- সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেটে ১১ স্থায়ী দোকান
- টিএসসির গোলচত্বরে ৯ দোকান
- নারী ধূমপায়ীদের সংখ্যা প্রায় ২০ শতাংশ
- ঢাবির পাঁচ হলে বিক্রি হয় সিগারেট
রাষ্ট্রের সদিচ্ছা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একার পক্ষে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়
—ড. তৌহিদুল হক, সহযোগী অধ্যাপক, ঢাবি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে (ঢাবি) বলা হয় প্রাচ্যের অক্সফোর্ড। আর এখানেই হরহামেশাই ধূমপান করতে দেখা যায় শিক্ষার্থীদের। অবস্থা এমন যে, এখন ঢাবির টিএসসিকে ধূমপানের নিরাপদ জায়গা মনে করেন অনেকে। শুধু ঢাবির শিক্ষার্থীরাই নন অনেক নারী এই এলাকায় আসেন সিগারেট সেবনের জন্য। সিগারেট বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে প্রাপ্ত তথ্য বলছে, এ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় মাসে সিগারেট বিক্রি হয় কোটি টাকারও বেশি। ঢাবিতে সিগারেট সেবন করেন এমন বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয় আমার সংবাদের এ প্রতিবেদকের। এর মধ্যে একজন সানজিদা বেগম (ছদ্ম নাম)। তিনি রাজধানীর নবকুমার ইনস্টিটিউটের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী। এক বান্ধবীসহ সিগারেট সেবনের জন্য টিএসসিতে এসেছিলেন। নিয়মিত সিগারেট সেবন না করলেও প্রায় বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে সিগারেট সেবনের জন্য আসেন টিএসসি।
এছাড়াও কথা হয় বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজির আরেক নারী শিক্ষার্থীর সঙ্গে। তিনি বলেন, অন্য কোথাও নারীরা সিগারেট সেবন করলে অনেকে চোখ বড় বড় করে তাকায়। নানা কথা বলে। কিন্তু এখানে সবাই সমান, কেউ কাউকে কিছু বলে না। যার যা ইচ্ছা তাই করে। তাই সিগারেট সেবনের জন্য নিয়মিত টিএসসি আসেন তিনি। শুধু নারীরা নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই নন, এমন বহিরাগত বহু শিক্ষার্থী ও কর্মজীবী টিএসসি আসেন বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে সিগারেট সেবনের জন্য।
সিগারেট কতটুকু ক্ষতি করে, জানতে চাইলে তানজিনা নামে সোহরাওয়ার্দী কলেজের এক নারী শিক্ষার্থী বলেন, জানি এটি ক্ষতি করে। পুরুষের তুলনায় নারীদের বেশি ক্ষতি করে। নারীদের হরমোনাল কিছু বিষয় থাকে। কিন্তু এসব জানলেও ছাড়তে পারছি না। আজ ছাড়ব, কাল ছাড়ব বলে হয়ে উঠে না। ৩০ বছর ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট্রাল লাইব্রেরির সামনে সিগারেট বিক্রি আসছেন জাকির হোসেন (৫০)। প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকার আবার কখনো কখনো ২০ হাজার টাকারও বেশি সিগারেট বিক্রি হয় তার। তার পাশে আরেক ব্যবসায়ী মো. সেলিম (৪২)। তিনিও ২৭ বছর ধরে ঢাবির সেন্ট্রাল লাইব্রেরির সামনে সিগারেট বিক্রি করে আসছেন। তারও প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকার সিগারেট বিক্রি হয়।
এছাড়া টিএসটির গোল চত্বরে রয়েছে ৯টি স্থায়ী সিগারেট বিক্রি দোকান। যে দোকানগুলোতে প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ হাজার টাকার সিগারেট বিক্রি হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচটি হলে বিক্রি হয় সিগারেট। এর মধ্যে হাজী মোহাম্মদ মুহসিন হলের তিনটি দোকানে প্রতিদিন প্রায় ১৪ হাজার, কবি জসীমউদ্দিন হলের দুটি দোকানে ১১ হাজার, সূর্য সেন হলের দুটি দোকানে আট হাজার, শহীদুল্লাহ হলের একটি দোকানে সাত হাজার, ফজলুল হক মুসলিম হলের দুটি দোকানে পাঁচ হাজার টাকার সিগারেট বিক্রি হয়। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্থায়ী সিগারেট বিক্রির দোকান রয়েছে ১১টি। এখানকার অন্যতম সিগারেট বিক্রেতা মো. কবির হোসেন (৫০)। ২০০১ সাল থেকে সিগারেট বিক্রি করে আসছেন তিনি। প্রতিদিন ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকার সিগারেট বিক্রি হয় তার। এই উদ্যানের গেটের আরেক পাশে সিগারেট বিক্রি করেন মো. হাসান (৫৮)। তিনি জানান, প্রতিদিন ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকার সিগারেট বিক্রি হয় তার। এছাড়া এখানকার বাকি দোকানগুলোতেও প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকার সিগারেট বিক্রি হয়।
এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ভ্রাম্যমাণ হকার বা বিক্রেতা রয়েছে ৫০ জনের অধিক। এদের বেশ কয়েকজনের সাথে কথা হয় আমাদের। তাদের বেশির ভাগ হকারই প্রতিদিন তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকার সিগারেট বিক্রি করেন। শাকিল (১৮) নামে এক ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতার রং চায়ের পাশাপাশি প্রতিদিন তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকার সিগারেট বিক্রি করেন। শাকিল জানান, ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতারা প্রায় প্রত্যেকে প্রতিদিন এই রকম পরিমাণের সিগারেট বিক্রি করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সিগারেটের পেছনে ব্যয়কৃত টাকা কোথায় থেকে আসে, এটি জানতে চাই আমরা।
এ বিষয়ে জিয়াউর রহমান হলের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সৌরভ বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে বন্ধুদের সাথে মিশে কৌতূহলবশত সিগারেট খাওয়া শুরু করি, পরবর্তীতে সিগারেটের প্রতি অন্যরকম একটা নেশা কাজ করে। এখন প্রতিদিন সর্বনিম্ন ১৫টা গোল্ডলিফ সিগারেট খায়। প্রতিমাসে প্রায় চার-পাঁচ হাজার টাকা সিগারেটের পেছনে ব্যয় হয়। আমার কোনো ইনকাম নেই, আমার সব খরচ পরিবার বহন করে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সূর্যসেন হলের তৃতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী বলেন, হাইস্কুল জীবনে বিড়ি খেতাম, কলেজে পদার্পণ করে সিগারেট খাওয়া শুরু করেছি। ক্যাম্পাসে আসার পর সিগারেট খাওয়ার মাত্রা অনেকগুণ বেড়ে গেছে। প্রতিদিন ১৫টা লাকি স্টাইক খাওয়া হয়। আনুমানিক মাসে চার হাজার টাকা সিগারেট খাওয়ার পেছনে ব্যয় হয়। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন প্রোগামে অংশগ্রহণ করে টাকা উপার্জন করি। সেই টাকা দিয়ে সিগারেট খাই। বিজয় একাত্তর হলের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের এক শিক্ষার্থী বলেন, দশম শ্রেণি থেকে সিগারেট খাই। এখন দিনে ৯-১০টা সিগারেট খাওয়া হয়। মাসে দু-তিন হাজার টাকার সিগারেট লাগে। পরিবার থেকে যে টাকা দেয়, সে টাকা থেকে কিছু টাকা বাচিয়ে সিগারেট খাই। নাম প্রকাশ না করার শর্তে জিয়া হলের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, সকালে সিগারেট না খেলে বাথরুম হয় না, মন স্থির থাকে না। এমনও হয়েছে যে, পরীক্ষা হলে পরীক্ষা দেয়ার সময় তিন ঘণ্টায় তিনবার সিগারেট খাওয়ার জন্য বের হয়েছি, তারপর ওয়াশরুমে গিয়ে সিগারেট খেয়েছি। মাসে প্রায় পাঁচ হাজার টাকার সিগারেট লাগে।
কবি জসিমউদদীন হলের চতুর্থ বর্ষের এক শিক্ষার্থী বলেন, গোল্ডলিপ এবং সুইচ সিগারেট সবচেয়ে বেশি খাই, প্রত্যেক মাসে তিন হাজার টাকার সিগারেট লাগে। পরিবার যে টাকা দেয়, সে টাকা দিয়ে ক্যাম্পাসে খাওয়া দাওয়া চলাফেরা করতেই খরচ হয়ে যায়। তাই টিউশনের টাকা দিয়ে সিগারেটের খরচ বহন করি। বাংলাদেশকে ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত দেশ হিসেবে তৈরির ভিশন নিয়েছেন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১০০ মিটারের মধ্যে সিগারেট বিক্রি করা যাবে না। প্রকাশ্যে এটি সেবন দণ্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু এসবের বালাই নেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ কল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, ধূমপান যে মাদকের একটি অংশ এটি শিক্ষার্থীদের মাঝে আমরা এখনো তুলে ধরতে পারিনি। আর তামাক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কাজ করছে না ঠিক এমনও নয়। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চাইলেও অনেক কিছু করতে পারে না। এটি বন্ধ করতে চাইলে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ এটি নিয়ে প্রতিবাদ করে এবং তারা বলছে তাদের অধিকার হরণ করা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাদের ব্যক্তিগত জীবনে হস্তক্ষেপ করছে। একজন শিক্ষার্থী ব্যক্তিগত জীবনে কি করবে তা বিশ্ববিদ্যালয় ঠিক করে দেয়ার কেউ নন, এমন প্রতিবাদ করেন শিক্ষার্থীরা।
তিনি আরও বলেন, সিগারেট দিয়ে শুরু করলেও অনেকে ধীরে ধীরে মাদকের দিকে দাবিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এই রকম একটি চক্র রয়েছে যারা সিগারেটের আড়ালে মূলত মাদককে টিকিয়ে রাখতে কাজ করে। তারা প্রকাশ্যে বিষয়টি নিয়ে প্রতিবাদ না করলেও সিগারেট বা মাদকে আসক্ত শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। সিগারেট বিক্রি করতে না দিলে ভিন্ন রকম পরিবেশ সৃষ্টি হবে নানা সময় ইঙ্গিত দেয় কিছু মহল। তাই প্রকাশ্যে বিক্রি হলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তার মতো করে কাজ করতে পারছে না।
ঢাবির এ শিক্ষক আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের একার পক্ষে সম্ভব নয়, প্রয়োজন রাষ্ট্রের সদিচ্ছা, জনকল্যাণে রাষ্ট্রের আইনের সর্বোচ্চ ব্যবহার ও তামাক নিয়ন্ত্রণের আইন যথাযথ বাস্তবায়ন। তাহলেই এটি নিরসন সম্ভব হবে। না হয় এটি সম্ভব বলে খুব একটা আশা দেখছেন না। যদিও বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবসে এবারের প্রতিপাদ্য বিষয়, ‘তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ প্রতিহত করি, শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করি।’ এটি কতটুকু নিশ্চিত করা যায় সেটি এখন দেখার বিষয়।