- কৌশলী ভূমিকায় যুক্তরাষ্ট্র
সংঘাত দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার আশঙ্কা নেই
—ড. মো. খালিদ কুদ্দুস অধ্যাপক আন্তর্জাতিক
সম্পর্ক বিভাগ, জাবি
ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে চলমান উত্তেজনা শেষ পর্যন্ত বড় ধরনের যুদ্ধে গড়ায় কিনা এ নিয়ে চলছে নানা বিশ্লেষণ। বড় সংঘাতের শঙ্কাও প্রকাশ করছেন কেউ কেউ। পরিস্থিতি নিয়ে প্রভাবশালী কয়েকটি রাষ্ট্র ইতোমধ্যে সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। কেউ কেউ মিত্রের পাশেও দাঁড়িয়েছে। এক সপ্তাহ আগে গত রোববার ভোরে ইরান ইসরাইলি হামলার পাল্টা জবাব দেয়ার পর পরিস্থিতি নতুন মোড় নেয়। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ভয়াবহ সংঘাতের শঙ্কাও প্রকাশ করা হয় আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমের বিশ্লেষণে। পরিস্থিতি নিয়ে ইসরাইল তার মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষ করে কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই। তবে ১৯ এপ্রিল ভোরে ইসরাইল ফের হামলা চালালে সপ্তাহ পরে বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আসে। বিশ্লেষকরা ইসরাইলের হামলাকে নিয়ম রক্ষার বা সম্মান রক্ষার হামলা বলেও মনে করছেন।
গত ১৪ এপ্রিল ভোরে ইরান ইসরাইলে হামলা চালানোর পর পরিস্থিতি শান্ত ছিল এক সপ্তাহ, এরপর গত ১৯ এপ্রিল ভোরে ইরানে ফের হামলা চালায় ইসরাইল। এই হামলা ইরান সহজেই নিয়ন্ত্রণ করে নেয়। বড় হামলার জন্য ইসরাইল তার প্রধান মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সহযোগিতা ও সমর্থন চাইলেও ইতিবাচক কোনো সাড়া পায়নি ইসরাইল। ফলে ইরানে নিয়ম রক্ষার হামলা চালায় ইসরাইল। কেউ কেউ এই হামলাকে ইহুদি জনগোষ্ঠীকে শান্ত রাখার হামলা বলেও মনে করছেন। তবে এই হামলার পর ইসরাইলকে এখনই থামানো দরকার বলে মন্তব্য করেছে ইরান। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী এমন মন্তব্য করেন।
গত শুক্রবার ইরানের স্থানীয় সময় ভোর ৪টায় ইসফাহানে ইসরাইল ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় বলে খবর ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু ইরান এমন দাবিকে প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা বলেছে, অনুপ্রবেশকারীরা কিছু ড্রোন উড়িয়েছিল। তা গুলি করে ভূপাতিত করা হয়েছে। এদিন ইরানের সার্বিক পরিস্থিতি ছিল শান্ত। পারমাণবিক স্থাপনাগুলো ছিল নিরাপদ। ইরানে ড্রোন হামলার আগে যুক্তরাষ্ট্রকে জানিয়েছিল ইসরাইল। কিন্তু তাতে সমর্থন ছিল না যুক্তরাষ্ট্রের। দেশটির কিছু কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে গণমাধ্যম এ খবর দিয়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন না পেয়েই ইসরাইল ক্ষেপণাস্ত্র হামলা থেকে বিরত থাকতে পারে। এসব বিষয়ে একজন মার্কিন কর্মকর্তার বরাত দিয়ে সিএনএন লিখেছে, আমরা কোনো প্রতিক্রিয়াকে সমর্থন করিনি। তবে হোয়াইট হাউস এবং পেন্টাগন এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। ইরান বলছে, এ ঘটনার সঙ্গে মাত্র কয়েকটি ড্রোন জড়িত ছিল। ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করে দেশটির একজন কর্মকর্তা বলেন, এ নিয়ে মার্কিন গণমাধ্যমে যে খবর প্রচারিত হয়েছে তা সত্য নয়। ওদিকে ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোরের (আইআরজিসি) ঘনিষ্ঠ আধা-সরকারি তাসনিম সংবাদ সংস্থা একটি ভিডিও পোস্ট করেছে। ভিডিওর ক্যাপশনে লেখা হয়েছে ‘ইসফাহানের পারমাণবিক কার্যক্রমের কেন্দ্র সম্পূর্ণ নিরাপদ’।
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আবদুল্লাহিয়ান ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ব্যাপারে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছেন, তাকে নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। গত শুক্রবার মার্কিন সংবাদমাধ্যম এনবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ইসরাইল যদি আরেকটি দুঃসাহসিক কাজ করতে চায় এবং ইরানের স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করতে চায়, তা হলে আমাদের পরবর্তী প্রতিক্রিয়া তাৎক্ষণিক এবং সর্বোচ্চ পর্যায়ে হবে।
ইরানের গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশ ইসপাহানের একটি সামরিক ঘাঁটিতে ইসরাইলি হামলার পর ইরানিরা সতর্ক হয়ে উঠেছে। ১৪ এপ্রিল ইসরাইলে তেহরানের ৩০০ ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলার পর তেলআবিবের সম্ভাব্য প্রতিশোধের বিষয়ে ধারণা আছে, এমন কয়জন পশ্চিমা কর্মকর্তা বিশ্বাস করেন, এটি কেবল ‘প্রথম দফা’। লেবাননের একজন পশ্চিমা কূটনীতিকের ভাষ্য, ইসরাইলের কৌশলটি হচ্ছে— সামান্য হামলার মাধ্যমে ইরানকে বড় পরিসরে পাল্টা হামলা করার জন্য উত্তেজিত করে তোলা।
জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. খালিদ কুদ্দুস মনে করেন, ইরান ও ইসরাইল পরিস্থিতি খুব বেশি বাড়বে না। কারণ, মধ্যপ্রাচ্যে এখন কোনো সংঘাত চায় না যুক্তরাষ্ট্র। কয়েক মাস পর যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচন, এ পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র যদি ইসরাইলকে যুদ্ধে সহযোগিতা দেয় তাহলে ভোটের মাঠে পিছিয়ে পড়বেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
তিনি আমার সংবাদের এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে আরও বলেন, ইসরাইল হামলা চালিয়ে ইরানের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক কর্মকর্তাসহ বেশ কয়েকজনের প্রাণহানি ঘটিয়েছে, এর প্রেক্ষাপটে প্রতিশোধ নেয়া খুবই জরুরি ছিল ইরানের জন্য, সে কারেণই ইরান গত ১৪ এপ্রিল ভোরে ইসরাইলে হামলা চালিয়েছে। আবার ইসরাইলও এই হামলার জবাব দিয়েছে নামে মাত্র, এরা কেউ বড় ধরনের হামলায় যায়নি। এতে বুঝা যায় বড় কিছু হবে না। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে তাদের দেশের নির্বাচনকে সামনে রেখে বড় ধরনের হামলা এড়িয়ে চলার কৌশল নিচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের এই উত্তেজনায় বাংলাদেশের নেতিবাচক কোনো প্রভাব পড়বে না বলেও মন্তব্য করেছেন জাবির এই অধ্যাপক। কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, ইউক্রেন থেকে আমাদের দেশে খাদ্যশস্য আসতো, সে কারণে ইউক্রেন যুদ্ধে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল, কিন্তু ইরানের সঙ্গে আমাদের এমন কোনো বিষয় নেই।
প্রসঙ্গত, গত ১ এপ্রিল সিরিয়ার দামেস্কে ইরানি কনস্যুলেটে হামলা চালায় ইসরাইল। হামলায় ইরানের কয়েকজন শীর্ষ সেনা কর্মকর্তা নিহত হন। ওই হামলার জবাবে ১৪ এপ্রিল ভোরে ইসরাইলকে লক্ষ্য করে ৩০০ ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ড কোর (আইআরজিসি)। এ হামলার প্রতিশোধ নিতে ইরানে পাল্টা হামলার কথা বলেছিল ইসরাইল। গত ১৯ এপ্রিল সেই হামলার বিষয়টি আলোচনায় আসে।