চেয়ারম্যান প্রার্থীকে জেতাতে প্রশাসনিক ছক!

বেলাল হোসেন প্রকাশিত: মে ১৪, ২০২৪, ০৩:৩২ পিএম
চেয়ারম্যান প্রার্থীকে জেতাতে প্রশাসনিক ছক!

চলছে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। এবারের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপিদের আত্মীয়দের দাপট তুঙ্গে! দেশের বেশিরভাগ উপজেলায় আওয়ামী লীগ পদধারীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা চোখে পড়ার মতো। এর পাশাপাশি আছে প্রশাসনিক বিশাল ছকও! যার ফলে এবারের নির্বাচনে যার আত্মীয় মন্ত্রী বা এমপি, তার জয় প্রায় নিশ্চিত— এমনটাই দাবি স্থানীয়দের। 

ইতোমধ্যেই প্রথম ধাপের নির্বাচন হয়ে গেছে। আগামী ২১ মে দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনের জোর প্রচারণা চলছে। অনেক এলাকায় প্রার্থীদের একে অপরের বিষয়ে অভিযোগ রয়েছে বিস্তর। মন্ত্রীর আত্মীয়দের প্রতি প্রশাসনের বিশেষ সহায়তা নিয়ে অনেকের অভিযোগ তো আছেই।

এমনই অভিযোগ উঠেছে রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দিতে। বালিয়াকান্দি উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে দুজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। দুজনই উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা। আবুল কালাম আজাদ বর্তমান চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। এহসানুল হাকিম উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। এহসানুল হাকিমের আপন চাচাতো ভাই মো. জিল্লুল হাকিম রেলপথমন্ত্রী ও রাজবাড়ী-২ আসনের (পাংশা, বালিয়াকান্দি ও কালুখালী) সংসদ সদস্য।

সম্প্রতি রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও বালিয়াকান্দি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের  ষ এরপর পৃষ্ঠা ১১ কলাম ৪

অভিযোগ করেছেন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী আবুল কালাম আজাদ। ইউএনওকে প্রত্যাহারের দাবি ও বিভিন্ন অভিযোগ জানিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এবং রাজবাড়ী জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিতভাবে অভিযোগ করেছেন তিনি। 

চেয়ারম্যান প্রার্থী বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম আজাদ বলেন, বর্তমান ইউএনও রফিকুল ইসলামের নির্বাচনি তফসিল ঘোষণার আগেই ২২ ফেব্রুয়ারি বদলির আদেশ হলেও তিনি তদবির করে নির্বাচন শেষ না করে যাবেন না বলে ঘোষণা দিয়েছেন। তার স্থলে একজনকে পদায়ন করা হলেও অদৃশ্য কারণে  ওই আদেশ স্থগিত করে পূর্বতন স্থানেই তাকে রাখা হয়েছে। এসবই যেন অদৃশ্য ছকের মতো। বিভিন্নভাবে নির্বাচনে পক্ষপাতিত্ব করছেন ইউএনও রফিকুল ইসলাম। আমার বাড়িতে হামলা, এমনকি আমার প্রচার মাইকের মেমোরি কার্ড পর্যন্ত খুলে নেয়ার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু এসব বিষয়ে তিনি (ইউএনও) কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। 

আবুল কালাম আজাদ বলেন, সরকার, নির্বাচন কমিশন স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বললেও বালিয়াকান্দি উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম সেটিকে উপেক্ষা করছেন। আমি সুষ্ঠু-শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টির স্বার্থে ইসি ও রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে ইউএনও রফিকুল ইসলামকে প্রত্যাহার করার অভিযোগ করেছি। আশা করি নির্বাচন কমিশন দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।

বালিয়াকান্দি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম অভিযোগের বিষয়ে আমার সংবাদকে বলেন, ট্রান্সফার হলেও আমি যেতে পারব না, আমার এখানে অফিসার দিয়ে আমাকে রিলিজ দিলে যেতে পারব, এটা কর্তৃপক্ষের ব্যাপার। কর্তৃপক্ষ আমাকে যেখানে যতদিন রাখবে, সেখানে ততদিনই থাকব। কোনো পক্ষপাতিত্ব করার প্রশ্নই আসে না। যে পক্ষ থেকে অভিযোগ আসছে, আমরা সেগুলোই আমলে নিচ্ছি। একটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার জন্য আমার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করছি মাত্র।

জানা গেছে, ২০২৩ সালের ১১ জানুয়ারি বালিয়াকান্দিতে রফিকুল ইসলাম উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে যোগদান করেন। চলতি বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি তাকে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব হিসেবে বদলি করা হয়। তবুও তিনি (ইউএনও) বিশেষ ক্ষমতায় বর্তমানে বালিয়াকান্দি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। অভিযোগ আছে, বিগত কয়েক মাস এই উপজেলায় নতুন কোনো ইউএনওর পদায়ন দেয়া হয়নি। স্থানীয় ভোটারদের অভিযোগ, বদলির আদেশ জারি হওয়ার পরও ইউএনও মো. রফিকুল ইসলামকে যেতে দেয়া হচ্ছে না মন্ত্রীর ভাইকে জিতিয়ে আনতে হবে বলে। তা না হলে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব পদে প্রায় তিন মাস আগে বদলির আদেশ হলেও তিনি বালিয়াকান্দিতে কী করছেন, কেন নতুন কর্মস্থলে যাচ্ছেন না! বালিয়াকান্দিতে ইউএনওর থেকে যাওয়াকে নির্বাচনি বিশেষ কৌশল হিসেবে দেখছেন এলাকার ভোটাররা। 

এদিকে বালিয়াকান্দিতে কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে আদেশাধীন ইউএনও কাবেরী রায়কে পদায়ন করা হয় গত ৭ মে। ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ের প্রজ্ঞাপনে জনস্বার্থে জারিকৃত আদেশে তাকে বালিয়াকান্দিতে পদায়ন করা হয়। একই দিন তাকে কর্মস্থল থেকে অবমুক্ত করা হয় বলেও প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়। তবে গত ১২ মে জানা যায়, ইউএনও কাবেরী রায়ের পদায়ন ওইদিনই (৭ মে) বাতিল করা হয়; নতুন রিলিজের সময় বাড়িয়ে ১৯ মে করা হয়। তিনি নতুন কর্মস্থলে যোগ দেননি। কাবেরী রায়ের পদায়নের আদেশ বাতিল করা নিয়ে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে ভোটারদের মাঝে। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজবাড়ীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ও রিটার্নিং অফিসার মোরশেদা খাতুন আমার সংবাদকে বলেন, আমরা একটি অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে। গত ৭ মে ইউএনও কাবেরী রায়ের পদায়ন বালিয়াকান্দিতে হয়েছে— এ বিষয়ে জানতে চাইলে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক বলেন, নতুন ইউএনওর পদায়ন ওইদিনই বাতিল করে তার রিলিজটা পেছানো হয়েছে। অদ্যাবধি ইউএনও রফিকুল ইসলাম সহকারী রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করছেন। কেন পদায়ন করে আবার বাতিল করা হলো জানতে চাইলে বিষয়টি এড়িয়ে যান তিনি।

নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান আমার সংবাদকে বলেন, নির্বাচনকালীন নির্দিষ্ট সময়ে প্রশাসনিক পদে কাউকে বদলি করতে হলে নির্বাচন কমিশনের অনুমতি লাগবে। বদলি হওয়া কেউ যদি বদলিকৃত কর্মস্থলে চলে আসেন, তাহলে বর্তমানে পদে থাকা ব্যক্তিকে তার স্থান ছেড়ে দিতে হবে। নির্বাচনে পক্ষপাতিত্ব করার অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, প্রশাসনিক পদে থেকে নির্বাচনে পক্ষপাতিত্ব করার সুযোগ নেই। এ বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো অভিযোগ এলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। 

জানতে চাইলে গবেষক ও সাবেক সচিব একেএম আবদুল আউয়াল মজুমদার আমার সংবাদকে বলেন, নির্বাচনি সময়কাল ঘোষণা হলে নির্বাচন কমিশনের অনুমতি ছাড়া কাউকে বদলি করা যাবে না। তবুও কাউকে বদলি করা হলে নির্বাচন কমিশন চাইলে তার বদলির বাতিল করতে পারে। তিনি বলেন, নির্বাচনকালীন সময়ে বদলি একটি স্পর্শকাতর বিষয়। এ সময় অনেক কিছু চিন্তা-ভাবনা করে বদলির আদেশ দিতে হয়। যদি কোনো কারণে বদলির আদেশ দেয়ার পর বাতিল করা হয়, তাহলে সেটিকে প্রশাসনিক দুর্বলতা হিসেবেই দেখা হয়। এখানে প্রশাসনের দুর্বলতাই প্রকাশ পায়। অনেক সময় প্রশাসনের বিরুদ্ধে নির্বাচনে পক্ষপাতিত্ব করার অভিযোগ উঠলেও এসব অভিযোগের সত্যতা যাচাই করতে হবে।