- চলতি বছর আক্রান্তের তুলনায় মৃত্যুহার বেশি
- ঢাকার বাইরে তিন বিভাগে রোগী বেশি
ডেঙ্গু চিকিৎসার কোনো উপকরণের ঘাটতি নেই। হাসপাতালগুলোতে সার্বিক প্রস্তুতি রাখা হয়েছে
—অধ্যাপক ডা. সামন্ত লাল সেন, স্বাস্থ্যমন্ত্রী
বর্ষা মৌসুমে এডিস মশার বংশ বিস্তার বেশি হয়। এ সময় মশকনিধন বাড়ানোর পাশাপাশি জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে
—অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার, কীটতত্ত্ববিদ
বর্ষা মৌসুমকে বলা হয় এডিস মশা প্রজননের সময়। গত দুই যুগের বেশি সময় আগে দেশে প্রথম ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ দেখা যায়। তারপর প্রতি বর্ষায় বেড়েছে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যু। এর মধ্যে ডেঙ্গুতে গত বছর দেশে রেকর্ড সংখ্যক আক্রান্ত ও মৃত্যু হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সবশেষ তথ্য অনুসারে, চলতি বছর গতকাল পর্যন্ত সারা দেশে বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন তিন হাজার ৬০৭ জন। এ সময় মৃত্যু হয়েছে ৪৩ জনের। গত ১০ বছরের মধ্যে বছরের প্রথম ছয় মাসে এর চেয়ে বেশি রোগী ভর্তি এবং মৃত্যু হয়েছিল ২০২৩ সালে। সে বছর জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত আক্রান্ত ছিল সাত হাজার ৯৭৮ জন। ওই সময় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে ৪৭ জনের। সেদিক থেকে চলতি বছর আক্রান্তের তুলনায় মৃত্যুহার বেশি।
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যু বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, জানুয়ারি মাসে আক্রান্ত ছিল এক হাজার ৫৫ জন, মৃত্যু ১৪ জন। ফেব্রুয়ারি মাসে আক্রান্ত ছিল ৩৯৯ জন, মৃত্যু তিনজন। মার্চ মাসে আক্রান্ত ছিল ৩১১ জন, মৃত্যু পাঁচজন। এপ্রিল মাসে আক্রান্ত ছিল ৫০৪ জন, মৃত্যু দুজন। মে মাসে আক্রান্ত ছিল ৬৪৪ জন, মৃত্যু ছিল ১২ জন। জুন মাসের গতকাল পর্যন্ত আক্রান্ত ৭৫৪ জন, মৃত্যু সাতজন। সবশেষ জুন মাসের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মাসের প্রথম সপ্তাহে হাসপাতালে এসেছেন ১৬৬ জন, দ্বিতীয় সপ্তাহে ১৭৪ জন, তৃতীয় সপ্তাহে ১২২ জন এবং ২২ থেকে ২৯ জুন পর্যন্ত হাসপাতালে এসেছেন ২৩২ জন রোগী। চলতি বছর মোট আক্রান্ত রোগীর মধ্যে শুধুমাত্র ঢাকায় আক্রান্ত হওয়া রোগী এক হাজার ৬৯ জন। যাদের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ৩১ জনের। অন্যদিকে ঢাকার বাইরের ৮৫ শতাংশ ডেঙ্গু রোগী তিন বিভাগে। সবচেয়ে বেশি ৯৯৮ জন আক্রান্ত হয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগে। এই বিভাগের চট্টগ্রাম, চাঁদপুর ও কক্সবাজার জেলায় সবচেয়ে বেশি রোগী পাওয়া গেছে। এরপর বরিশাল বিভাগের বরিশাল, বরগুনা ও পিরোজপুরে আক্রান্তের হার বেশি।
ঢাকায় আক্রান্ত ও মৃত্যু বেশি হওয়ার কারণ হিসেবে জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, মশকনিধনে কার্যকরী পদক্ষেপ না থাকা, এডিস মশা নিয়ে সচেতনতার অভাব, পরিকল্পিতভাবে এডিস মশকনিধন ব্যবস্থা না নেয়া। সবশেষ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির আওতায় ঢাকায় মশার ঘনত্ব মাপতে জরিপ চালায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। জরিপে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের ৯৯টি ওয়ার্ডের তিন হাজার ১৫২টি বাড়ি পরিদর্শন করা হয়। পরিদর্শন করা বাড়ির মধ্যে ৪৬৩টিতে এডিস মশার লার্ভা এবং পিউপা পাওয়া গেছে; যা পরিদর্শন করা মোট বাড়ির ১৪ দশমিক ৬৯ শতাংশ। লার্ভা পাওয়ার শতকরা হার বা হাউস ইনডেক্স ১০-এর বেশি হলে মশার ঝুঁকিপূর্ণ উপস্থিতি বিবেচনা করা হয়। সেদিন মশার এই উপস্থিতিকে উদ্বেগজনক বলেছেন জনস্বাস্থ্যবিদরা।
তারা বলছেন, বর্ষায় এডিস মশার ঘনত্ব আরও বাড়বে। এদিকে ডেঙ্গুতে আক্রান্তদের চিকিৎসাসেবায় কোনো সংকট নেই উল্লেখ করে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী অধ্যাপক ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, ‘ডেঙ্গু চিকিৎসার জন্য ওষুধপত্র, স্যালাইনসহ হাসপাতালে সার্বিক প্রস্তুতি রয়েছে। সম্মিলিতভাবে ডেঙ্গু প্রতিরোধ করতে হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রস্তুতি যথেষ্ট। তবে এডিস মশা ঠেকাতে না পারলে চিকিৎসা প্রস্তুতিতে শুধুমাত্র ডেঙ্গু থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে না।’ কীটতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার।
ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে তিনি বলেন, ‘ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সবার আগে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বর্ষা মৌসুমে এডিস মশা জন্মায় বেশি। তার কারণ, বৃষ্টির পানি বিভিন্ন জায়গায় জমে থাকে। আমাদের সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে আমাদের বাসা-বাড়িসহ আঙিনার কোথাও পানি জমে থাকছে কি না। যদি পানি জমে থাকে, পাত্রটি উল্টে দিন। পরিত্যক্ত পাত্র কাজে না লাগলে ধ্বংস করে ফেলুন। কারণ এসব পাত্রেই এডিস মশা বংশ বিস্তার করে। ডেঙ্গু থেকে রক্ষা পেতে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের কোনো বিকল্প নেই।’