নানা অনিয়মের অভািযোগ মাথায় নিয়ে এনআরবি ইসলামিক লাইফের মূখ্য নির্বাহির পদ থেকে বিদায় নিতে হয়েছে শাহ জামাল হাওলাদারকে। গত বুধবার কোম্পানির বোর্ড সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক তাকে সিইওর পদ থেকে অব্যহতি দেয়া হয়। অভিজ্ঞতার বিষয়ে মিথ্যা তথ্য দিয়ে এনআরবি ইসলামিক লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ অনুমোদন নিয়েছিলেন তিনি। এছাড়াও পূর্ববর্তী কর্মস্থলগুলো তাকে ছাড়পত্র দেয়নি। অর্থ আত্মসাতের সুনির্দিষ্ট অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। অনিয়মের এই বিস্তর তথ্য আড়াল করেই তিনি মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা পদে নিয়োগ নেওয়ার আবেদন করেছিলেন বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) এর কাছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগের ব্যাপারে জানা সত্ত্বেও যাচাই-বাছাই ছাড়াই তাকে নিয়োগ প্রদান করে নিয়ন্ত্রণ সংস্থাটি।
২০২১ সালে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) এনআরবি ইসলামিক লাইফের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ অনুমোদন দেন শাহ জামাল হাওলাদারকে। তখন নিয়োগ অনুমোদনে সর্বসাকুল্যে বেতন-ভাতা নির্ধারণ করা হয় আড়াই লাখ টাকা। নিয়োগ অনুমোদনের শর্ত ভঙ্গ করে তিনি প্রায় দ্বিগুণ বেতন-ভাতা নিয়েছেন।
এদিকে বিগত ৩ বছরে ব্যবসায়িক পারফর্ম্যান্স খারাপ হওয়া সত্ত্বেও দ্বিগুণ বেতন-ভাতা নির্ধারণ করে পুনরায় শাহ জামাল হাওলাদারের নিয়োগ নবায়নের আবেদন করেছিল এনআরবি ইসলামিক লাইফ কর্তৃপক্ষ। কোম্পানিটির ভাইস
চেয়ারম্যান এম মাহফুজুর রহমান গত ১৮ এপ্রিল এই আবেদন পাঠান কর্তৃপক্ষে। সর্বশেষ কোম্পানির ১৬তম বোর্ড সভায় তার নিয়োগ নবায়নের অনুমোদন দেয়া হয়। কোম্পানির বোর্ড সভায় তার নিয়োগ অনুমোদন দেওয়া হলেও অনুমোদন মঞ্চুর করেনি বিমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। বিমা আইন অনুযায়ী মূখ্য নির্বাহির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদন ব্যতিত তার দায়িত্ব পালনের কোনো অনুমতি নেই। কিন্তু মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও বিমা আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দীর্ঘদিন বহাল ছিলেন স্ব-পদে।
আমার সংবাদের অনুসন্ধানে শাহ জামাল হাওলাদারের অনিয়মের নানা তথ্য উঠে আসে এবং তা নিয়ে দুইপর্বের প্রতিবেদন প্রকাশের পর নরেচরে বসে বিমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। গত ১৮ এপ্রিল এনআরবি কর্তৃপক্ষ শাহ জামাল হাওলাদারকে সিইও হিসেবে পুনঃনিয়োগের জন্য আইডিআরএ’তে আবেদন করলেও তা না মঞ্জুর করে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। যার ফলে এক প্রকার বাধ্য হয়ে গত বুধবার (২৯ মে) কোম্পানিটির বোর্ড সভায় মূখ্য নির্বাহীর পদ থেকে শাহ জামাল হাওলাদারকে অব্যহতি প্রদান করে।
একইসভা থেকে বীমা অধিদপ্তরের সাবেক ডেপুটি কন্ট্রোলার মিজানুর রহমানকে এনআরবি ইসলামিক লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ভারপ্রাপ্ত মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) পদে দায়িত্ব দেওয়া হয়। মিজানুর রহমান ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি এনআরবি ইসলামিক লাইফ ইন্স্যুরেন্সের কনসালটেন্ট হিসেবে যোগদান করেন। বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। মিজানুর রহমান ১৯৯৪ সালে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে বীমা অধিদপ্তরে প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন। পরবর্তীতে উপ-বীমা নিয়ন্ত্রক হিসেবে পদোন্নতি পান এবং ২০০৪ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত তিনি এ পদে দায়িত্ব পালন করেন।
কেন সরতে হলো শাহ জামাল হাওলাদারকে। প্রকৃতপক্ষে তিনি এনআরবি ইসলামিক লাইফের মুখ্য নির্বাহী পদে নিয়োগ অনুমোদন পেতে কর্ম অভিজ্ঞতার বিষয়ে মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন। পেশাজীবনে মুখ্য নির্বাহীর অব্যবহিত নিম্নপদে কোন বীমা কোম্পানিতেই চাকরি করেননি, অথচ মুখ্য নির্বাহীর অব্যবহিত নিম্নপদে চাকরির একাধিক সদন দাখিল করেছেন তিনি। শাহ জামাল হাওলাদার উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে সর্বশেষ চাকরি করেছেন বেস্ট লাইফে। এর আগে চাকরি করেছেন প্রোটেক্টিভ ইসলামী লাইফে, সিনিয়র উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে। দু’টি কোম্পানির একটিও তাকে ছাড়পত্র দেয়নি। অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন ও সাময়িক অব্যাহতির নোটিশ দেয়ার পরই প্রোটেক্টিভ ইসলামী লাইফ থেকে পদত্যাগ করেন শাহ জামাল।
প্রোটেক্টি ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ১৩ লাখ টাকা প্রিমিয়াম আত্মসাতের অভিযোগ ২০২০ সালের ১৭ জুন তাকে বহিষ্কার করা হয়। ওই দিনই তিনি কোম্পানি থেকে পদত্যাগের জন্য পত্র জমা দেন। তবে পদত্যাগ কার্যকরের আবেদন করেন ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ থেকে। প্রোটেক্টিভ ইসলামী লাইফ থেকে শাহ জামালের বিরুদ্ধে ৫টি অভিযোগ আনা হয়। এর মধ্যে রয়েছে- নরসিংদী অফিস থেকে ৮ লাখ ৬০ হাজার ৩৭৪ টাকা হিসাবের গড়মিল; দু’জন ড্রাইভার নিয়োগ দেখিয়ে বেতন-ভাতা উত্তোলন করলেও বাস্তবে কোন ড্রাইভারের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি; ক্যাশিয়ারের বেতন বাবদ টাকা উত্তোলন করা হলেও কোন ক্যাশিয়ার নিয়োগ দেয়া হয়নি; ভোলা ব্রাঞ্চের গ্রাহকদের কাছ থেকে নেয়া প্রিমিয়ামের ১৩ লাখ টাকা কোম্পানির একাউন্টে জমা দেয়া হয়নি; মতিঝিল শাখায় ২৭ নভেম্বর ২০১৯ তারিখে পিআর কেটে কোম্পানির একাউন্টে টাকা জমা করা হয় পরের বছরের জুন মাসে, যা বীমা আইনের লঙ্ঘন।
শাহ জামালের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অর্থ আত্মসাতের এসব অভিযোগের প্রেক্ষিতে তাকে কারণ দর্শানো ও দায়িত্ব থেকে সাময়িক অব্যাহিত প্রদানের নোটিশে স্বাক্ষর করেন প্রোটেক্টিভ ইসলামী লাইফের তৎকালীন মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইউসুফ আলী মৃধা। পেইড আপ ক্যাপিটালের চেয়ে বিনিয়োগ কম, খরচ হয়েছে গ্রাহকের সব টাকা আইডিআরএ র মূলধন সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদন থেকে জানায় যায়, এনআরবি ইসলামিক লাইফ অনুমোদন পায় ২০২১ সালের ৬ মে।
অনুমোদনের পর থেকে ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩ বছরে সর্বমোট প্রিমিয়াম আয় করে ৭৮ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে ব্যয় করে ৬১ কোটি ৭১ লাখ টাকা। এই হিসেবে ব্যবসার আয় থেকে ব্যয় বাদ দিলে কোম্পানিটিতে উদ্বৃত্ত টাকা থাকে ১৭ কোটি ৮ লাখ টাকা। হিসাব অনুসারে এই উদ্বৃত্ত ১৭ কোটি ৮ লাখ টাকা বিনিয়োগ থাকার কথা। অথচ আইডিআরএ’র মূলধন সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদন অনুসারে ৩১ ডিসেম্বরে ২০২৩ সাল পর্যন্ত কোম্পানিটির প্রিমিয়াম আয় থেকে বিনিয়োগ রয়েছে ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। আর মোট বিনিয়োগ রয়েছে ১৬ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। যার মধ্যে মূলধন থেকে বিনিয়োগ আছে ১২ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। আর সিকিউরিটিজ বন্ডে বিনিয়োগ আছে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। অপর দিকে কোম্পানির পেইড-আপ ক্যাপিটাল ১৮ কোটি টাকা। এই হিসেবে পেইড-আপ ক্যাপিটালের চেয়ে বিনিয়োগ কম আছে ২ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। অর্থাৎ গ্রাহকের কাছ থেকে প্রিমিয়াম আয়ের প্রায় সব টাকাই খরচ করে ফেলেছে।