নিম্ন ও মধ্যবিত্তের ফ্ল্যাট-বাড়ি ও অসমাপ্ত গৃহনির্মাণে ঋণ

স্বপ্নের নিবাস গড়তে বিএইচবিএফসি

ইয়ামিনুল হাসান আলিফ প্রকাশিত: জুন ২৪, ২০২৪, ১২:৪৬ এএম
স্বপ্নের নিবাস গড়তে বিএইচবিএফসি
  • হাজারের কমে মাসিক কিস্তিতে মিলছে বাড়ি গড়ার ১২ ধরনের ঋণ
  • সম্পূর্ণ সুদমুক্ত ঋণব্যবস্থা ‘মনজিল’ নজর কাড়ছে সবার

ঘরে বসে আবেদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে আসছে স্মার্ট হোম লোন 
—মো. জহিরুল হক, মহাব্যবস্থাপক (আদায়)   আইসিটি (অপারেশন) ও আইসিটি (সিস্টেম) বিভাগ  বিএইচবিএফসি

সুদমুক্ত ঋণব্যবস্থা ‘মনজিল’ পরিচালনায় রয়েছে শরিয়াহ সুপারভাইজরি কমিটি  মনিটরিংয়ে শরিয়াহ অডিট কমিটি
—মো. আবু বকর সিদ্দিক খান, উপমহাব্যবস্থাপক ও সদস্য সচিব, শরিয়াহ সুপারভাইজরি কমিটি  বিএইচবিএফসি

পাবনার ঈশ্বরদীতে এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করছেন রমিজুল ইসলাম। নিজের একখণ্ড জমি থাকলেও নেই নিজের একটি বাড়ি। বাড়ি করার মতো বিপুল পরিমাণ অর্থও নেই তার কাছে। সহকর্মীর কাছ থেকে জানতে পারেন বাড়ি করতেও স্বল্প সুদে ঋণ পাওয়া যাচ্ছে আজকাল। রমিজুল ইসলামের মতো অনেকেই যখন স্বপ্নের একটি বাড়ি নির্মাণের উপায় খুঁজছেন তখন সেবার মানসিকতা নিয়ে গৃহঋণের পরিধি বাড়িয়েছে বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশন (বিএইচবিএফসি)। 

মানুষের মৌলিক চাহিদার পাঁচটির মধ্যে অন্যতম হলো বাসস্থান। বাংলাদেশের মতো এমন জনবহুল দেশে প্রতিনিয়ত জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে আবাসন চাহিদা। বড় সংখ্যক এই চাহিদা মেটাতে সহায়তা প্রদান করছে বিভিন্ন ব্যাংক ও সংস্থা। সরকারি ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি বেসরকারি ব্যাংকও গৃহঋণ দিচ্ছে। এছাড়া বেসরকারি কিছু কোম্পানি যেমন ডেল্টা ব্র্যাক হাউজিং (ডিবিএইচ), ন্যাশনাল হাউজিং ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, লংকাবাংলা ফিন্যান্স, আইডিএলসি, আইপিডিসির মতো কিছু লিজিং কোম্পানি বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানও আবাসন খাতে ঋণ দিচ্ছে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তৈরি হচ্ছেই আবাসন খাতে ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা করতে।

দেশে গৃহঋণের একমাত্র সরকারি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান হচ্ছে বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশন (বিএইচবিএফসি)। দেশের গৃহায়ন সমস্যার সমাধানে জনসাধারনকে গৃহনির্মাণে আর্থিক সহযোগিতা প্রদানের উদ্দেশ্যে ১৯৫২ সালে হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে স্বাধীনতা উত্তর ১৯৭৩ সালে জারিকৃত রাষ্ট্রপতির ৭নং আদেশ বলে বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশন (বিইচবিএফসি) পুনর্গঠিত হয়। নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের আবাসন সমস্যা সমাধানের জন্য ঋণ সহায়তা প্রদানে মাধ্যমে জীবন মান উন্নয়ন ও  পরিবেশবান্ধব আবাসন সুবিধা পেতে সহযোগিতা করে যাচ্ছে বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশন (বিএইচবিএফসি)। 

গৃহনির্মাণের পাশাপাশি বিশেষায়িত এ সংস্থাটি ফ্ল্যাট নিবন্ধন, আবাসন উন্নয়ন ও মেরামত এবং বাড়ি নির্মাণকাজে ব্যবহূত সরঞ্জাম ক্রয়ের জন্য ঋণ দিয়ে থাকে। দেশের সব অঞ্চলের মানুষকে সহযোগিতা করতে প্রতিটি জেলায় শাখা আছে সংস্থাটির। স্বপ্ননীড়, নগরবন্ধু, প্রবাসবন্ধু, পল্লীমা, কৃষক আবাসন ঋণ, আবাসন মেরামত, আবাসন উন্নয়ন, ফ্ল্যাট ঋণ, ফ্ল্যাট নিবন্ধন ঋণ, হাউজিং ইকুইপমেন্ট ক্রয় ঋণ, সরকারি কর্মচারীদের গৃহনির্মাণসহ বারোটি বাড়ি নির্মাণ ও এর সঙ্গে সম্পর্কিত ঋণ দেয় বিইচবিএফসি। তবে ইসলামি শরিয়াহভিত্তিক বাড়ি নির্মাণ ঋণ ব্যবস্থা ‘মনজিল’ ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। পরিকল্পিত, টেকসই ও পরিবেশবান্ধব আবাসন নির্মাণে ইসলামি শরিয়াহ্?ভিত্তিক এ ঋণ সুদমুক্ত।

বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশনের উপ-মহাব্যবস্থাপক ও শরিয়াহ সুপারভাইজরি কমিটির সদস্য সচিব মো. আবু বকর সিদ্দিক খান বলেন, ‘ইসলামি শরিয়াহভিত্তিক ঋণ ব্যবস্থা মনজিল ইতোমধ্যে সবার নজর কেড়েছে। মনজিলের জন্য ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (আইএসডিবি) সাথে ৩২০০ কোটি টাকার চুক্তি স্বাক্ষর করেছি আমরা। সুদ মুক্ত রাখতে ঋণ নেয়ার পূর্বে ও পরে দুটি চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়। বাড়ির রেন্টাল থেকে ঋণ পরিশোধের হার নির্ধারণ করা হয়। ঋণ ব্যবস্থাটি সুদ মুক্ত রাখতে তিন সদস্যবিশিষ্ট শরিয়াহ সুপারভাইজরি কমিটি রয়েছে। এছাড়া পুরো প্রক্রিয়া মনিটরিং করতে শরিয়াহ অডিট কমিটি রয়েছে। 

সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কম বেতনের চাকরিজীবীরা ‘স্বপ্ননীড়’ প্রকল্পের অধীনে ঋণ নিয়ে নিজস্ব বাড়ি বা ফ্ল্যাট করার সুযোগ পাচ্ছেন। ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে একক বা গ্রুপে বাড়ি নির্মাণের জন্য ‘নগর বন্ধু’, ঢাকা ও চট্টগ্রাম মেট্রো এলাকার বাইরে যে কোনো জেলা বা উপজেলা, গ্রোথ সেন্টারে একক বা গ্রুপে বাড়ি নির্মাণের জন্য পল্লীমা, ঢাকা ও চট্টগ্রাম মেট্রো এলাকা, দেশের সব বিভাগীয় ও জেলা সদর এলাকা এবং পল্লী অঞ্চলে নির্মাণাধীন বাড়ি, অসমাপ্ত নির্মিত বাড়ির নির্মাণকাজ সমাপ্ত করার জন্য আবাসন উন্নয়ন ঋণ, আবাসন মেরামত; ঢাকা ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকা এবং দেশের সব বিভাগীয় ও জেলা সদর এলাকার নাগরিকরা নির্মিত এবং সংস্কার বা মেরামতযোগ্য বাড়ির জন্য আবাসন মেরামত ঋণ পাওয়া যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি থেকে। এছাড়া প্রবাসীদের জন্য রয়েছে প্রবাস বন্ধু ঋণ, কৃষকদের জন্য রয়েছে মাত্র ৭ শতাংশ হার সুদে কৃষক আবাসন ঋণ।  বিএইচবিএফসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ঋণ মঞ্জুর করা হয়েছে ৮৪৫.৯২ কোটি টাকা এবং ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ৬৯৫.৮৮ কোটি টাকা, যা পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় যথাক্রমে ১৩১.০৮ কোটি টাকা (প্রবৃদ্ধি ১৮.৩৪ শতাংশ) এবং ১০৬.৯৩ কোটি টাকা (প্রবৃদ্ধি ১৮.১৬টি) বেশি।

ইতোমধ্যে বিএইচবিএফসি কর্তৃক প্রযুক্তি ও ডিজিটাল বেইজড কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। আগে ক্যাশবুক, জেনারেল লেজার, সাব-সিডিয়ারি লেজার এবং আর্থিক প্রতিবেদনসমূহ ম্যানুয়ালি গতানুগতিক পদ্ধতিতে করতে অনেক সময় ও শ্রমের প্রয়োজন হতো। এক্ষেত্রে, ভুলত্রুটি হলে সংশোধন করা কষ্টদায়ক ছিল। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে জেনারেল অ্যাকাউন্টিং সফটওয়্যার চালু করা হয়েছে যার মাধ্যমে সহজে এবং স্বল্প সময়ে হিসাবায়ন সম্পন্ন ও দ্রুত আর্থিক বিবরণী প্রস্তুতসহ হিসাব সমাপনী কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হচ্ছে। অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেনশন নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা কমিয়ে আধুনিক সফটওয়্যারের মাধ্যমে স্বল্প সময়ে পেনশন গ্রহীতার কাছে পেনশন পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। ফলে জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতা কমেছে, বেড়েছে স্বচ্ছতা। এছাড়া, পেনশন প্রক্রিয়াটি ডিজিটালাইজড হওয়ায় পেনশন সংক্রান্ত কাজ যথাযথভাবে সম্পাদন করা যাচ্ছে। বিএইচবিএফসি সম্পর্কিত সব ধরনের তথ্য প্রদানের জন্য তৈরি করা হয়েছে অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপস। 

বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশনের আদায়, আইসিটি (অপারেশন) ও আইসিটি (সিস্টেম) বিভাগের মহাব্যবস্থাপক মো. জহিরুল হক বলেন, “আবেদনকারীরা খুব সহজেই ঋণ পাচ্ছে। পরিবেশ বান্ধব উপকরণ দিয়ে বাসভবন তৈরির ক্ষেত্রে ‘গ্রিন হোম লোন’ নামক নতুন প্রোডাক্ট আনার চিন্তা ভাবনা হচ্ছে। এছাড়া ঘরে বসেই আবেদন করার সুযোগ দিতে স্মার্ট হোম লোনের ব্যবস্থা নিয়ে ভাবা হচ্ছে। এতে খুব সহজেই আবেদনকারী ঘরে বসেই আবেদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারবে।” কাগজপত্র ঠিক থাকলে তিন থেকে চার সপ্তাহের মধ্যেই আবেদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয় বলে দাবি এই কর্মকর্তার।