুটপাতের পরিবর্তে ঝুঁকি নিয়ে সড়কে হাঁটতে হয় পথচারীদের।

ডিএসসিসি সড়ক ও ফুটপাতের ওপর দোকান এবং হকার উচ্ছেদের মাধ্যমে হাঁটার পথ দখলমুক্ত করার লক্ষ্যে লাল, সবুজ ও হলুদ তিন ভাগে ভাগ করেও হকারমুক্ত করতে পারেনি। অন্যদিকে ফুটপাতে পথচারীদের চলাফেরা নির্বিঘ্ন করতে ও চাঁদাবাজি বন্ধে ডিএনসিসি স্ট্রিট ভেন্ডার ব্যবস্থাপনা পরীক্ষামূলকভাবে চালু করেও কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি।

এ বিষয়ে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান আমার সংবাদকে বলেন, রাজধানীতে যে পরিমাণ সড়ক থাকার দরকার, তা নেই। শহরের তুলনায় আছে মাত্র সাত শতাংশের কম। সব ফুটপাত বেদখল হয়ে আছে। অধিকাংশ জায়গায় ফুটপাত হকারদের দখলে। ৭০ শতাংশের বেশি ফুটপাত হকাররা দখল করে রেখেছে। আমরা যদি ফুটপাত দখলমুক্ত করতে পারি, তাহলে ২২ হাজার কোটি টাকা সরকারের সাশ্রয় হবে। এতে যানজট কমার ক্ষেত্রেও ব্যাপক প্রভাব পড়বে। তাছাড়া রাস্তার প্রায় ৭৫ শতাংশ জায়গা রিকশা ও ব্যক্তিগত গাড়ি দখল করে আছে। গণপরিবহন মাত্র ২৫ শতাংশ জায়গায় চলে। হকারদের কারণে মানুষ রাস্তায় চলে আসে আর এতে যানজটের সৃষ্টি হয়। প্রতিটি গাড়ির জন্য আলাদাভাবে লেন থাকলে তখন এতটা সমস্যা হতো না।