সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে চ্যালেঞ্জিং দায়িত্বে স্বাস্থ্যমন্ত্রী

সাহিদুল ইসলাম ভূঁইয়া প্রকাশিত: জুলাই ৯, ২০২৪, ১২:০১ এএম
সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে চ্যালেঞ্জিং দায়িত্বে স্বাস্থ্যমন্ত্রী

স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাস্থ্য খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে দেশের উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, একটি সমৃদ্ধ দেশ গড়তে হলে চাই স্বাস্থ্যবান জাতি। এ লক্ষ্যে স্বাস্থ্য খাতকে শুধু গুরুত্ব দিয়েই ক্ষান্ত হননি তিনি, ব্যাপক সময়োপযোগী পদক্ষেপও গ্রহণ করেছিলেন। অগ্নিদুর্ঘটনায় আহত রোগীদের সেবা দিতে বঙ্গবন্ধু ‘বার্ন ইনস্টিটিউট’ করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। সে সময়ের তরুণ চিকিৎসক সামন্ত লাল সেন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে অগ্নিদুর্ঘটনায় আহত রোগীদের সেবা দিতে শুরু করেন। যিনি বর্তমান সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী। বঙ্গবন্ধুর হাতে মাত্র পাঁচটি বেড নিয়ে শুরু করা বার্ন ইনস্টিটিউট এখন ৫০০ বেডের বিশ্বের সর্ববৃহৎ ‘শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট’। 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পিতার মতোই আস্থা রেখে ইনস্টিটিউটটির সমন্বয়কের দায়িত্ব দেন অধ্যাপক ডা. সামন্ত লাল সেনকে। অগ্নিদুর্ঘটনায় আহত রোগীদের কাছে যিনি একজন আস্থা আর বিশ্বাসের নাম। সবশেষ দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় পায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। প্রায় দুই দশক ক্ষমতা থাকায় আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে স্বাস্থ্য খাতের বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সরকারের ভিশন ও মিশন সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা বাস্তবায়নের জন্য নতুন মন্ত্রিসভায় চমক হিসেবে নিয়ে আসেন অধ্যাপক ডা. সামন্ত লাল সেনকে। দায়িত্ব দেন দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের। 

দায়িত্ব পেয়ে তিনি বলেছিলেন, জীবনে কখনও ভাবিনি এত বড় দায়িত্ব পাব। এই দায়িত্ব আমার কাছে আমানত। তিনি কাজের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত প্রধানমন্ত্রীর আস্থার প্রতিদান দিয়ে যাচ্ছেন। দায়িত্ব পেয়েই প্রথমে ছুটে যান প্রান্তিক পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবার মান দেখতে। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী চান দেশের সব পর্যায়ের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে। এর জন্য প্রয়োজন প্রান্তিক পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়া। সেবার মান বৃদ্ধি করতে সময় পেলে চলে যান বিভিন্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। রোগীদের চিকিৎসাসেবায় কোনো ঘাটতি দেখলে সঙ্গে সঙ্গে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার নজিরও স্থাপন করেছেন। স্বাস্থ্য খাতে নৈরাজ্য ঠেকাতে দায়িত্ব নেয়ার পর সারা দেশে অবৈধ হাসপাতাল-ক্লিনিকের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দেন। বন্ধ করে দেয়া হয় প্রায় তিন হাজারের বেশি হাসপাতাল-ক্লিনিক। ডেঙ্গুর মতো মৌসুমি রোগের চিকিৎসাসেবার সংকট দূর করতে হাসপাতালে বিশেষ ইউনিট করার নির্দেশনা দেন। 

উন্নত চিকিৎসাসেবার আশায় বিদেশমুখী রোগী ঠেকাতে নিয়েছেন বিশেষ উদ্যোগ। দেশের বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাসেবার মান বৃদ্ধিতে চিকিৎসক নিয়োগের কার্যক্রম হাতে নিয়েছেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে রোগী বিদেশে যাবে না, বিদেশ থেকে বাংলাদেশে আসবে। দেশে উন্নতমানের চিকিৎসাসেবা থাকা সত্ত্বেও মানুষ চিকিৎসার জন্য বিদেশে চলে যায়। আমাদের প্রধানমন্ত্রী দেশেই চিকিৎসা করেন। দেশের চিকিৎসকরা অনেক মেধাবী ও দক্ষ। বিভিন্ন সময়ে চিকিৎসাসেবা নিতে গিয়ে রোগী ও চিকিৎসকদের মধ্যে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে। এমন ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে দেশে স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইনের বিষয়ে প্রস্তাব রয়েছে। আইনটি সংসদে পাস করতে তিনি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তিনি বলেন, ‘রোগী যাতে যথাযথ চিকিৎসা পায়, সেটা দেখা যেমন আমার দায়িত্ব, তেমনি ডাক্তাররাও যাতে চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে সুরক্ষা পান, সেটা দেখাও আমার দায়িত্ব। রোগী ও ডাক্তার উভয়কেই সুরক্ষা দেয়ার দায়িত্বটা আমার।’ স্বাস্থ্য খাত নিয়ে তিনি বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই দেশে বিশেষায়িত হাসপাতাল, জেলা হাসপাতাল, উপজেলা হাসপাতাল, কমিউনিটি ক্লিনিকের মতো জনস্বাস্থ্য চিকিৎসার গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে। একইসঙ্গে বেড়েছে স্বাস্থ্য খাতের কর্মপরিধিও। মানুষ সরকারি হাসপাতালে নামমাত্র মূল্যে চিকিৎসাসেবা ও ওষুধ পাচ্ছে। এসবই স্বাস্থ্য খাত নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী চিন্তার ফসল।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী আরও বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বিভিন্ন অধিদপ্তরের কাজের স্বচ্ছতা নিশ্চিতে জবাবদিহি নিশ্চিত করা হয়েছে। 

স্বাস্থ্য খাতে দক্ষ জনবল সংকটের বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের জনবহুল দেশ। জনসংখ্যা অনুপাতে চিকিৎসকের সংখ্যা কম। আমরা চিকিৎসক নিয়োগের কার্যক্রম হাতে নিয়েছি। চিকিৎসকদের উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। স্বাস্থ্যশিক্ষা সংকট নিরসনে মেডিকেল কলেজের সংখ্যা বৃদ্ধি না করে মান বৃদ্ধির দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। চিকিৎসার মান বৃদ্ধি করতে গবেষণার কোনো বিকল্প নেই। চিকিৎকদের গবেষণায় বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে।

নিজের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘জীবনে অনেক সুযোগ পেয়েছি বিদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করার। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা মেনে আর দেশের মানুষের ভালোবাসার প্রতিদান দিতে দেশেই মানুষের সেবায় প্রাণ সঁপে দিয়েছি। আমার পরিবারের প্রায় সবাই দেশের বাইরে থাকেন। একদিনের জন্য পরিবারের সদস্যদের দেখতে গেলেও মনটা ছটফট করে কখন দেশে চলে আসব। চোখের সামনে ভাসতে থাকে পোড়া রোগীদের আর্তনাদ। রোগী, রোগীদের স্বজন আর চিকিৎসকদের মধ্যেই আমি আমার পরিবার খুঁজে পাই।’ 

সামন্ত লাল সেন ১৯৪৯ সালের ২৪ নভেম্বর হবিগঞ্জের নাগুরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। সেন্ট ফিলিস হাইস্কুল থেকে ১৯৬৪ সালে মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন সামন্ত লাল সেন। এরপর সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। ১৯৭৩ সালে তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন। ১৯৮০ সালে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা থেকে ‘ডিপ্লোমা ইন স্পেশালাইজড সার্জারি’ ডিগ্রি অর্জন করেন। পরবর্তীতে জার্মানি ও ইংল্যান্ডে সার্জারিতে আরও উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালে হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে কর্মজীবন শুরু করেন ডা. সামন্ত লাল সেন। পরে ঢাকায় বদলি হয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যোগ দেন। ১৯৮০ সালে তিনি  ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে যোগদান করেন। ২০০৩ সালে  বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারির জন্য স্বতন্ত্র একটি ইউনিট প্রতিষ্ঠা করা হয়। 

তিনি এ ইউনিটের প্রতিষ্ঠাকালীন পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে অবসরে যান। পরে সরকার তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের প্রধান সমন্বয়ক হিসেবে নিয়োগ দেয়। পরবর্তীতে এই ইউনিটটিকে স্বতন্ত্র একটি ইনস্টিটিউটে রূপান্তর করে ‘শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট’ নামে ২০১৯ সালের ৪ জুলাই এখান থেকে চিকিৎসাসেবা প্রদান শুরু হয়। শুরু থেকেই শেখ হাসিনা জাতীয়  বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের প্রধান সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন সামন্ত লাল সেন। চিকিৎসাসেবায় বিশেষ অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি তাকে ২০১৮ সালে সম্মানসূচক ফেলোশিপ দেয়। তিনি বাংলাদেশ প্লাস্টিক সার্জন সোসাইটির সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন।