- বাজানো হয়নি ‘পাগলা ঘণ্টা’, সীমানা প্রাচীরের বাইরে ছিল না রক্ষী
- ডেপুটি জেলারসহ পাঁচজন সাময়িক বরখাস্ত, তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা
- মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১০ জনসহ ১৬ জঙ্গি ও দুর্ধর্ষ কয়েদিকে স্থানান্তর
১৪০ বছর আগে নির্মাণের সময় সেভাবে ভেবে দেখা হয়নি, বর্তমানে এসব বিষয় বিবেচনায় নেয়ার সময় এসেছে
—কারা কর্তৃপক্ষ
নিরাপত্তা, দায়িত্বে অবহেলাসহ অন্য কোনো পক্ষের যোগাযোগ রয়েছে কী না— সবগুলো বিষয়ই তদন্তে উঠে আসবে
—জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটির প্রধান
চারজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিনের রিমান্ড আবেদন পুলিশের
নির্মাণের ১৪০ বছর পর চার কয়েদির পালানোর ঘটনায় উঠে আসছে বগুড়া কারাগারে অবকাঠামোগত ত্রুটির তথ্য। ১৮৮৩ সালে ওই কারাগার নির্মাণের সময় সেভাবে ভেবে দেখা হয়নি, যে কারণে অবকাঠামোগত ত্রুটি কিংবা নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি এখন সামনে এসেছে। বর্তমানে এসব বিষয় বিবেচনায় নেয়ার সময় এসেছে বলে মনে করছে কারা কর্তৃপক্ষ। পাঁচটি কনডেম সেলবিশিষ্ট ওই কারাগারটির অবকাঠামোগত ত্রুটি চিহ্নিত করেছে চার কয়েদি পালানোর ঘটনা তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা। ঘটনার দিন দায়িত্বে অবহেলার বিষয়টিও এখন পর্যন্ত প্রমাণিত। যে কারণে এক ডেপুটি জেলারসহ পাঁচজনকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে কারা কর্তৃপক্ষ। বিভাগীয় মামলা হয়েছে কারা-সংশ্লিষ্ট তিনজনের বিরুদ্ধে। বাড়ানো হয়েছে কারাগারের ভেতর-বাইরের নিরাপত্তা। প্রতিটি সেলের সামনেই এখন দুজন করে কারারক্ষী নিয়োগ দেয়া হয়েছে। চার কয়েদিকে গত বুধবার রাতে আদালতের মাধ্যমে ফের কারাগারে নেয়া হয়েছে। সাজা হিসেবে তাদের পরানো হয়েছে ডাণ্ডাবেড়ি। রাখা হয়েছে জঙ্গি ও ভয়ংকর অপরাধীদের জন্য নির্ধারিত সেলে।
এরই মধ্যে গতকাল শুক্রবার কারাগারের কনডেম সেলে থাকা ২৬ কয়েদিকে অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন কক্ষে স্থানান্তর করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এদের মধ্যে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদি ১০ জন এবং বাকি ১৬ জন জঙ্গি ও দুর্ধর্ষ অপরাধী নিরাপত্তার স্বার্থেই এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ।
গত মঙ্গলবার রাত ৩টা ৫৫ মিনিটের দিকে কারাগারের ২ নম্বর জাফলং সেলের ছাদ ফুটো করে পালিয়ে যায় ওই চার ফাঁসির আসামি। ১৫ মিনিটের মাথায় শহরের চেলোপাড়া এলাকা থেকে ভোর ৪টা ১০ মিনিটে পুলিশের কাছে তারা ধরা পড়ে। তাদের বিরুদ্ধে বুধবার বগুড়া সদর থানায় মামলা করেছেন বগুড়া কারাগারের জেলার ফরিদুর রহমান রুবেল। গত বৃহস্পতিবার থেকে ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে কারা অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসনের পৃথক কমিটি। তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অতিরিক্ত কারামহাপরিদর্শক কর্নেল শেখ সুজাউর রহমানের নেতৃত্বে অধিদপ্তরের তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি দিনভর কারাগারের ভেতরে অনুসন্ধান চালিয়েছে। বিকালে কারাগারে প্রবেশ করে বগুড়ার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পিএম ইমরুল কায়েসের নেতৃত্বে গঠিত প্রশাসনিক তদন্ত কমিটি। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বগুড়া সদর পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক সুজন মিয়া বেলা ১১টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত কারাগারের ভেতর তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করেন। তদন্তের স্বার্থে তিনি ঘটনাস্থলের কিছু স্থিরচিত্র ধারণ করেছেন।
নজিরবিহীন ঘটনা সম্পর্কে বগুড়া কারাগারের কয়েকজন প্রবীণ কারারক্ষীর দেয়া তথ্যমতে, কারাগারের উত্তর-পূর্বদিকে প্রধান ফটকের পাশে অবস্থিত পাঁচ কক্ষবিশিষ্ট কনডেম সেল ভবন। এটি একসময় কারা কর্মকর্তার বাসভবন ছিল। পরে কনডেম সেলে রূপান্তর করা হয়। ভবনের উত্তর দিকে নিজস্ব দেয়াল নেই; কারাগারের সুউচ্চ সীমানা প্রাচীরই দেয়াল হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। সেলের ছাদ ফুটো করে গত মঙ্গলবার রাত ১টা থেকে ৩টা ৫ মিনিটের মধ্যে চার কয়েদি ছাদে ওঠেন। তারা নিজেদের ব্যবহূত বিছানার চাদর গিঁট দিয়ে রশি বানিয়ে ছাদসংলগ্ন লোহার গ্রিলের সঙ্গে বাঁধেন। উত্তরদিকে দেয়াল হিসেবে ব্যবহূত সীমানা প্রাচীরের বাইরে এই রশি ঝুলিয়ে তারা পালানোর সুযোগ নেন। তদন্তে নিয়োজিত কর্মকর্তা ও কারারক্ষীরা জানান, সীমানা প্রাচীরই সেলটির এক পাশের দেয়াল হওয়ায় কয়েদিরা খুব সহজেই সামান্য উঁচুতে লাফ দিয়ে (ছাদ থেকে দেয়াল বা সীমানা প্রাচীরের উচ্চতা ৩-৪ ফুট বেশি) প্রাচীরের ওপর উঠে পড়েন। তারপর রশি ধরে একে একে কারাগারের বাইরে চলে যান। সেলগুলো সীমানা প্রাচীর থেকে দূরে থাকলে কয়েদিরা এভাবে পালানোর সুযোগ পেতো না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কারা কর্মচারী বলেন, কনডেম সেলগুলোর অবস্থান সীমানা প্রাচীর থেকে অন্তত ১০০-১৫০ ফুট দূরে অবস্থান হলে কয়েদিরা পালানো তো দূরের কথা, এটা নিয়ে ভাবতও না। তদন্ত-সংশ্লিষ্ট আরেক কর্মকর্তা জানান, মানবিক কারণে প্রতিটি সেলে ঘড়ি রয়েছে। কয়েদিদের পক্ষে সময় দেখাও সহজ হয়েছিল। তাছাড়া ঘনঘন লোডশেডিংও তাদের পালাতে সহায়তা করে।
দীর্ঘ কারাবাসের অভিজ্ঞতায় পালানোর পরিকল্পনা করা হয় বলে জানিয়েছেন ঘটনার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক সুজন মিয়া। তিনি নিশ্চিত হয়েছেন, কয়েদি নজরুল ইসলাম মজনু ও আমির হোসেন ওরফে আমির হামজা কারাগার থেকে পালানোর পরিকল্পনা করেন। তাছাড়া বগুড়া কারাগার এবং এর পরিস্থিতি সম্পর্কে পালানোর এ দুজনের অনেক অভিজ্ঞতা রয়েছে। প্রায় সাড়ে ১০ বছর আগে ২০১৪ সালের ১৪ জানুয়ারি কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারী উপজেলার দিয়াডাঙ্গা গ্রামে একই পরিবারের চারজনকে হত্যার অভিযোগে মজনু ও আমির হামজাকে তাদের সহযোগীসহ গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর থেকে তারা দেশের বিভিন্ন কারাগারে ছিল। প্রায় আট বছর আগে তাদের বগুড়া কারাগারে আনা হয়। এখানে অবস্থানকালেই কুড়িগ্রামের আদালত ২০২১ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি মজনু ও আমির হামজাসহ ছয়জনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন। ঘোষণার দিন মজনু আদালতের এজলাস ভাঙচুর করে। তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ধরা পড়ার সময় তাদের কাছ থেকে প্লাস্টিকের রশি প্যাঁচানো ৪ দশমিক ৩ ইঞ্চি লম্বা স্টিলের পাত এবং ৭ ইঞ্চি লম্বা স্ক্রু ড্রাইভার জব্দ করা হয়। ধারণা করা হচ্ছে, তারা লোহার বালতির হাতল এবং স্কেলের মতো দেখতে স্টিলের পাত কাজে লাগিয়ে ১৪০ বছরের পুরোনো টালিযুক্ত ছাদ কেটে ফুটো করে ফেলে। ছাদটি ফুটো করার জন্য তারা ছাদের নিচে কাঠের খাটিয়াও সরিয়ে নেয়। মজনু ও আমির হামজার বগুড়া কারাগার সম্পর্কে অভিজ্ঞতার বিষয় উল্লেখ করে তদন্ত কর্মকর্তা সুজন মিয়া বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে ওই দুজন একই সেলে বসবাসরত অন্য দুই কয়েদি জাকারিয়া ও ফরিদ শেখের সঙ্গে পালানোর পরিকল্পনা করে। তাদের কাছ থেকে যে স্ক্রু ড্রাইভার পাওয়া গেছে, সেটি তারা কারাগার থেকে বের হওয়ার পর কুড়িয়ে পেয়েছে বলে দাবি করেছে। স্ক্রু ড্রাইভারটি তারা নিরাপত্তার স্বার্থে নিজেদের কাছে রেখেছিল। এছাড়া গণমাধ্যমে যে খবর প্রচার হয়েছে— চার কয়েদির কাছে অনেক টাকা ও বিপুল সিগারেট ছিল। আদতে এমন কিছুই পাওয়া যায়নি। তাদের আরও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ড চেয়ে আদালতে তোলা হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদিদের সেলের নিরাপত্তায় মোতায়েন থাকেন দুজন কারারক্ষী। তবে ঘটনার দিন সেখানে একজন কারারক্ষী ছিলেন। সীমানা প্রাচীরের বাইরেও একই সময় রক্ষী ছিলেন না। কয়েদি পালানোর পর সতর্কতামূলক পদক্ষেপ ‘পাগলা ঘণ্টা’ও বাজানো হয়নি। কারাগারের বাইরে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার কার্যালয়ে নৈশকালীন নিরাপত্তায় পুলিশসহ অনেক প্রহরী থাকেন। পাগলা ঘণ্টা না বাজার কারণে কয়েদি পালানোর ঘটনা তারাও জানতে পারেননি।
তদন্তের ব্যাপারে অতিরিক্ত কারামহাপরিদর্শক কর্নেল সুজাউর রহমান বলেন, আমরা চার কয়েদির সঙ্গে কথা বলেছি। কীভাবে ঘটনা ঘটল, সেটি তদন্ত করা হচ্ছে। অবকাঠামোগত বা প্রশাসনিক কোনো দুর্বলতা ছিল কি না কিংবা কর্তব্যে অবহেলা ছিল কি না, সেগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ডিউটি রোস্টার ঠিকমতো অনুসরণ করা হয়েছে কি না, সেগুলোও তদন্তের অধীন থাকবে। সব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে তদন্ত শেষে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দেয়া হবে।
জেলা প্রশাসন গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ইমরুল কায়েস বলেন, বৃহস্পতিবার বিকাল থেকে তদন্ত শুরু করেছি। নিরাপত্তা, দায়িত্বে অবহেলাসহ এর সঙ্গে অন্য কোনো পক্ষের যোগাযোগ রয়েছে কি না, সবগুলো বিষয়ই তদন্তে উঠে আসবে। অন্যদিকে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সুজন মিয়া বলেন, চারজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতে সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করেছি। আদালত রিমান্ডে নেয়ার আবেদন মঞ্জুর করলে সে অনুযায়ী জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।