পণ্য রপ্তানি হচ্ছে দেশ থেকে বিদেশে

এসএমইদের নীরব বিপ্লব

আনোয়ার হোসাইন সোহেল প্রকাশিত: জুন ২৭, ২০২৪, ১২:২৪ এএম
এসএমইদের নীরব বিপ্লব
  • সেবা পাচ্ছে ২০ লাখ ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা
  • দুই লাখ ৪৬ হাজার ৫৭২ জন সরাসরি উপকারভোগী উদ্যোক্তা
  • ৪৫ শতাংশ পুরুষ ও ৫৫ শতাংশ নারী উদ্যোক্তা তৈরি 
  • ১০ বছরে মেলায় ৪৩ কোটি ৬২ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি

কর্মসংস্থানের মাধ্যমে সুযোগ সৃষ্টি, আমদানির বিকল্প হিসেবে রপ্তানি উপযোগী পণ্য উৎপাদনসহ দেশের সব অঞ্চলে উদ্যোক্তা সৃষ্টি ও বিকাশের জন্য কার্যক্রম বাস্তবায়নে কাজ করছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ফাউন্ডেশন বা এসএমই ফাউন্ডেশন। এসএমই খাতের বিকাশ ও এর ধারাবাহিকতা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ফাউন্ডেশন সরকার ও প্রাইভেট সেক্টরের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। এ সংস্থা থেকে সরাসরি সুবিধা পাচ্ছে ২০ লক্ষাধিক উদ্যোক্তা।  

এসএমই ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে ফাউন্ডেশনের কার্যক্রমের মাধ্যমে উদ্যোক্তাদের মাঝে ঋণ সহায়তা, পণ্য বাজারজাতকারণ, বহুমুখীকরণ, এসএমই উদ্যোক্তাদের পণ্যের রপ্তানি বৃদ্ধি, নতুন উদ্যোক্তা তৈরি, উদ্যোক্তা উন্নয়নে সক্ষমতা বৃদ্ধি, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, আইসিটি সহায়তা, নীতি-সহায়তাসহ উদ্যোক্তাদের উৎপাদিত পণ্যের দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে প্রচার ও প্রসারে বিভিন্ন কর্মসূচি সফলভাবে বাস্তবায়ন করেছে। একই সঙ্গে নারী উদ্যোক্তা ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে অর্থনীতির মূল ধারায় সম্পৃক্ত করতে এসএমই ফাউন্ডেশন কার্যকর ভূমিকা রাখছে। 

সরকারের অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, এসএমই নীতিমালা-২০১৯ ও  জাতীয় শিল্প নীতিমালা-২০২২ এবং রূপকল্প-২০৪১ বাস্তবায়নে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য কাজ করে যাচ্ছে এসএমই ফাউন্ডেশন। মূলত, এসএমই উন্নয়নের যাবতীয় পরিকল্পনা, ক্যাপাসিটি বিল্ডিং, অর্থায়ন, পরামর্শ সেবা ও সহায়তা, সচেতনতা বৃদ্ধি, মূল্যায়ন ও প্রতিনিধিত্বকরণের কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে কোম্পানি আইন-২০০৭ সালে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ফাউন্ডেশন গঠিত হয়। ১১টি কৌশলগত লক্ষ্য আর আটটি অনুবিভাগের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয় কর্মপরিকল্পনা। যার অন্যতম লক্ষ্য, সরকারের মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনা নিশ্চিত করা।  স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে ১৯৭৩ সালে শুরু হওয়া প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার ধারাবাহিকতায় তার সুযোগ্যকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে। সরকারের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, এসডিজি বাস্তবায়ন ও রূপকল্প-২০৪১ অর্জনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ এসএমই ফাউন্ডেশন। ২০২২ সালে ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠার ১৫ বছরে ফাউন্ডেশন কর্তৃক বাস্তবায়িত কর্মপরিকল্পনার আলোকে কতটুকু লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে সেই চিত্র তুলে ধরা হয়। এসএমই ফাউন্ডেশনের প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০ লক্ষাধিক উদ্যোক্তাকে এসএমই ফাউন্ডেশন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সেবা দিয়েছে। এর  মাধ্যমে দুই লাখ ৪৬ হাজার ৫৭২ জন সরাসরি উপকারভোগী উদ্যোক্তা রয়েছে। যার মধ্যে ৪৫ শতাংশ পুরুষ ও ৫৫ শতাংশ নারী উদ্যোক্তা। 

উদ্যোক্তাদের পণ্য প্রচার, প্রসার ও বিপণনে ১০ বছরে ১০টি জাতীয় পণ্য মেলার আয়োজন করেছে। এতে দুই হাজার ২৪৮ জন উদ্যোক্তা অংশ নিয়েছে। যার মধ্যে ৬৪ দশমিক ৫৬ শতাংশ নারী ও ৩৫ দশমিক ৪৬ শতাংশ পুরুষ অংশগ্রহণ করেন। এসব মেলায় ৪৩ কোটি ৬২ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি করেছেন। ক্রয়াদেশ পেয়েছেন ৭২ কোটি ৮৫ লাখ টাকার। যার গ্রাফ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ঊর্ধ্বমুখী অবস্থান। ক্রেতা-দর্শনার্থীদের উপস্থিতিতে প্রতিবছরই জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে এসএমই পণ্য মেলার। ১০টি জাতীয় এসএমই পণ্য মেলায় ৩৫ লাখ ক্রেতা-দর্শনার্থী উপস্থিত হয়েছিলেন। এছাড়া আঞ্চলিক আয়োজিত এসএমই মেলায় চার হাজার ৭২ জন উদ্যোক্তা অংশ নিয়েছে। তাদের মধ্যে নারী ৬১ দশমিক ৭৭ শতাংশ আর পুরুষ ৩৮ দশমিক ২৩ শতাংশ।  এসএমই মেলার পাশাপাশি ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলাসহ বছরভিত্তিক বিভিন্ন বাণিজ্য মেলায়ও অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও ঈর্ষণীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। এসএমই ফাউন্ডেশনের তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ২০১৬-১৭ সালে যেখানে অংশগ্রহণকারী সংখ্যা ছিলো মাত্র ৬ শতাংশ সেখানে ২০১৭-১৮ সালে অংশগ্রহণকারী সংখ্যা বেড়ে ২২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। সবশেষ ২০২২-২৩ সালের বাজারভিত্তিক বাণিজ্য মেলায় অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা ৮০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। 

সরকার দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের লক্ষ্যে রূপকল্প-২০২১ এবং রূপকল্প-২০৪১ গ্রহণ করেছে। বাজার অর্থনীতি ব্যবস্থায় ব্যক্তি খাতকে শিল্প তথা অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান চালিকাশক্তি রূপে গণ্য করা হয়। এ লক্ষ্যে সরকার ব্যক্তি খাতের মাধ্যমে শিল্পায়ন ত্বরান্বিত করতে আগ্রহী। দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারাকে সচল রেখে নারী ও পুরুষ নির্বিশেষে সব শিল্প উদ্যোক্তাই তাদের সৃজনশীলতা ও দক্ষতার স্বাক্ষর রাখছেন। এসএমই ফাউন্ডেশন উন্নয়নের বিশ্বাস করে। উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় নারী এবং পুরুষ উভয়ের সম্পৃক্ততা ব্যতীত একটি দেশের সুষম উন্নয়ন সম্ভব নয়। এমএমই ফাউন্ডেশন ২০০৮ সালে ‘জাতীয় এসএমই নারী উদ্যোক্তা পুরস্কার’ প্রদান করে। যার ধারাবাহিকতায় ২০১০, ২০২২ সালেও জাতীয় এসএমই নারী উদ্যোক্তা পুরস্কার প্রদান করে। বর্তমানে  দেশের পুরুষ ও নারী উদ্যোক্তাদের বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনটি ক্যাটাগরিতে মোট ছয়টি পুরস্কার প্রদানের ব্যবস্থা রয়েছে। 

ক্যাটাগরিগুলো হলো— বর্ষসেরা মাইক্রো উদ্যোক্তা, বর্ষসেরা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, বর্ষসেরা মাঝারি উদ্যোক্তা। প্রতিটি ক্যাটাগরিতে একজন পুরুষ ও একজন করে নারী উদ্যোক্তাকে নির্বাচিত করা হয়। এছাড়া বর্ষসেরা স্টার্টআপ ও বিশেষ উদ্যোক্তা পুরস্কার (জুরি বোর্ড প্রয়োজন মনে করলে) প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়। এখন পর্যন্ত ৪৮ জন উদ্যোক্তাকে এই পুরস্কার প্রদান করা হয়েছে। এসএমই ফাউন্ডেশনের ২০১৩ সালের এক সমীক্ষায় দেখে গেছে, দেশে ১৭৭টি এসএমই ক্লাস্টার রয়েছে। এসএমই ফাউন্ডেশন ২৩ হাজার ৭৭৫ জন উদ্যোক্তাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। বর্তমানে ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি ক্লাস্টার ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৩৮ শতাংশ। ১৮ শতাংশ ক্লাস্টার নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রাজশাহী বিভাগ এবং ১৫ শতাংশ ক্লাস্টার নিয়ে তৃতীয় স্থানে রয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগ। 

এছাড়া খুলনায় ১২ শতাংশ, রংপুরে ৭, বরিশালে ৬ এবং সিলেটে ৪ শতাংশ ক্লাস্টার প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে প্রায় ২০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। পুরুষ ও নারী শ্রমিকের হার যথাক্রমে ৭৪ ও ২৬ শতাংশ। ক্লাস্টারে অবস্থিত ৭০ হাজার প্রতিষ্ঠানে বার্ষিক টার্নওভার ৩০ হাজার কোটি টাকা।  বৈশ্বিক করোনা মহামারির আগ্রাসনে বাংলাদেশের শিল্প খাত, বিশেষত কুটির, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি (সিএমএসএমই) খাতের অগ্রযাত্রায় নেতিবাচাক প্রভাব পড়ে। ওই সময় সরকার ১৫০০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে। এসএমই ফাউন্ডেশনের অনুকূলে ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। ১৯টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে স্বল্পতম সময়ে তিন হাজার ১০৮ উদ্যোক্তার অনুকূলে ৩০০ কোটি টাকা সফলতার সঙ্গে বিতরণ করে এমএমই ফাউন্ডেশন।  এসএমই ফাউন্ডেশনের ডিজিটাল প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাপনায় নিবন্ধিত উদ্যোক্তা রয়েছে ২২ হাজার জন। আটটি ডিজিটাল সিস্টেমের মাধ্যমে এক লাখ ৩৪ হাজার ৭৭৫ জনকে সেবা প্রদান করা হয়েছে। আইসিটি কার্যক্রমের সুবিধাভোগী সংখ্যা ১০ হাজার ২১৪ জন। 

নারী উদ্যোক্তা উন্নয়ন : দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি নারী। এই বিশাল নারী জনগোষ্ঠীকে অর্থনৈতিক কার্যক্রমের মূল স্রোতধারায় অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমেই ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে বলে ফাউন্ডেশন মনে করে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ফাউন্ডেশন এসএমই খাতের উন্নয়নে গৃহীত সার্বিক কার্যক্রমে নারী উদ্যোক্তা সৃষ্টি ও উন্নয়নকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনা করে আসছে। এক হাজার ১৯টি কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে ৫৫ হাজার ৭৯১ জনকে সরাসরি সেবার আওতায় আনা হয়। ‘এসো উদ্যোক্তা হই’ কর্মসূচির আওতায় ৩০ হাজার নতুন নারী উদ্যোক্তা তৈরি করে। ব্যবসা বহুমুখীকরণের লক্ষ্যে ২০ হাজার নারী উদ্যোক্তাকে বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। নারী উদ্যোক্তাদের পণ্যের বাজার তৈরির জন্য সাতটি ক্রেতা-বিক্রেতা সম্মিলন আয়োজন এবং ৭০০ নারী উদ্যোক্তার পণ্যের নতুন বাজার সংযোগের সহায়তা প্রদান, আমেরিকার বাজারে বাংলাদেশের পাট পণ্যের বাজার সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ১৪ জন উদ্যোক্তাকে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে আয়োজিত ট্রেড  শো-তে অংশগ্রহণে সহায়তা প্রদান, নারী উদ্যোক্তাদের তথ্য সম্বলিত চারটি প্রকাশনা প্রকাশ। সরকারি অর্থায়নে নারী আইসিটি ফ্রি-ল্যান্সার এবং উদ্যোক্তা উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় তিন হাজার নারী উদ্যোক্তা ও ফ্রি-ল্যান্সার তৈরি, ঐতিহ্যবাহী পণ্যের মান উন্নয়নসহ নানা কার্যক্রম গ্রহণ করেছে।  

এসএমই পলিসিবান্ধব ব্যবসার পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে পলিসি অ্যাডভোকেসি কার্যক্রমের আওতায় আট লাখ উদ্যোক্তাকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সেবা প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া এসএমই নীতিমালা-২০১৯ এর প্রাথমিক ও চূড়ান্ত খসড়া প্রণয়নে সহায়তা করা হয়েছে। 

এসএমই খাতের উন্নয়নে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নেটওয়ার্কিং : এসএমইদের উন্নয়নে কাজ করার লক্ষ্য সরকার এসএমই ফাউন্ডেশনকে শীর্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলে। শুরু থেকেই এসএমইদের উন্নয়নে বিভিন্ন কর্মসূচি পরিচালনা করে আসছে এসএমই ফাউন্ডেশন। দেশি-বিদেশি ২৩টি সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের মাধ্যমে একত্রে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মসূচি পরিচালনা করে আসছে।