- পরিদর্শন করলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, যৌথবাহিনীর অভিযান শুরু
- তিন-চারগুণ সদস্য বাড়িয়েছে কেএনএফ গহীন পাহাড়ে গড়েছে গোপন আস্তানা
- এবার আর কোনো ছাড় নয়, কোনো অস্ত্রধারীকেই বাংলাদেশ ভূখণ্ডে থাকতে দেয়া হবে না —স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
- শান্তিচুক্তির আগের অবস্থায় ফিরছে বান্দরবান —আশঙ্কা স্থানীয়দের
- মাতৃভূমি রক্ষার নামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যেদের জীবন হুমকির মধ্যে ঠেলে দিচ্ছেনস্বরাষ্ট্রমন্ত্রী —ফেসবুক পোস্টে কেএনএফ
- সহজে বিশ্বাস করা ঠিক হবে না —বলছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা
বান্দরবানে সৃষ্ট অস্থিরতার নেপথ্যে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)। ক্রমেই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ছুড়ছে চ্যালেঞ্জ। হামলা, লুটপাট, অপহরণ সবই করছে সংগঠনটি। গত বছর থেকেই শুরু হয় কেএনএফের সশস্ত্র কর্মকাণ্ড। ‘নো ফুল স্টেট, নো রেস্ট’ অর্থাৎ পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্র ব্যতীত অবসর নয় —এমনটাই বলছে তারা। সেনাবাহিনীর আদলে পড়ছে ‘কমব্যাট’ পোশাকও। সবুজ ঢেউয়ের ওপরে নীল আবহের মাঝখানে সাদা তারকাসংবলিত একটি পতাকাও তৈরি করেছে তারা। সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে এখন স্থানীয়দের ধারণা, শান্তিচুক্তির আগের অবস্থায় ফিরছে বান্দরবান।
যদিও গতকাল শনিবার বান্দরবানে সার্বিক পরিস্থিতি পরিদর্শনে গিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এবার আর কোনো ছাড় নয়। সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় যৌথবাহিনীর অভিযানও শুরু হয়েছে ইতোমধ্যে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বাড়ানো হচ্ছে পুলিশ, র্যাব, আনসার ও বিজিবির সংখ্যা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলছেন, কোনো ধরনের অস্ত্রধারীকে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে থাকতে দেয়া হবে না। যদিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সংগঠনটির পেজে ইনফরমেশন অ্যান্ড ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ—আইআইবির ক্যাপ্টেন ফ্লেমিং নামের একজন পোস্ট করে বলছেন, মাতৃভূমি রক্ষার নামে বাংলাদেশ পুলিশ, সেনাবাহিনী, আনসার, এলিট ফোর্স ও বিজিবি সদস্যেদের জীবন হুমকির মধ্যে ঠেলে দিচ্ছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এলসিপি বা শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির সাথে স্বাক্ষরিত চুক্তি মোতাবেক সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। উল্টো এই চুক্তি অমান্য করে কুকি-চিন জনগোষ্ঠীর নিরীহ জনগনকে অত্যাচার করে এসেছে। অস্থায়ী ক্যাম্প সরিয়ে নেয়ার চুক্তি হলেও তার কোনোটিই পালন করেনি সরকার। এর আগে একই পেজ থেকে আরেকটি পোস্টের মাধ্যমে বদলা নেয়ার ঘোষণা দিয়ে তার কিছু দিন পরই ব্যাংক-মসজিদে হামলা চালিয়ে লুটপাট-মারধর ও ব্যাংক ম্যানেজারকে অপহরণের ঘটনা ঘটায় কেএনএফ।
সর্বশেষ পরিস্থিতির বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রুমা ও থানচি উপজেলায় কেএনএফের হামলা, ব্যাংক লুট, নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশ ও আনসার সদস্যের অস্ত্র লুট এবং ব্যাংক ম্যানেজারকে অপহরণের ঘটনায় জেলাজুড়ে বিরাজ করছে থমথমে পরিস্থিতি। ইতোমধ্যেই র?্যাবের মধ্যস্থতায় অপহূত সোনালী ব্যাংকের রুমা শাখার ম্যানেজার নেজাম উদ্দিনকে উদ্ধার করে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় কেএনএফের বিরুদ্ধে যৌথ বাহিনীর অভিযানও শুরু হয়েছে। চলমান পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে গতকাল বান্দরবান যান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।
তিনি ক্ষতিগ্রস্ত ব্যাংক, মসজিদ ও উপজেলা পরিষদ পরিদর্শন করেন। রুমা উপজেলার ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, শান্তিপ্রিয় এলাকা, যেখানে শান্তির সুবাতাস সবসময় বইত সেখানে আমরা এ ধরনের ঘটনা কামনা করি না। হামলায় কাদের সংশ্লিষ্টতা ছিল তাদের আমরা আইনের আওতায় আনব। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সেনাবাহিনী তারা তাদের মতো করে কাজ করবে। তিনি বলেন, আমরা আর কোনো কিছুকে চ্যালেঞ্জ নিতে দেবো না। এর উৎপত্তি, উৎস কোথায় খুঁজে বের করব। তাদের সবাইকেই আইনের আওতায় আনব। বৈঠকের পর তিনি বলেন, একটি সশস্ত্র সংগঠন তাদের অবস্থান জানান দেয়ার জন্য এ ধরনের একটি ঘটনা ঘটিয়েছে। আমরা মনে করি যারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে, তারা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গিয়ে অপরাধ করেছে। কাজেই রাষ্ট্র চুপ থাকতে পারে না। আমরা এ জন্য যা যা করণীয় তা করব। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য আমরা পুলিশ, র?্যাব, আনসার সদস্যের সংখ্যা বৃদ্ধি করব। আমরা সীমান্তে বিজিবি বৃদ্ধি করব।
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী সামরিক বাহিনীর প্রধানকে নির্দেশনা দিয়েছেন সবাই মিলে যেন যৌথ অভিযান পরিচালনা করে। তার আগে পুলিশ, র্যাব, আনসার ও বিজিবি দিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য যা যা প্রয়োজন আমরা তা করব। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, কোনো ধরনের অস্ত্রধারীকে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে থাকতে দেবো না। আমরা অনেক ধৈর্যের সঙ্গে তাদের সঙ্গে আলোচনা করেছি। বান্দরবান জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান তাদের সঙ্গে দুবার আলোচনায় বসেছেন। তারা আলোচনায় না গিয়ে তাদের অবস্থান জানান দেয়ার জন্য এ ধরনের কর্মকাণ্ড করেছে। তিনি আরও বলেন, যারা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত তারা যদি বিদেশেও আশ্রয় নেয়, আমরা ইন্টারপোলের মাধ্যমে তাদেরকে দেশে ফেরত এনে বিচারের ব্যবস্থা করব। কেএনএফের সঙ্গে আর কোনো আলোচনা হবে কি-না এমন প্রশ্নে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমরা জনগণের বাইরে না। এই এলাকার জনসাধারণ যদি মনে করে আলোচনা হওয়া উচিত, তাহলে আলোচনা হতেও পারে, এই সিদ্ধান্ত জনগণের। তবে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের কাজ চালিয়ে যাবে।
এদিকে তিন-চারগুণ সদস্য বাড়িয়ে ক্রমেই দুর্ধর্ষ হয়ে উঠেছে কেএনএফ। গহীন পাহাড়ে গড়ে তুলেছে গোপন আস্তানা। জানা গেছে, তাদের সক্রিয় নারী সদস্যরা ব্যাংক ডাকাতি ও থানচি থানা হামলায় সরাসরি অংশ নেয়। সোনালী ব্যাংকের রুমা শাখার ম্যানেজার নেজাম উদ্দিনকেও অপহরণের পর ওই গোপন আস্তানায় নিয়ে যায় তারা। এত কিছুর পর কেএনএফের সঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে আলোচনার বিষয়ে সতর্ক থাকতে বলছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, দুর্ধর্ষ কেএনএফকে সহজে বিশ্বাস করা যাবে না। দুর্ধর্ষ কেএনএফের তৎপরতা থামাতে এরই মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে পুলিশ-র্যাব-সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। সংগঠনটির সশস্ত্র শাখাকে চিহ্নিত করার জন্য একাধিক টিম গঠন করেছে পুলিশ। সশস্ত্র এই বাহিনীর বিষয়ে নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, কেএনএফ একই সঙ্গে বিচ্ছিন্নতাবাদ ও জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িত। তাই তাদের খুব সহজে বিশ্বাস করা যাবে না। সংগঠনটির সঙ্গে শান্তি আলোচনা বৈঠকে যারা জড়িত রয়েছে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কৌশল সম্পর্কে তারা অভিজ্ঞ কি-না, সেটিও দেখার বিষয়। আবার ভূরাজনীতির কৌশলগত কারণে কেএনএফকে কেউ ব্যবহার করেছে কি-না তা বের করা জরুরি। তবে পার্বত্য এলাকায় আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যে সক্ষমতা রয়েছে তার সিকিভাগও কেএনএফের নেই। এর আগেও তাদের চেয়ে দুর্ধর্ষ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমন করা হয়েছিল। র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স) কর্নেল মাহাবুব আলম বলেন, বান্দরবানে যতগুলো অপরাধ কেএনএফ করেছে, পর্যায়ক্রমে সবগুলোর ক্ষেত্রেই আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। বেশ কয়েকটি গ্রুপে ভাগ হয়ে তারা অপরাধ ঘটাচ্ছে বলে তথ্য আমরা পেয়েছি। কেউ ছাড় পাবে না।
ফলাফলশূন্য শান্তি আলোচনা : গত বছরের জুলাইয়ে কেএনএফের সঙ্গে শান্তি আলোচনা শুরু হয়। দু’দফা ভার্চুয়াল আলোচনার পর ৫ নভেম্বর প্রথমবার মুখোমুখি বৈঠক হয়। প্রথম বৈঠকটি হয়েছিল রুমার মুনলাই পাড়ায়। এরপর ৫ মার্চ বান্দরবানের রুমা উপজেলার বেথেল পাড়ায় দ্বিতীয় দফায় মুখোমুখি বৈঠক হয়েছে। ২২ এপ্রিল তৃতীয় দফায় সশরীরে বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। তবে তা বাতিল করে দেয় শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি। কমিটির অন্যতম সদস্য জারলম বম বলেন, কেএনএফের সর্বশেষ অপকর্মের পর শান্তি আলোচনা বাতিল করা হয়েছে।
কমিটির আহ্বায়ক ও বান্দরবান জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্য শৈ হ্লা বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে জানান, ব্যাংক ডাকাতি এবং ত্রাস সৃষ্টির ঘটনায় কেএনএফের সঙ্গে সংলাপ করার সব পথ বন্ধ হয়ে গেছে। স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে গত শতকে সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্র লড়াই শুরু করে। তাদের সশস্ত্র শাখা শান্তি বাহিনী নামে পরিচিত ছিল। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি হওয়ার পর পাহাড়ে স্বস্তি ফিরে আসে। তবে সেই সুবাতাস বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। পাহাড়ে ছোট ছোট কয়েকটি সশস্ত্র গ্রুপ তৈরি হয়। চুক্তির পর চুক্তিবিরোধীরা পাহাড়ি তরুণদের নিয়ে একটি গোষ্ঠী ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলে। তাদের সঙ্গে জেএসএসের সংঘাত এখনো চলছে। এর মধ্যে ২০০৭ সালে জেএসএসের একটি অংশ মূল দল থেকে বের হয়ে জেএসএস (লারমা) নামে আরেকটি সংগঠন গড়ে তোলে। ২০১১ সালের মাঝামাঝি সময় ম্রো ন্যাশনাল পার্টি (এমএনপি) নামে একটি দল গড়ে ওঠে বান্দরবানের আলীকদমে। ২০১৫ সালের নভেম্বরে দলটির ৭৯ জন সদস্য একযোগে আত্মসমর্পণ করেন। ২০১৭ সালে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক নামে আরেক সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। ২০১৮ সালে বান্দরবানে ‘মগ পার্টি’ তৎপরতার তথ্য সামনে আসে।