জ্বালানি ও পানির মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত

বাড়ছে ব্যয় জনমনে অসন্তোষ

সৈয়দ সাইফুল ইসলাম প্রকাশিত: জুন ৩, ২০২৪, ১২:৫৪ এএম
বাড়ছে ব্যয় জনমনে অসন্তোষ

জ্বালানি ও পানির দাম বাড়ানোয় জনজীবনে দারুণভাবে আর্থিক কষ্ট দেখা দেবে —ক্যাব

যাদের হাতে প্রচুর পয়সাপাতি রয়েছে, তাদের কথা ভিন্ন; কিন্তু যারা দিনমজুর, পোশাকশ্রমিক, রিকশাশ্রমিক, ভ্যান ও ঠেলাওয়ালা, সড়ক-মহাসড়কে ভাসমান ছোট ব্যবসায়ী, অর্থাৎ এদের মতো স্বল্প আয়ের লোকেরা যখন আয়-ব্যয়ের সমন্বয়হীনতায় অস্থিরতার মধ্যে জীবনযাপন করছেন, তখন আবার জ্বালানি মূল্য বৃদ্ধির খড়গ নেমে আসে। শুধু কি তা-ই? একইসঙ্গে ঢাকা ওয়াসার আওতাধীন নাগরিকদের জন্য রয়েছে আরও একটি দুঃসংবাদ। এই নাগরিকদের জুলাই মাস থেকে গুনতে হবে অন্তত ১০ শতাংশ বাড়তি পানির বিল। সর্বশেষ যখন পানির মূল্য বাড়ানো হয়েছিল, সেটি ছিল আগের মূল্যের চেয়ে ৫ শতাংশ বেশি। কিন্তু জুলাইয়ে মূল্য বাড়ছে কমপক্ষে ১০ শতাংশ। যারা জ্বালানি ও পানির মতো অতিপ্রয়োজনীয় পরিষেবাগুলোর মূল্য বাড়াচ্ছেন, তারা অবশ্য মূল্য বৃদ্ধির যৌক্তিকতাও তুলে ধরছেন। কিন্তু যারা এসব বর্ধিত মূল্য পরিশোধে বাধ্য হচ্ছেন, তাদের বেশিরভাগেরই সামর্থ্য নেই।

এমনিতেই দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়া ছুটছে দুুর্বার গতিতে। নতুন মন্ত্রিপরিষদ গঠন হওয়ার পরই সরকার দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে সিরিয়াস হয়েছে। বেশকিছু পণ্যের বিক্রিমূল্য নির্ধারণও করে দিয়েছিল। এতে কিছু পণ্যমূল্য সরকারের বেঁধে দেয়া মূল্যের মধ্যে বিক্রি হলেও অধিকাংশ পণ্যই বিক্রি হয়েছে ব্যবসায়ীদের ইচ্ছামাফিক। গত ১৫ মার্চ ২৯টি নিত্যপণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছিল সরকার। সরকারি ওই বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী বাজারে এক কেজি গোল আলু কিনতে পাওয়ার কথা ২৮ টাকা ৫৫ পয়সায়; কিন্তু গতকাল ঢাকার প্রায় সব বাজারেই মানভেদে আলু কেজি বিক্রি হয়েছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকায়। 

মূল্য নির্ধারণ করে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের দেয়া ওই বিজ্ঞপ্তিতে ‘পরবর্তী নির্দেশনা না দেয়া পর্যন্ত’ এ মূল্যে পণ্য ব্যবসায়ীদের বেচাকেনার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছিল। কিন্তু কৃষি বিপণন অধিদপ্তর নির্ধারিত মূল্যে তেমন কিছুই কিনতে পারছেন না ভোক্তারা। ডিম প্রতিটি ১০ টাকা ৪৯ পয়সায় কিনতে পারার কথা থাকলেও বাজারে প্রতিটি ডিম (একসঙ্গে একডজন কিনলে) ১৩ টাকা ৩৩ পায়সা থেকে শুরু করে ১৪ টাকা ১৬ পায়সায় কিনতে হচ্ছে। আর খুচরা একটি ডম কিনতে হলে গুনতে হচ্ছে ১৫ টাকা। অর্থাৎ সরকারি দপ্তরের বেঁধে দেয়া মূল্যের সঙ্গে বাজারে ব্যবসায়ীদের বেঁধে দেয়া মূল্যের অনেক ব্যবধান। একই অবস্থা ব্রয়লার মুরগির দামেও। ১৭৫ টাকায় এক কেজি ব্রয়লার মুরগি কেনার কথা থাকলেও বাজারে ব্রয়লার মুরগির দাম ২২৫ থেকে ২৪০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ বাজার পরিস্থিতি সাধারণ নাগরিকের জন্য মোটেই অনুকূলে নয়। বাজারের এই অস্থির পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ সফল হওয়ার আগে নতুন করে জ্বালানি ও পানির মূল্য বৃদ্ধি নাগরিকদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার করছে।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন শাকিল হোসাইন। গত কয়েক মাসে তার কোনো বেতন বাড়েনি; কিন্তু পূর্বের বেতনে চাকরি করেই বাড়তি দামে কিনছেন পণ্য। অফিসে যাতায়াতে মোটরসাইকেল ব্যবহার করেন তিনি। জ্বালানির দাম সমন্বয়ে অকটেনের মূল্য লিটারপ্রতি বেড়েছে আড়াই টাকা। এতে তার যাতায়াত ব্যয়ও বেড়েছে। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, জ্বালানির মূল্য বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই বাড়ে পরিবহন ব্যয়, আর এতে নিত্যপণ্যেরও মূল্য বাড়ে। ধারাবাহিকভাবে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির মধ্যে নতুন করে জ্বালানি মূল্য (বিশেষ করে ডিজেল) বৃদ্ধির কারণে বিভিন্ন জেলা ও উৎপাদন এলাকা থেকে পণ্য রাজধানী এবং বিক্রয়কেন্দ্রে পৌঁছাতে পরিবহন ভাড়া বাড়বে। আর পরিবহন ভাড়া বাড়লে সব পণ্যমূল্য আরেক দফা বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে। অর্থাৎ ভোক্তাদের জন্য কোনো সুখবরই থাকছে না।    

সরকারি এক ঘোষণায় ডিজেল ও কেরোসিনে লিটারে ৭৫ পয়সা এবং পেট্রোল ও অকটেনে ২ দশমিক ৫০ টাকা বাড়িয়ে জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় করা হয়েছে। ফলে ভোক্তা পর্যায়ে ডিজেল ও কেরোসিনের বিদ্যমান মূল্য ১০৭ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০৭ টাকা ৭৫ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। পাশাপাশি লিটারপ্রতি পেট্রোলের বিদ্যমান মূল্য ১২৪ দশমিক ৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১২৭ টাকা এবং অকটেনের বিদ্যমান মূল্য ১২৮ দশমিক ৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৩১ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। নতুন এই দর ১ জুন থেকে কার্যকরও করা হয়েছে। ডিজেল, কেরোসিন, পেট্রোল ও অকটেনের মূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে শুধু পরিবহন খাতই সম্পৃক্ত নয়, কল-কারখানার উৎপাদন ব্যয়ও বাড়বে। এছাড়া যেসব খাদ্যশস্য উৎপাদনে সেচ প্রয়োজন হয়, সেসবের উৎপাদন ব্যয়ও বাড়বে। কেননা, এই সেচকাজে জ্বালানির ব্যবহার রয়। অর্থাৎ মূল্য বৃদ্ধির এই প্রবণতায় ক্ষতির মুখে পড়বে সাধারণ মানুষ। 

এদিকে পানির দাম ১০ শতাংশ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকা ওয়াসা। গত ১৪ বছরে বিভিন্ন সময় ১৪ বার পানির দাম বাড়ানো হয়েছে। গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে ঢাকা ওয়াসা জানিয়েছে, ১০ শতাংশ এই বর্ধিত মূল্য আগামী ১ জুলাই থেকে কার্যকর হবে। ওয়াসার গণবিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ওয়াসা আইন ১৯৯৬-এর ২২ ধারা অনুযায়ী মুদ্রাস্ফীতি সমন্বয় করার লক্ষ্যে চলতি বছরের ১ জুলাই থেকে পানির মূল্য ১০ শতাংশ হারে সমন্বয় করে আবাসিক গ্রাহকদের জন্য প্রতি এক হাজার লিটার পানির দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১৬ টাকা ৭০ পয়সা, যা বর্তমানে আছে ১৫ টাকা ১৮ পয়সা। আর বাণিজ্যিক গ্রাহকদের জন্য একই পরিমাণ পানির দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৪৬ টাকা ২০ পয়সা, যা বর্তমানে আছে ৪২ টাকা। এ সিদ্ধান্ত মিটারবিহীন হোল্ডিং, গভীর নলকূপ, নির্মীয়মাণ ভবন ও ন্যূনতম বিলসহ সব ধরনের (পানি ও পয়ো) অভিকরের ক্ষেত্রেও কার্যকর হবে। ঢাকা ওয়াসা সর্বশেষ ২০২১ সালের ১ জুলাই পানি ও পয়োসেবার মূল্য ৫ শতাংশ সমন্বয় করেছিল। কিন্তু এবার এক লাফে ১০ শতাংশ বৃদ্ধি করা হলো। 

পানির এই মূল্যবৃদ্ধিকে অস্বাভাবিক বলে আখ্যা দিয়েছেন ব্যবহারকারীরা। তারা বলছেন, মানুষকে সুপেয় পানি দিতে পারছে না ঢাকা ওয়াসা, অথচ মূল্যবৃদ্ধি করছে। এটা নাগরিকদের জন্য দ্বিগুণ শাস্তি বলেও আখ্যা দিয়েছেন কেউ কেউ। 

ঢাকার মালিবাগে বসবাসকারী বেসরকারি চাকরিজীবী সাদেক মোস্তফার ভাষ্য, ওয়াসার পানি না ফুটিয়ে পান করার সুযোগ নেই। অর্থাৎ ওয়াসা যে পানি দেয়, তা পানের অযোগ্য। এ অবস্থায় ঢাকা ওয়াসার উচিত আগে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা, পরে মূল্যবৃদ্ধির চিন্তা করা। 

পানির দাম ১০ শতাংশ বাড়ানোর সিদ্ধান্তকে অন্যায্য ও অযৌক্তিক বলে তীব্র প্রতিবাদ করছে বেসরকারি সংস্থা কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। গতকাল এক বিজ্ঞপ্তিতে এ প্রতিবাদ জানিয়েছে সংগঠনটি। দুর্নীতি, অপচয় ও অব্যবস্থাপনা রোধ করলে পানির মূল্য বৃদ্ধি করা লাগবে না বলে মনে করে ক্যাব। 

সংস্থাটি বলছে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও ঊর্ধ্বমুখী মূল্যস্ফীতি এমনিতেই জনজীবনকে আর্থিকভাবে দারুণ চাপে ফেলেছে, মানুষ ভীষণ কষ্টে আছে। মূল্য সমন্বয়ের নামে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বাড়ানো হয়েছে। একই কায়দায় ঢাকা ওয়াসাও পানির দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বর্ধিত পানির দাম বহাল থাকলে জনমানুষের জীবনে ভীষণ আর্থিক কষ্টের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হবে। সেবার পরিবর্তে বাণিজ্যিক ধারায় প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা চালিয়ে, সরকারের কাছ থেকে একদিকে ভর্তুকি নিয়ে, অন্যদিকে কোম্পানির মুনাফা দেখিয়ে ঢাকা ওয়াসা যে লুণ্ঠনমূলক ব্যয় ও লুণ্ঠনমূলক মুনাফার প্রক্রিয়া তৈরি করেছে, তা যেমন অগ্রহণযোগ্য, তেমনই জনস্বার্থেরও পরিপন্থি। ক্যাব ঢাকা ওয়াসার মূল্যবৃদ্ধির এমন সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছে।