দেশে ৪৭ শতাংশ বিদ্যুৎ সংযোগকালেই (২০০৯ সাল) রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণ করে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার। সে সময় দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন হতো চার হাজার ৯০০ মেগাওয়াট। আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারেও ছিল ২০২১ সালের মধ্যেই শতভাগ বিদ্যুতায়ন নিশ্চিত করা। যদিও করোনা মহামারির কারণে সেটি সম্ভব হয় পরের বছর, ২০২২ সালে। বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতাও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার ২৭৭ মেগাওয়াটে (ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ)।
এ হিসাবে বর্তমান সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের পর গত ১৫ বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা বেড়েছে ২৫ হাজার ৩৩৫ মেগাওয়াট, যা সরকারের সবকটি বড় সাফল্যের মধ্যে অন্যতম একটি। ইশতেহার অনুযায়ী দেশের প্রতিটি ঘরই বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত করা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বড় অর্জন। আর এই অর্জনের মধ্য দিয়েই গত ১৫ বছরে ব্যাপক উন্নতি হয়েছে আর্থ-সামাজিক অবস্থার; বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে। শতভাগ বিদ্যুৎ সংযোগ আর বিদ্যুৎ উৎপদান ক্ষমতা বৃদ্ধির ফলেই আজ গ্রামের মানুষ হয়েছে স্বাবলম্বী, পেয়েছে কাজের সন্ধান।
সম্প্রতি জাতীয় সংসদে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, বর্তমানে দেশে বিদ্যুতের চাহিদার চেয়েও উৎপাদন ক্ষমতা বেশি। কারণ বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে দায়িত্ব গ্রহণের পর বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে তাৎক্ষণিক, স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করে নিবিড় তদারকির মাধ্যমে বাস্তবায়নও করে যাচ্ছে। জানুয়ারি ২০০৯ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ২৬ হাজার ২৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। ফলে বিদ্যুতের স্থাপিত ক্ষমতা ক্যাপটিভসহ ৩০ হাজার ২৭৭ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। তিনি বলেন, চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতায় ঘাটতি না থাকলেও কোভিড-১৯ মহামারি-পরবর্তী ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ ও বৈশ্বিক জ্বালানি সংকটের কারণে পরিপূর্ণ সক্ষমতায় বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে না। ফলে কিছু কিছু স্থানে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহে সাময়িক অসুবিধা হচ্ছে। এছাড়া অত্যধিক গরম ও দেশের কোথাও কোথাও দাবদাহ থাকায় বিদ্যুতের চাহিদা ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় উৎপাদন বৃদ্ধির ওপরও জোর দেয়া হচ্ছে। অচিরেই নিরবচ্ছিন্ন ও মানসম্মত বিদ্যুৎ সুবিধা পৌঁছে দিতে সক্ষম হবো আমরা।
এদিকে দেশের ইতিহাসে চলতি বছরের ৩০ এপ্রিল সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদনের নতুন মাইলফলক স্থাপন করেছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিউবো)। এক মাসে পরপর তিনবার সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদনের অনন্য রেকর্ড গড়ে সংস্থাটি। এর মধ্যে ৩০ এপ্রিল রাত ৯টায় সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড হয় ১৬ হাজার ৪৭৭ মেগাওয়াট। যার ফলে দেশের ৫৪ বছরের ইতিহাসে বিদ্যুৎ উৎপাদনে তৈরি হয়েছে নতুন রেকর্ড। গেলো দাবদাহে জনজীবনে স্বস্তি বজায় রাখতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিউবোর নিরলস পরিশ্রমের ফল এটি। ২২ এপ্রিল রাত ৯টায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড ছিল ১৬ হাজার ২৩৩ মেগাওয়াট। এর আগে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড ছিল ২১ এপ্রিল রাত ৯টায় ১৫ হাজার ৬৬৬ মেগাওয়াট। তার আগে গত বছরের ১৯ এপ্রিল এই রেকর্ড ছিল ১৬ হাজার ৬৪৮ মেগাওয়াট।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের একাধিক কর্মকর্তা জানান, বর্তমান চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমানের সার্বিক ও সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধানে দাবদাহ চলাকালীন সময়েও বিদ্যুৎ সরবরাহ ছিল নিরবচ্ছিন্ন। যার ফলে দাবদাহের মধ্যেই এক মাসে তিনবার বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড গড়া সম্ভব হয়েছে। বিউবোর কর্মকর্তারা আরও বলছেন, আরেকটি দাবদাহের সম্মুখীন হতে পারে দেশের মানুষ। যদিও আসন্ন দাবদাহের বিষয়টি কেবলই আবহাওয়া অধিদপ্তরের অনুমান; তবুও আমরা আশা করছি তেমন কোনো প্রভাব পড়বে না। যেহেতু ইতোমধ্যেই আমরা সর্বোচ্চ দাবদাহ মোকাবিলা করেছি, সেহেতু আসন্ন স্বল্পমাত্রার দাবদাহও আমরা সফলভাবেই মোকাবিলা করতে সক্ষম হবো। তাছাড়া আসন্ন দাবদাহের বিষয়ে বিউবোর চেয়ারম্যানও পরিকল্পনা করে রেখেছেন। তারা বলছেন, যেহেতু উন্নয়নের পূর্ব শর্ত বিদ্যুৎ, সেহেতু ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে, সে লক্ষ্য অর্জনেই এখন বিউবো চেয়ারম্যান বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে যাচ্ছেন।
২০০৯ সালে বর্তমান সরকারের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণের পর অদ্যাবধি বিদ্যুৎ খাতের তুলনামূলক অগ্রগতির বিষয়ে দৈনিক আমার সংবাদকে বিউবো সূত্র জানায়, তৎকালে দেশে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ছিল মাত্র ২৭টি। বর্তমানে এসব কেন্দ্রের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১৪৫টি। অর্থাৎ গত ১৫ বছরে বিদ্যুৎকেন্দ্র বেড়েছে ১১৮টিরও বেশি। সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন (৬ জানুয়ারি ২০০৯) ছিল তিন হাজার ২৬৮ মেগাওয়াট; বর্তমানে (৩০ এপ্রিল ২০২৪ পর্যন্ত) ১৬ হাজার ৪৭৭ মেগাওয়াট। গত ১৫ বছরে যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ২০৯ মেগাওয়াটেরও বেশি। মোট সঞ্চালন লাইন ছিল আট হাজার সা. কিমি; বর্তমানে ১৫ হাজার ৪৫৭ সা. কিমি।
গত ১৫ বছরে যা বেড়েছে সাত হাজার ৩৫৭ সা. কিমিরও বেশি। গ্রিড সাব-স্টেশনের ক্ষমতা ছিল ১৫ হাজার ৮৭০ এমভিএ; বর্তমানে ৬৮ হাজার ৫৬৪ এমভিএ। ১৫ বছরে যা বেড়েছে ৫২ হাজার ৬৯৪ এমভিএ। তৎকালে বিদ্যুৎ আমদানি ছিল শূন্যের কোঠায়, বর্তমানে দুই হাজার ৬৫৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি হচ্ছে। বিদ্যুতায়িত বিতরণ লাইন ছিল দুই লাখ ৬০ হাজার কিলোমিটার, বর্তমানে (৩০ জুন ২০২৩ পর্যন্ত) ছয় লাখ ৪৩ হাজার ১৬৭.৫৪ কিলোমিটার। ১৫ বছরে এক্ষেত্রে বেড়েছে তিন লাখ ৮৩ হাজার ১৬৭.৫৪ কিলোমিটারেরও বেশি। বিদ্যুৎ সুবিধাপ্রাপ্ত জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল ৪৭ শতাংশ; বর্তমানে এই সংখ্যা শতভাগ।
ঘণ্টায় মাথাপিছু বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিল ২২০ কিলোওয়াট; বর্তমানে ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ (২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত) ৬০২ কিলোওয়াট। ১৫ বছরে মাথাপিছু উৎপাদন বেড়েছে ৩৮২ কিলোওয়াট। বিদ্যুৎ গ্রাহকের সংখ্যা ছিল এক কোটি আট লাখ; বর্তমানে চার কোটি ৭০ লাখ। ১৫ বছরে গ্রাহক বেড়েছে তিন কোটি ৬২ লাখ। সেচ সংযোগের সংখ্যা ছিল দুই লাখ ৩৪ হাজার; বর্তমানে চার লাখ ৮৭ হাজার। ১৫ বছরে এই সংখ্যা বেড়েছে দুই লাখ ৫৩ হাজার। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে বিতরণ সিস্টেমলস ছিল ১৪.৩৩ শতাংশ; ২০২২-২৩ অর্থবছর নাগাদ তা কমে দাঁড়িয়েছে ৭.৬৫ শতাংশে। বিগত ১৫ বছরে কমেছে ৬.৬৮ শতাংশ।
বিদ্যুৎসেবার মান বৃদ্ধির বিষয়ে প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, জনগণের নিরাপত্তা, বিদ্যুৎ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন এবং সুষ্ঠু ও মানসম্মত বিদ্যুৎ সরবরাহের লক্ষ্যে দেশের মেট্রোপলিটনসহ অন্যান্য এলাকায় ভূগর্ভস্থ লাইন ও ভূগর্ভস্থ সাব-স্টেশন নির্মাণের কাজ চলছে। ইতোমধ্যে প্রায় দুই হাজার ৭৭০ কিলোমিটার ভূগর্ভস্থ লাইন নির্মাণকাজ সম্পন্নও হয়েছে। আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে ডিপিডিসি ও ডেসকো এলাকায় যথাক্রমে ৮৫৫ কিলোমিটার ও ২৫০ কিলোমিটার ভূগর্ভস্থ বিতরণ লাইন স্থাপনে কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। সেবার মান বৃদ্ধির এসব কার্যক্রম শেষে বিদ্যুৎ বিতরণ লাইনসমূহে ঝুলন্ত তারের সমস্যাও নিরসন হবে বলে আশা করছেন তিনি।