রাজধানীসহ সারা দেশে বেটিং জুয়া ও অনলাইন বাজিতে জড়িয়ে পড়ছে শিক্ষার্থীরা। মোবাইল অ্যাপসের মাধ্যমে অনলাইন জুয়া আর বেটিং সাইট ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ায় দিন দিন পড়ালেখাবিমুখ হচ্ছে তারা। লোভে পড়ে শিক্ষার্থী ও তরুণরা এই জুয়ায় বেশি আসক্ত হচ্ছে। এর সঙ্গে বাড়ছে সামাজিক অবক্ষয়। একইসঙ্গে বাড়ছে পারিবারিক অশান্তি ও দাম্পত্য কলহ। জুয়ার নেশায় বুঁদ হয়ে নিঃস্ব হচ্ছে অনেকেই।
এদিকে ফুটবল কিংবা ক্রিকেট বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এসব বাজির মাত্রা আরও বেড়ে যায়। পুলিশ প্রশাসন তৎপর থাকলেও বন্ধ হচ্ছে না এসব অনলাইন গেম ও বাজি। এ বিষয়ে বিশ্লেষকরা বলছেন, ভার্চুয়াল জুয়ায় আসক্ত হয়ে পড়ছে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। এতে আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি বাড়ছে সামাজিক অবক্ষয়। অবৈধ প্রক্রিয়ায় এই ডিজিটাল মুদ্রা কেনাবেচায় শত শত কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে দেশের বাইরে। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে দ্রুতই এই জুয়া বন্ধের আহ্বান জানান তারা।
বিভিন্ন নামে চলছে বেটিং সাইট
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বেট ৩৬৫ ডটকম, ৮৮ স্পোর্টস ডটকম, রেবটওয়ে ডটকম, বেটফ্রিড ডটকম, ডাফাবেট ডটকম, বেটফেয়ার ডটকম, ইউনিবেট ডটকম, বেট ভিক্টর ডটকম, নেটবেট ডটকম, টাইটানবেট ডটকম, উইনার ডটকম, পেডি পাওয়ার ডটকম, বাজীগর ডটকম, প্লেবেট৩৬৫ ডটকম, লগ১০ ডট লাইভ, ৯ক্রিকেট, বিডিটি১০ডটকম, বেটবি২ডটকম, বেটস্কোর২৪ ডটকম, টাকা৬৫ ডটকম, উইনস৬৫ ডটকম, জয়টি২০ ডটকম, ভিক্টর২৬ ডটকম, ৬ক্রিকেট ডটকম, ইন্ডিতা৯৬ ডটকম, লাক বেট বিডি ডটকম, ওপেন বেট ডট লাইভ, এলবিএস২৪ ডটকম, বেট উইন ৯৬ ডটকম, স্পোর্টস ৩৩৩ ডটকম ও বেট বাটার ফ্লাই ডটকমসহ এমন অর্ধশতাধিক জুয়ার অনলাইন সাইট রয়েছে। এসব বেটিং সাইটের মাধ্যমে শুধু শিক্ষার্থী নয়, সর্বস্ব হারাচ্ছে লাখো তরুণ। সে সঙ্গে অল্প টাকায় অধিক লাভের নেশায় পড়ে বিপথগামী হচ্ছেন তারা।
যেভাবে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে শিক্ষার্থীরা
তথ্য বলছে, এসব বেটিং সাইট বিটিআরসির নজরে এলে বন্ধ করা হয়। কিন্তু অত্যন্ত চালাক-চতুর হওয়ায় এসব সাইট পরিচালনাকারীরা বিদেশে বসে বন্ধ হওয়া সাইটগুলো রাতারাতি ভিন্ন ডোমেইনে হুবহু চালু করে পরিচালনা করছে। আবার কেউ কেউ ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক (ভিপিএন) ব্যবহার করেই এসব সাইটে খেলছে জুয়া। এছাড়া কিছু কিছু সাইটের অ্যাপসও রয়েছে, যা সহজে বন্ধ করা যায় না। মূলত এসব সাইটে সরাসরি কেউ অ্যাকাউন্ট খুলতে পারে না। এজন্য জুয়াড়িদের সহযোগিতায় রয়েছে বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপ। সে সঙ্গে পেইজ কিংবা ইউটিউবেও দেখানো হয় জুয়া খেলার টিউটরিয়াল। এসব গ্রুপ ও টিউটরিয়াল দেখে বাজি খেলায় উদ্বুদ্ধ হয় অসংখ্য তরুণ শিক্ষার্থী।
সর্বনাশা বেটিং জুয়া
জানা যায়, বেটিং জুয়া সমাজে এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছে যে, মোবাইল ফোনে রিচার্জের মতো এখন এসব অনলাইন জুয়ার অ্যাপসে টাকা ভরাতে হয়। এ জন্য শহর থেকে মফস্বলে রীতিমতো এজেন্ট নিয়োগ দেয়া হয়। এসব অনলাইন জুয়ার টার্গেট থাকে কীভাবে মানুষের টাকা হাতানো যায়। খুব সামান্য মানুষই এই বাজিতে জিতে যায়, যাতে এসব কোম্পানির বিনিয়োগ বড়জোর পাঁচ শতাংশ। বাকি ৯৫ শতাংশ অংশগ্রহণকারী আশায় আশায় বেট ধরে এবং হারতে হারতে সর্বস্বান্ত হয়। জুয়ায় জড়িতরা বলছেন, এসব অ্যাপসের বেশিরভাগই পরিচালনা করা হচ্ছে রাশিয়া, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকে। বাংলাদেশে এগুলোর স্থানীয় প্রতিনিধি (এজেন্ট) থাকে। বিভিন্ন জেলায় এ ধরনের অসংখ্য এজেন্ট রয়েছে। মূলত তারাই মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে জুয়ায় অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের কাছ থেকে টাকা গ্রহণ বা প্রদান করে থাকে। এজেন্টরা বিদেশি অ্যাপস পরিচালনাকারীদের কাছ থেকে হাজারে অন্তত ৪০ টাকা কমিশন পান। এছাড়া এজেন্টদের মাধ্যমেই বিদেশে টাকা পাচার হয়।
জুয়া খেলার সঙ্গে জড়িতরা যা বলছে
প্রকাশ না করার শর্তে এক কলেজশিক্ষার্থী বলেন, ফেসবুকের মাধ্যমে জানতে পারি ঘরে বসেই টাকা আয় করা যায়। এরপর একটি অ্যাকাউন্ট খুলি। প্রথমে ৫৬ টাকা বিনিয়োগ করে ১৬ হাজার টাকা পাই। এতে লোভে পড়ে এই খেলায় মারাত্মক আসক্তি চলে আসে আমার। এই জুয়ার নেশায় পড়ে মোটরসাইকেল বিক্রি করে দিয়েছি। এমনকি দ্বিতীয় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষার মধ্যেও খেলা ছাড়তে পারিনি।
আরেক শিক্ষার্থী জানায়, বন্ধুদের জুয়া খেলতে দেখে প্রাইভেট পড়ার ১৫০০ টাকা শিক্ষককে না দিয়ে তা দিয়ে খেলা শুরু করি। শুরুর দিকে ভালো লাভ হতে থাকে। কিন্তু তারপরই লোকসান হতে থাকে। ইতোমধ্যেই বাড়ি থেকে বিভিন্ন কৌশলে টাকা নিয়ে খেলায় হারতে হারতে শেষ পর্যন্ত মোবাইল বিক্রি করে দিয়েছি। এটি একরকম নেশার মতো। খেলা শুরু করলে যতক্ষণ টাকা থাকে, ততক্ষণ খেলতেই ইচ্ছা করে।
অভিভাবকরা যা বলছেন
কথা হয় রাজধানীর মিরপুরের বাসিন্দা স্মৃতি আক্তারের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমাদের না জানিয়ে আমার ছেলে কোনো এক ফেসবুক বন্ধুর মাধ্যমে এক হাজার টাকা দিয়ে ১০ ডলার কিনেছিল। ওই টাকা দিয়ে সে বিদেশি কোনো এক ফুটবল ম্যাচের জয় নিয়ে বাজি ধরেছিল। এতে সে ২০ ডলার পেয়েছিল। এভাবেই কখনো সে জিতত, আবার কখনো হেরে যেত। গত দেড় বছর ধরে সে এই খেলা খেলত; কিন্তু আমরা টের পাইনি। গত মাসে সে যাদের মাধ্যমে জুয়া খেলা শুরু করেছে, তারা তাকে জানিয়েছে সর্বনিম্ন ১০ হাজার টাকার যদি বাজি ধরে, তবে সে তাদের মেম্বার হতে পারবে। মেম্বার হলে ডলার শেষ হয়ে গেলেও সে ক্রেডিট (লোন) নিয়ে খেলতে পারবে। এজন্যই সে টাকার জন্য পাগল হয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত তার বাবা বিষয়টি জানতে পেরে মোবাইল কেড়ে নেয় এবং এখন মানসিক ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ খাওয়াচ্ছি। এখন আমার ছেলে জুয়া খেলে না। কিন্তু আমরা তো ভীষণ চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম কীভাবে ছেলেকে এই পথ থেকে ফেরাব।
আরেক অভিভাবক শান্তা আফরোজ বলেন, আজকের তরুণ প্রজন্ম আগামীর বাংলাদেশ গড়বে। তাই তারা যেন অনলাইন জুয়ার মতো ক্ষতিকর আসক্তিতে জড়িয়ে না পড়ে, সেজন্য অভিভাবকদের বেশ সচেতন থাকতে হবে। সন্তানরা মুঠোফোন ব্যবহার করে কী করছে— তা ভালো, নাকি ক্ষতিকর, সে বিষয়ে সচেতন হতে হবে। ছেলেমেয়েদের আলাদা রুমে মুঠোফোন ব্যবহার করতে না দিয়ে সবার সামনে ব্যবহার করার নির্দেশনা দিলে অনলাইন জুয়া খেলার প্রবণতা অনেকাংশে হ্রাস পাবে। অনলাইন জুয়ার কুপ্রভাব সম্পর্কে সরকারি-বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার চালানো যেতে পারে। এ ছাড়া পাঠ্যপুস্তকগুলোয় জুয়ার ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে পাঠ্যসূচি অন্তর্ভুক্ত করলেও সুফল আসতে পারে।
বিশ্লেষকরা যা বলছেন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ও অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক বলেন, দীর্ঘ বছর ধরেই অনলাইন জুয়ার প্রবণতা আমরা দেখছি। বিশ্বকাপ কিংবা ঘরোয়া এবং এর বাইরে যে আয়োজনগুলো আছে, এগুলোকে কেন্দ্র করে অনলাইন জুয়ার যে প্রচারণার সঙ্গে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ জড়িয়ে যাচ্ছে এবং এই জড়িয়ে যাওয়ার মধ্যে অর্থ বিনিয়োগ করতে হয়; বাজিও ধরতে হয়। এই বাজি ধরাকে কেন্দ্র করেই অর্থের প্রয়োজন হয়। কখনো কখনো দেখা যায় যারা অনলাইন জুয়া বা বেটিংয়ে আসক্ত, তারা এই অর্থগুলো পরিবারের কাছ থেকে বা পড়াশোনাকেন্দ্রিক কোনো প্রয়োজনের কথা বলে নিয়ে অনলাইনে জুয়া খেলছে। আবার কোনো কিছু বিক্রি করেও অনলাইন জুয়ায় আসক্ত হচ্ছে। আরেকটা বড় চিত্র দেখা যায় অনলাইন জুয়ায় যারা আসক্ত, তাদের মধ্য থেকেই কেউ কেউ মাদক গ্রহণ এবং বিক্রি, চুরি, ছিনতাইয়ের সঙ্গেও যুক্ত হচ্ছে জুয়ার অর্থ সংগ্রহ করার জন্য। এই প্রভাব সবার মাঝেই পড়ে।
তিনি আরও বলেন, পরিবারে যারা অল্প বয়সের সদস্য রয়েছেন, তাদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে এবং পরিবারের মাঝে এ বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করা প্রয়োজন। এর ক্ষতিকর দিকগুলো কী, এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হলে জীবনে কী ধরনের প্রভাব তৈরি হতে পারে, কী ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে— সেই আলোচনা পরিবারের সদস্যদের মাঝে হওয়া প্রয়োজন। এর পাশাপাশি অভিভাবকরা অনেক সময় আমাদের এই আলোচনাগুলো তরুণ সদস্যদের সঙ্গে করতে চান না। কিন্তু ভাবতে হবে এখন প্রযুক্তির সময়, অধিকাংশ অপরাধই ডিভাইসকেন্দ্রিক কিংবা অনলাইনকেন্দ্রিক। সুতরাং পরিবার যদি তার সদস্যদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে এ বিষয়গুলো নিয়ে আলাপ না করে এবং তরুণদের সচেতন না করে, তাহলে অপরাধপ্রবণতা বাড়তে পারে। আবার সন্তানকে আগামী দিনের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে চাইলে পরিবারকে এগিয়ে আসতে হবে এবং সচেতনতাবোধ তৈরি করা প্রয়োজন।