- ভুয়া সনদে সিইও হতে চেয়েছেন এএমডি রফিকুল
- অবৈধভাবে দেড় কোটি টাকা ভাগবাটোয়ারা পাঁচ কর্মকর্তার
কারণ আছে বিধায় প্রশাসক তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে তারা এখন কোম্পানির কেউ নন
—মো. জাহাঙ্গির আলম, মুখপাত্র আইডিআরএ
আমার সার্টিফিকেট শতভাগ সঠিক। যারা মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন তাদের নামে মামলা করব
—রফিকুল ইসলাম, সদ্য সাবেক অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক
সম্প্রতি অনিয়মের দায়ে সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির পাঁচ কর্মকর্তাকে বহিষ্কার করে সোনালী লাইফ প্রশাসক। সীমাহীন অনিয়ম আর দুর্নীতির দায়ে কয়েক মাস আগে কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদ বাতিল করে প্রশাসক নিয়োগ করে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির সাবেক চেয়ারম্যান মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসের বিরুদ্ধে নামে-বেনামে কোম্পানির প্রায় ২০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। কিছুদিন আগে ওই পাঁচ কর্মকর্তা ছাড়াও আরও ১৩ কর্মকর্তাকে বহিষ্কার করে কোম্পানির প্রশাসন। তবে সে বহিষ্কারাদেশ মানতে নারাজ কোম্পানির কিছু কর্মকর্তা। এ নিয়ে তারা কোম্পানির কিছু কিছু কার্যালয়ে কর্মবিরতি ও ধর্মঘটও পালন করেন। আর্থিক অনিয়ম, শৃঙ্খলা ভঙ্গ, সনদ জালিয়াতিসহ বিভিন্ন অভিযোগে বরখাস্ত হওয়া পাঁচ কর্মকর্তাকে পুনর্বহালের দাবি জানিয়েছেন সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের কর্মকর্তা ও মাঠকর্মীরা। তারা বলছেন, সোনালী লাইফ আইডিআরএর চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত আক্রোশের শিকার। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আইডিআরএ চেয়ারম্যানের পদত্যাগ ও বহিষ্কৃত কর্মকর্তাদের চাকরি ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানান এবং প্রশাসকের পদত্যাগেরও দাবি করেন।
সূত্রমতে, গত ২ জুলাই সোনালী লাইফ কর্মকর্তাদের নিয়মবহির্ভূতভাবে নেয়া আর্থিক সুবিধা বন্ধ করে দেয়া হয়। দাবি আদায়ে অংশ নেয়া কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে সোনালী লাইফের অনিয়মনের বিরুদ্ধে সুষ্ঠু তদন্ত বাধাগ্রস্ত করার অভিযোগও রয়েছে। এসব কর্মকর্তার নেপথ্য দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত সাসপেন্ড পরিচালনা পর্ষদের মদত রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এর আগে গত ২১ এপ্রিল সোনালী লাইফের ১৮৭ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদকে সাসপেন্ড করে প্রশাসক নিয়োগ করে আইডিআরএ।
বিমা কোম্পানিটির বরখাস্ত হওয়া কর্মকর্তারা হলেন অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ আবদুল্লাহিল কাফী ও গোলাম মোস্তফা, সহকারী ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মো. আজিম ও মো. মঞ্জুর মোর্শেদ।
সোনালী লাইফের আর্থিক অনিয়ম খতিয়ে দেখতে গত ১০ বছরের ব্যবসায়িক কার্যক্রম অধিকতর তদন্তের জন্য গত জুন মাসে হুদাভাসী অ্যান্ড কোম্পানিকে নিরীক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। নিরীক্ষার জন্য সময় দেয়া হয় তিন মাস। কিন্তু নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের চাহিদা মোতাবেক তথ্য প্রদানে নানাভাবেই বাধা প্রদানের অভিযোগ ওঠে কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে।
বহিষ্কৃত পাঁচজনের মধ্যে অন্যতম কোম্পানির অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম নানা অভিযোগে অভিযুক্ত। দৈনিক আমার সংবাদের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে তার অনিয়মের বিভিন্ন তথ্য। এছাড়া তার বিভিন্ন অপকর্ম নিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএকে চিঠিও দিয়েছে কোম্পানির বর্তমান প্রশাসক। জাল শিক্ষাসনদ দিয়ে সিইও হওয়ার আবেদন এবং আর্থিক অনিয়মের মতো ভয়াবহ অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএকে দেয়া প্রশাসকের চিঠি বিশ্লেষণে দেখা যায়, রফিকুল ইসলাম ভুয়া শিক্ষাসনদ দিয়ে সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির সিইও হিসেবে নিয়োগ পেতে আবেদন করেছেন। তার সেই শিক্ষাসনদ এসেছে আমার সংবাদের হাতে। তার শিক্ষাসনদ বিশ্লেষণে দেখা যায় রফিকুল ইসলামের ডিগ্রি এবং মাস্টার্সের দুটো সার্টিফিকেটই জাল। তিনি মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ লাভের জন্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষার যে দুটি সার্টিফিকেট দাখিল করেছেন, সেগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায় তার স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের রেজিস্ট্রেশন নম্বর একই; স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে ভর্তি হয়েছেন একই সালে এবং একই সেশনে করেছেন স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস। শুধু তা-ই নয়, সনদ প্রদানের তারিখও একই। তার দুই সনদ অনুযায়ী রেজিস্ট্রেশন নম্বর ২৮৯৫৩ সেশন ১৯৯৫ থেকে ৯৬ এবং সনদ প্রদানের তারিখ ২০০০ সাল। বিমা আইন ২০১০-এর ধারা ১৩১ বিধানমতে প্রতারণার মাধ্যমে জাল সনদে চাকরি করা ফৌজদারি আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। শিক্ষা-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে একই সেশনে ভর্তি, একই রেজিস্ট্রেশন নম্বর, একই বছরে দুটো সার্টিফিকেট অর্জন অসম্ভব এবং নিঃসন্দেহে এটি ভুয়া।
এ বিষয়ে জানতে সোনালী লাইফের সদ্য সাবেক অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল ইসলামকে বারবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। পরবর্তীতে মুঠোফোনে ক্ষুদেবার্তার মাধ্যমে জানতে চাওয়া হলে তিনি আমার সংবাদকে বলেন, আমার সার্টিফিকেট শতভাগ সঠিক। এই তথ্য পুরোটাই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, বানোয়োট ও মিথ্যা। তিনি ওই ক্ষুদেবার্তায় এও বলেন, যারা এই তথ্য প্রকাশ করেছেন, তাদের নামে তিনি মানহানির মামলা করবেন।
আইডিআরএকে লেখা কোম্পানির প্রশাসক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এসএম ফেরদৌস স্বাক্ষরিত এ-সংক্রান্ত এক চিঠিতে বলা হয়, মো. রফিকুল ইসলাম কোম্পানির অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকা অবস্থায় কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ বাতিলের এক দিন আগে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করেই দেড় কোটি টাকা ক্যাশ ইনসেনটিভ হিসেবে উপস্থাপন করে অনুমোদন করিয়ে নেন। কোম্পানির মোট পাঁচ কর্মকর্তা ৩০ লাখ করে ওই দেড় কোটি টাকা ভাগ করে নিয়েছিলেন, যা বিমা আইন, ২০১০-এর ধারা ৫৮-এর সঙ্গে পঠিতব্য ৫৯(২)-এর লংঘন এবং জরিমানাযোগ্য অপরাধ। এছাড়া নিয়োগকৃত প্রশাসক ও আইডিআরএর বিরুদ্ধে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পরিকল্পিত মিথ্যা, বানোয়াট অভিযোগ এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় অপ্রচারের অভিযোগও আনা হয় ওই চিঠিতে।
বহিষ্কার হওয়া কোম্পানির অপর কর্মকর্তা সদ্য সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল্লাহিল কাফী। তার বহিষ্কারাদেশের চিঠিতে বলা হয়, তিনি প্রচলিত নিয়ম ও শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে আইডিআরএ কর্তৃক সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে নিয়োগকৃত প্রশাসক এবং আইডিআরএর বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয়ে পরিকল্পিত, ভিত্তিহীন ও বানোয়াট অভিযোগ দাখিল করেন। শুধু তা-ই নয়, সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় বিভ্রান্তিমূলক তথ্য প্রচারের অভিযোগও আনা হয় তার বিরুদ্ধে।
আব্দুল্লাহিল কাফিও ওই দেড় কোটি টাকা থেকে ৩০ লাখ টাকা ইনসেনটিভ হিসেবে গ্রহণ করে, যা বিমা আইন, ২০১০-এর ধারা ৫৮-এর স্পষ্ট পরিপন্থি।
একই অভিযোগে বহিষ্কার করা হয় কোম্পানির অপর তিন কর্মকর্তা উপব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম মোস্তফা, সহকারী ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মো. আজিম এবং সহকারী ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মঞ্জুর মোর্শেদকে। কোম্পানির প্রশাসক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এসএম ফেরদৌস স্বাক্ষরিত ওই চিঠি বিশ্লেষণে দেখা যায়, এ তিনজনও আইডিআরএ এবং সোনালী লাইফ প্রশাসকের বিরুদ্ধে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পরিকল্পিত ও বানোয়াট অভিযোগ করেন এবং কোম্পানিতে কর্মরত উন্নয়নকর্মীদের মধ্যে পরিকল্পিতভাবে মিথ্যা তথ্য উপস্থাপনের মাধ্যমে তাদের একত্রিত করে প্রশাসকের বিরুদ্ধে অবস্থান ধর্মঘট, সব বিভাগে কর্মবিরতি পালনের প্রচারণায় সহায়তা ও অনুপ্রেরণাসহ কোম্পানির বিপক্ষে বিভিন্ন কুপরিকল্পনা প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নের চেষ্টায় লিপ্ত ছিলেন।
তাদের বহিষ্কারাদেশ চিঠিতে এও বলা হয়, তারা সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে প্রশাসকের সঙ্গে কর্মরত উপব্যবস্থাপক কাইয়ুম আহমেদকে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম তার কক্ষে ডেকে নিয়ে প্রশাসককে সহযোগিতা না করার নির্দেশ দেন। যদি প্রশাসককে তিনি সহায়তা করেন, তাহলে তাকে সপরিবারে জীবননাশের হুমকি দেয়া হয়।
এছাড়া তারা প্রত্যেকেই বিমা আইন, ২০১০-এর ধারা ৫৮-এর বিধান অমান্য করে ৩০ লাখ টাকা অতিরিক্ত ক্যাশ ইনসেনভি হিসেবে গ্রহণ করেন।
এ বিষয়ে আইডিআরএ কর্তৃপক্ষের মুখপাত্র মো. জাহাঙ্গির আলম দৈনিক আমার সংবাদকে বলেন, উপযুক্ত কারণ আছে বিধায় প্রশাসক তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছেন। এখন তারা যতই বিদ্রোহ করুক না কেন, তারা কোম্পানির কেউই নন। আইন প্রশাসককে এখতিয়ার দিয়েছে বলেই তিনি এ ব্যবস্থা নিতে পেরেছেন।