- শ্রমজীবীদের স্বস্তি দিতে ঢাকাসহ সারাদেশে চলছে বিশুদ্ধ পানি স্যালাইন ও শরবত বিতরণ কার্যক্রম
- সরকারি-বেসরকারি সংস্থা রাজনৈতিক, সামাজিক সংগঠনের পাশাপাশি ব্যক্তি উদ্যোগ
- টিফিনের টাকা জমিয়ে পানি স্যালাইন বিতরণ করছে শিক্ষার্থীরা
- তীব্র তাপদাহে এমন কর্মসূচিকে সাধুবাদ জানিয়েছেন দেশের মানুষ
তথ্য-প্রযুক্তির উৎকর্ষতা মানুষের মধ্যে যে পরিবর্তন এনেছে, তাতে নেই মানবিকতা। তবে হিটস্ট্রোকে মৃত্যু ও বিভিন্ন শারীরিক জটিলতাসহ ওষ্ঠাগত জনজীবনে যে পরিবর্তন এনে দিয়েছে চলমান দাবদাহ, তাতে মিলেছে মানবতার জয়গান। দেশে বিভিন দুর্ঘটনায় কন্টেন্ট তৈরির উদ্দেশে দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিদের উদ্ধারের আগে ছবি কিংবা ভিডিও ধারণের প্রবণতাই বেশি দেখা গেছে। এমনও ঘটনা ঘটেছে, যদি সময়মতো উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়া যেত; তাহলে আহত ব্যক্তির মৃত্যু হয়তো ঠেকানো যেত। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক বা ইউটিউবসহ বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচার করে অর্থ উপার্জনের নেশায় অমানবিক হয়ে উঠে একটি শ্রেণি। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগেও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে সরকারি অনুদান ব্যতীত ব্যক্তি উদ্যোগে পাশে দাঁড়ানোর নজির খুবই কম।
তবে মহামারি করোনার পর দেশজুড়ে চলমান দাবদাহে যখন রাস্তায় রিকশাচালক, মাঠে কৃষক, কর্মস্থলে কর্মজীবীদের হিটস্ট্রোকে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে, তখনই কিছুটা স্বস্তি দেয়ার উদ্দেশে হলেও রাস্তায় নেমে আসছেন বিত্তবানরা। সরকারি বিভিন্ন সংস্থার পাশাপাশি ছোট-বড় ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক ব্যক্তি-সংগঠন, শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের উদ্যোগে পানি, খাবার স্যালাইন ও শরবত নিয়ে নেমেছে রাস্তায়। রিকশা, সিএনজি, বাস থেকে শুরু করে সব যানবাহনের চালক-হেলপার-সুপারভাইজারসহ তৃষ্ণার্ত যাত্রী ও পথচারীদের মধ্যে পানি, স্যালাইন, শরবত বিতরণ করছেন নিয়মিত। এমন উদ্যোগ নিয়ে রাস্তায় নামা মানুষের সংখ্যা ক্রমান্বয়েই বাড়ছে। গত বছরের দাবদাহে এ দৃশ্য দেখা যায়নি। সরকারি ও ব্যক্তি পর্যায়ে নেয়া এমন উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন নগরবাসী। দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা শহরেও এই কার্যক্রম হাতে নিয়েছে বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষ ও সামাজিক-রাজনৈতিক সংগঠন।
ইট-পাথরের শহর ঢাকা। বিভিন্ন ঘটনাচক্রে মানুষ উদাহরণ দিয়েও বলে থাকেন— ঢাকার মানুষের হূদয় ভীষণ কঠিন। অনেকেরই ধারণা, শহুরে জীবনে কেউ কারো পাশে দাঁড়াতে চায় না। তবে চলমান দাবদাহে এমন ধারণারও কিছুটা হলেও পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে করছেন অনেকেই। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার হাবিবুর রহমান মানবিক পুলিশ অফিসার হিসেবেই ব্যাপক সমাধৃত। পুলিশি সেবার পাশাপাশি ব্যক্তি উদ্যোগে বিভিন্ন সেবামূলক কর্মকাণ্ডে রয়েছে তার সুখ্যাতি। চলমান দাবদাহেও সর্বপ্রথম তিনিই ঢাকার রিকশাচালক ও সব প্রকার যানবাহন চালকসহ পথচারীদের স্বস্তির উদ্দেশে বিশুদ্ধ পানির বন্দোবস্ত করেন। যা প্রশংসা কুড়ায় নগরবাসীর। বিষয়টি গণমাধ্যমের কল্যাণে ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই মূলত যার যার অবস্থান থেকে সাধ্য অনুযায়ী পানি, স্যালাইন কিংবা শরবত নিয়ে রাস্তায় নামতে শুরু করেন রাজনৈতিক ব্যক্তি, ব্যবসায়ী, শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন সংগঠন। রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় দেখে গেছে, রিকশাচালক ও পথচারীদের জন্য বাড়ির প্রবেশপথে বিশুদ্ধ পানির জার বসিয়েছেন বাড়ির মালিকরা। সাথে রেখেছেন হালকা নাশতার জন্য বিস্কুটও। বাড়ির প্রবেশপথে বিশুদ্ধ পানির জার বসানোর এমন উদ্যোগকেও স্বাগত জানিয়েছেন নগরবাসী।
গতকাল রোববার মতিঝিল মেট্রোরেল স্টেশন ও আমার সংবাদ কার্যালয়ের নিচেই রিকশাচালক-পথচারীদের মধ্যে বিশুদ্ধ পানি ও খাবার স্যালাইন বিতরণ করেন আমার সংবাদ ও দ্য ডেইলি পোস্টের সম্পাদক-প্রকাশক হাশেম রেজা। তিনি বলেন, তীব্র দাবদাহে জনজীবন ওষ্ঠাগত। এ অবস্থায় পথচারী ও যানবাহনচালকদের কিছুটা স্বস্তি দিতেই আমার সংবাদের পক্ষ থেকে আজ পানি ও স্যালাইন বিতরণ করা হচ্ছে। এ কার্যক্রম চলমান থাকবে। একই দিন রাজধানীর জিরো পয়েন্টে রিকশা-সিএনজি-প্রাইভেটকার-বাসচালক ও পথচারীদের মধ্যে বিশুদ্ধ পানি ও খাবার স্যালাইন বিতরণ করেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক রিয়াজ উদ্দিন। প্রায় ৫০০ বোতল পানি-স্যালাইন বিতরণ করেন তিনি। তিনি বলেন, দাবদাহের এ পর্যায়ে মানুষ বাসা থেকেই বের হতে ভয় পায়। তবুও জীবিকার তাগিদে বের হতে হচ্ছে।
ইতোমধ্যে রাস্তায় নেমে হিটস্ট্রোকে মারাও গেছেন বেশ কজন রিকশাচালক। এ অবস্থায় আমার উদ্দেশ্যই হচ্ছে, তাদের কিছুটা স্বস্তি দেয়া। টানা সাত দিন পানি-স্যালাইন বিতরণ করবেন জানিয়ে তিনি বলেন, গতকাল প্রথম দিন দিয়েছি। আরও ছয়দিন রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ ছয়টি স্থানে পানি বিরতণ করব। এর আগে গত বৃহস্পতিবার মতিঝিল মেট্রোরেল স্টেশনের নিচে পানি ও স্যালাইন বিতরণ করেন মেসার্স জননী ট্রেডার্সের মালিক মো. আসাদ মিয়া। গতকাল রোববার রামপুরা এলাকায় পথচারী ও যানবাহন চালকদের মধ্যে শরবত বিতরণ করে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সদস্যরা। শনিবার নারায়ণগঞ্জে দুই হাজার পথচারী, দিনমজুর ও গাড়িচালকদের মধ্যে খাবার পানি ও স্যালাইন বিতরণ করেছে নবম শ্রেণির পাঁচ শিক্ষার্থী। জানা গেছে, টিফিনের টাকা জমিয়ে শহরের দুই নম্বর রেলগেট, ডিআইটি ও দেওভোগ শেখ রাসেল পার্ক এলাকায় স্যালাইন-পানি বিতরণ করে তারা। এই উদ্যোগ গ্রহণ করে ক্যামব্রিয়ান স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির পাঁচ শিক্ষার্থী। তারা হলো— কারগিল খাঁন, আসওয়াদ খাঁন, অর্ণব খাঁন, দাইয়ান সিদ্দিক ও নিরব আহমেদ।
গতকাল গুলশান-২ নগর ভবনের সামনে রিকশাচালকদের মধ্যে ছাতা বিতরণ কর্মসূচির উদ্বোধন করেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ডিএনসিসি এলাকার ৩৫ হাজার রিকশাচালককে বিনামূল্যে একটি করে ছাতা, ১২ প্যাকেট খাবার স্যালাইন ও একটি হাফ লিটার পানির কনটেইনার দেয়া হবে। তিনি বলেন, তীব্র দাবদাহে রিকশাচালক ভাইদের খুব কষ্ট হয়। প্রচণ্ড রোদে তারা যদি অসুস্থ হয়ে যায় তাহলে পুরো পরিবারের জন্য অনেক সমস্যা। রোদের কারণে তারা যদি রিকশা চালাতে না পারেন, তারা যদি অসুস্থ হয়ে পড়েন তাহলে তাদের পরিবার কিন্তু চলতে পারবে না। কারণ অনেক রিকশাচালকের দৈনিক ইনকামে তাদের পরিবার চলে। তাই তীব্র দাবদাহে তাদের কষ্টের বিষয় চিন্তা করে আমরা এই উদ্যোগ নিয়েছি।’