বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান, তৃণমূলের দল পুনর্গঠনের সমন্বয়ক। বারবার আন্দোলনে ব্যর্থতায় তৃণমূলের হতাশা, ঢাকার আন্দোলন নিয়ে প্রশ্ন, নেতৃত্বের দুর্বলতা প্রকাশ এবং আগামীতে সরকারবিরোধী ডান-বাম ইসলামি শক্তির রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে এক ব্যানারে কর্মসূচির ইঙ্গিত এবং গেলো বছরের ২৮ অক্টোবরের আগে-পরে আন্দোলনে কার কী ভূমিকা ছিল, তাদের মূল্যায়ন করা প্রসঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন।
সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন আমার সংবাদের নিজস্ব প্রতিবেদক আবদুর রহিম
আমার সংবাদ : তৃণমূলের সঙ্গে বিএনপির হাইকমান্ডের সম্পর্কের বিষয়ে বলুন...
মো. শাহজাহান : আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান তৃণমূল বিএনপি নিয়ে সচেতন। তৃণমূলের গুরুত্ব তার কাছে অনেক বেশি। বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন জেলায় জেলায় তিনি সম্মেলন করেছিলেন। তৃণমূলের নেতৃত্ব তৈরি করা আমরা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে কাজ করেছি। আগামীতে যে রাষ্ট্র গঠন হবে বা করতে পারলে সেখানে তৃণমূল যেন বেশি অগ্রাধিকার পায়, সেটি মাথায় রেখে সব সময় কাজ করা হয়েছে। তারা যেন রাষ্ট্রীয় যে কোনো কাজ পরিচালনায় সক্ষমতা অর্জন করতে পারেন, সে ব্যাপারে আমরা সজাগ রয়েছি। যতটুকু জানি, আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এখনো তৃণমূলের সব বিষয়ে
পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দৃষ্টি রাখেন; প্রয়োজন হলে কোথাও কোথাও নিজেও কথা বলেন।
আমার সংবাদ : বিএনপি কী তৃণমূলকে সঠিকভাবে মূল্যয়ন করতে পারে?
মো. শাহজাহান : তৃণমূল থেকে নেতৃত্ব বের করে নিয়ে আসার জন্য আমাদের যারা শীর্ষ পর্যায়ে নেতা রয়েছেন, তারা সব সময় কাজ করেন। সব সময় পদ-পদবির জন্য কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয় তৈরি হয়; কিন্তু পদ ছাড়াও যারা সঠিক সময় সঠিক কাজ করেছেন, ভালো ভূমিকা পালন করেছেন— সেসব বিষয়ও মনিটরিং সেল থেকে দৃষ্টি রাখা হয়। আপনারা জানেন, ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের সময় আমাদের হাজার হাজার নেতাকর্মী কারাগারে গেছেন। মিথ্যা মামলা হয়েছে হাজার হাজার। ফলে অনেকে বাড়িঘরে ঘুমাতে পারেন না। কয়েকটি স্থানে নিহতের খবরও উল্লেখযোগ্যভাবে ছিল। তবে এই আন্দোলনে কার কী ভূমিকা ছিল, আমাদের সেসব খুঁজে বের করে মূল্যায়ন করা উচিত। কারো অনুরোধ কিংবা কারো প্রতি কোনো বিরাগের দৃষ্টিতে নয়, যারা আন্দোলনের সময় কাজ করেছেন, মাঠে ছিলেন, জীবনের ঝুঁকি নিয়েছেন, তাদের সামনে নিয়ে আসা উচিত। আমি মনে করি, আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তৃণমূল বিষয়ে অনেক বেশি মনোযোগী। আমরা যারা মাঠ পর্যায়ে রয়েছি, আমাদেরও উচিত কারা রাজপথে উপযুক্ত, তাদের সুযোগ করে দেয়া। এখনও যারা মাঠে আছেন, সেখানে যদি জেলা সভাপতি-সেক্রেটারি কোনো পক্ষ না নিয়ে যাদের ভূমিকা ছিল, তাদের মূল্যায়নের বিষয়ে পজিটিভ থাকেন, তাহলে আমাদের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের অনেক বিষয় সহজ হয়ে যায়। এর ফলে মূল্যায়ন থেকে কেউ পিছিয়ে পড়বেন না।
আমার সংবাদ : নতুন নেতৃত্বে কোন যোগ্যতাকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে।
মো. শাহজাহান : ২৮ অক্টোবরের আন্দোলনের পর কারা রাজপথে ছিলেন, তাদের মূল্যায়নের বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ইতিবাচক। নির্বাচনের আগে থেকে তৃণমূল অনেকের সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন; এখনো বলছেন। বিএনপি যেহেতু বিশাল জনসমর্থিত রাজনৈতিক দল, দেশের জন্য ভূমিকা পালনে যারা ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তাদের বেশি অগ্রাধিকার দেয়া হবে। জনগণের সঙ্গে নেতাকর্মীদের সম্পর্ক মূল্যায়নের মধ্য দিয়ে আগামীতে নতুন নেতৃত্ব তৈরি করা হবে।
আমার সংবাদ : আগামীতে তৃণমূলকে নিয়ে আপনাদের দলীয় ভাবনা কী?
মো. শাহজাহান : রাজপথে আন্দোলনের জন্য তৃণমূলের সাহসকে কাজে লাগানোর দায়িত্ব আমাদের জ্যেষ্ঠ নেতাদের। আগামী দিনে রাজনৈতিক যে সিদ্ধান্ত, সেটা তৃণমূলের মাধ্যমে বড় ধরনের সফলতা আসবে বলে আমি মনে করছি। তৃণমূলের সাহস যদি আমরা কাজে লাগাতে পারি, তাহলে আমরা অবশ্যই বিজয়ী হবো। জনগণের ইচ্ছাটা তৃণমূল বিএনপির মাধ্যমে একটা সুনির্দিষ্ট দিক খুঁজে পাবে। আমি মনে করি, তৃণমূল তাদের শক্তির প্রভাব আমাদের প্রমাণ করে দেখিয়েছে। সেটা যদি এখন ব্যবহার হয়, তাহলে আমি মনে করি সরকার বেশিদিন টিকতে পারবে না।
আমার সংবাদ : ঈদ, পূজা, নির্বাচন সবই গেলো। কবে আপনাদের সরকার পতনের আন্দোলন...
মো. শাহজাহান : খুব শিগগিরই গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে এ সরকারের পতন হবে। কখন হবে— দিনক্ষণ নির্দিষ্ট করে বলা দুরূহ বিষয়; তবে আমরা অভ্যুত্থানের আন্দোলনে আছি। লিফলেট বা কালো পতাকা মিছিলের মধ্যেই আমরা সীমাবদ্ধ থাকব না। আগামীতে যে ভাষা তারা (ক্ষমতাসীনরা) বুঝবে, সেই ভাষায় জবাব দেয়া হবে। জনগণ ভোটকেন্দ্রে না গিয়ে আমাদের পক্ষে যে বার্তা দিয়েছে, আমরা খুব শিগগিরই সেটি কাজে লাগাতে পারব। আমি মনে করি, আগামী রাজনৈতিক কর্মসূচিতে আমাদের দেশের অভ্যন্তরে এবং আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোও একমত পোষণ করবে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলোর রিপোর্ট দেখলেই অনেক বিষয়েরই ইঙ্গিত পাওয়া যাবে। এক-দুটি চাটুকার দেশ ছাড়া কেউ এ সরকারকে বৈধতা দেয়নি।
আমার সংবাদ : সব দলকে নিয়ে এক ব্যানারে আন্দোলনের সম্ভাবনা কতটুকু?
মো. শাহজাহান : আমি মনে করি একসঙ্গে এক ব্যানারে আন্দোলন হলে এ সরকার টিকে থাকতে পারবে না। আগামীতে ডান-বাম, ইসলামিক শক্তি কোনো বিভাজন তৈরি করব না। যদি একটি বিরোধী শক্তিও থাকে, তাকেও আমরা যুক্ত করব। পরিস্থিতি হয়তো এমন হতে পারে আজকে যারা এক ব্যানারে কর্মসূচি চায় না, তারাও বলবে এক ব্যানারে কর্মসূচি পালন করার। তাদের পক্ষ থেকেই এক ব্যানারে কর্মসূচির প্রস্তাব আসাটা আর বেশি দূরে নয়। খুব শিগগিরই রাজনৈতিক সেই পরিস্থিতি এবং সময় জানান দেবে।
আমার সংবাদ : ঢাকার আন্দোলন এবং শীর্ষদের ভূমিকা নিয়ে তৃণমূল প্রশ্নে কী বলবেন।
মো. শাহজাহান : আপনি যেটা বলেছেন, ঢাকার আন্দোলন নিয়ে তৃণমূল নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ রয়েছেন— সেটা কিছু কারণে থাকতেই পারে। তবে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নির্দেশনায় কোনো দ্বিমত নেই। এবার তৃণমূলের অবদান আমাদের দলের কাছে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য স্বীকৃতি পেয়েছে। তবে এটা ঠিক, একটি দলের রাজনৈতিক কর্মী তার দলের কাছে রাজনৈতিক মূল্যায়নের চেয়ে বেশি কিছু চাহিদা থাকে না। ঢাকার আন্দোলন নিয়ে যে প্রশ্নের কথা বারবার বলছেন, আমি মনে করি না এটা বেশিসংখ্যক নেতাকর্মী বলছেন। একটি রাজনৈতিক দলে বহু ভারসাম্যের, বহু ধরনের, বহু মেজাজের লোক থাকে। সেখান থেকে দু-একজন যদি প্রশ্ন তোলেনও, তবে আমি সেটির পাল্টা জবাব দেব না। কারণ, সবাই বুঝতে পারছে একটি স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে লড়াই একটি যুদ্ধের মতো চলছে। আমাদের নেতাকর্মীরা এখনো কোনো মনোবল হারাননি। এখানে যে শুধুমাত্র আমাদের রাজনৈতিক ভূমিকার রয়েছে, তেমনও নয়। সাধারণ মানুষ বিএনপিকে এখনো আস্থা, ভরসা, সাহস দিয়ে যাচ্ছে। জনগণ বিএনপিকে সাহস দিয়ে এই ভাষা জানাচ্ছে যে, এই তুঘলকী ভোটে সরকার বেশিদিন টিকবে না। জনগণও মনে করছে যে কোনো মুহূর্তে সরকারের পতন হবে। জনগণ যখন বিএনপিকে এসব কথা বলে, তখন এগুলো বিএনপির প্রতি জনগণের সরল স্বীকারোক্তিই বটে। আমাদের তৃণমূল নেতাকর্মীরা অনেক সাহসী। তাদের বৈপ্লবিক ভূমিকায় যে কোনো সময় যে কোনো কিছু ঘটতে পারে। এখন আমাদের উচিত তাদের আন্দোলনের জন্য আরও সুসংগঠিত করা এবং দুঃসময়ে (আন্দোলনের সময়) যারা ঝুঁকি নিয়ে রাজপথে ছিলেন, তাদের যথাযথ মূল্যায়ন করা।
আমার সংবাদ : আওয়ামী লীগের বুদ্ধির কাছে বারবার ব্যর্থ হচ্ছেন। এ ব্যাপারে কী বলবেন?
মো. শাহজাহান : আমরা একটি বৃহৎ গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল; আর আমাদের বিরোধী আওয়ামী লীগ যারা রয়েছে, তারা হলো সশস্ত্র রাজনৈতিক দল। আমাদের দুইভাবে লড়াই করতে হয়— একটা আওয়ামী লীগের সঙ্গে, আরেকটা সরকারের সশস্ত্র বাহিনীগুলোর সঙ্গে। আমাদের রাজনীতি জনগণকে নিয়ে, জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে। জনগণের সে সহমর্মিতা ও সহযোগিতা আমরা পেয়েছি। নির্বাচনের পূর্বে আমাদের দেশব্যপী যে জনসভাগুলো হয়েছে, ঢাকায় যে সমাবেশগুলো হয়েছে— সেই জনস্রোত অবশ্যই প্রমাণ হয়েছে এবং সব শেষ জাতীয় নির্বাচনে জনগণ ভোটকেন্দ্রে না গিয়ে বিএনপির পক্ষে রায় দিয়েছে। এগুলোর পেছনে যে আমরা অনেক অর্থ ব্যয় করেছি তা নয়; এটা বিএনপির প্রতি জনগণের ভালোবাসার প্রতীক।
আমার সংবাদ : ২০ দল ভেঙে বহু ব্যানারসর্বস্ব দল নিয়ে ঐক্য গঠন করে কী পেলেন?
মো. শাহজাহান : অতীতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আর এখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি এক নয়। অতীতের প্রশাসনিক অবস্থা আর আজকের প্রশাসনিক অবস্থা এক নয়। অতীতে সরকারি সংস্থার আচরণ আর আজকের সরকারি সংস্থার আচরণও এক নয়। আমাদের এ বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হয়। এই আন্দোলনে ছোট রাজনৈতিক দলগুলো তাদের যে শক্তি রয়েছে, তারা সেটা নিয়ে ভূমিকা দেখানোর চেষ্টা করেছে; বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে। এই পরিস্থিতি আমাদের বড় একটা বার্তা দিয়েছে আর সেটা হলো— বড় কে ছোট কে, এখন সেটি দেখার বিষয় নয়। কে ব্যানারসর্বস্ব, ব্যানারসর্বস্ব কে নয়— এগুলো বিবেচনার বিষয় নয়। কোন রাজনৈতিক দলের কত রাজনৈতিক কর্মী আছে, শক্তি আছে, সেগুলো হিসাবের বিষয় নয়। এখন বিষয় একটাই, এই ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে যারা থাকতে চায়, সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া হবে। আমি মনে করি, এখন সব দল ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে চায়। বিভাজন তৈরি না করে একত্রিত হয়ে একসঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন চালিয়ে যেতে পারলে এ সরকার বেশিদিন টিকবে না। জনগণও এই ঐক্যবদ্ধ শক্তির সংস্পর্শে অনেক সাহস পাবে। আমাদের নেতাকর্মীদেরও আরও সাহস বৃদ্ধি পাবে। এতে সরকারের পতন সুনিশ্চিত হবে বলে আমি মনে করি।