ফের কর্মসূচি পালন

আবারও বিক্ষোভ রাজপথে

সাহিদুল ইসলাম ভূঁইয়া প্রকাশিত: জুলাই ৩০, ২০২৪, ০২:২৪ পিএম
আবারও বিক্ষোভ রাজপথে
  • গোয়েন্দা হেফাজতে থাকা সমন্বয়কদের ‘ঘোষণা’ প্রত্যাখ্যান বাইরে থাকা সমন্বয়কদের  
  • এবারের কর্মসূচি ‘ছাত্র জনতার বিক্ষোভ’ ও ‘প্রতিবাদ সমাবেশর্’
  • ঢাকায় বিক্ষোভ চলাকালে আটক ২০ চট্টগ্রামে পুলিশ শিক্ষার্থী সংঘর্ষ
  • বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী-ছাত্রলীগ সংঘর্ষে আহত ১৫
  • শাবিপ্রবিতে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের বিক্ষোভ, কুবি রাবিতেও বিক্ষোভ

ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের হেফাজতে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলনের ছয় সমন্বয়কের আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণার বিপরীতে অবস্থান নিয়ে কর্মসূচি ঘোষণা করে ফের রাজপথে নেমেছেন অন্য সমন্বয়করা। তারা বলছেন, আন্দোলন প্রত্যাহারের এই ঘোষণা জোরপূর্বক আদায় করা হয়েছে। গতকাল রাজধানীসহ সারা দেশে ‘ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ’ কর্মসূচি এবং ‘প্রতিবাদ সমাবেশ’-এর ডাক দেন তারা। রাজধানীর ইসিবি চত্বর, সায়েন্স ল্যাব, ধানমন্ডি-১ নম্বর রোড, ধানমন্ডি-২ নম্বর রোড, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, নিউমার্কেট ও বাড্ডায় স্বল্পসময়ের জন্য বিভিন্ন স্লোগানে রাস্তায় অবস্থান নেন তারা। এদিকে শিক্ষার্থীদের এই বিক্ষোভ কর্মসূচির ঘোষণায় আগের পরিস্থিতি মাথায় রেখে আগাম মাঠে নামে পুলিশও। গতকাল সোমবার সকাল থেকেই ঢাকার রাস্তার গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও মোড়ে মোতায়েন করা হয় পুলিশসহ অন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের। ঢাকাসহ সারা দেশে বিজিবি সদস্যদের টহল জোরদার করা হয়। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় অব্যাহত রাখা হয় সেনা টহল। 

তবে গতকালের কর্মসূচি পালনে পূর্বের ন্যায় অবস্থান নিতে পারেননি আন্দোলনকারীরা। যদিও তাদের স্বল্পসময়ের অবস্থানের বিপরীতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও অবস্থান নেয় এবং ধড়পাকড় করে; সে কারণে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় কিছুটা উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। এ সময় বিভিন্ন সড়কে যানজটের সৃষ্টি হয়। গতকালের কর্মসূচি পালনকালে ঢাকার একাধিক এলাকা থেকে অন্তত ২০ জনের মতো বিক্ষোভকারীকে আটক করে পুলিশ। বাড্ডা এলাকায় কিছুটা উত্তেজনার সৃষ্টি হলে পুলিশ খুব কম সময়ের মধ্যেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। সেখানে দায়িত্বরত সহকারী পুলিশ কমিশনার রাজন কুমার সাহা বলেন, কোটা আন্দোলনকারীরা তাদের কর্মসূচি প্রত্যাহার করেছে। এখন যারা মাঠে নামার চেষ্টা করছে, তারা দুষ্কৃতকারী। 

তিনি বলেন, আমরা জনগণের ও তাদের জান-মালের নিরাপত্তার জন্য যা কিছু করার, সেভাবেই ব্যবস্থা নিচ্ছি। 
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. ফারুক হোসেন বলেন, বিশৃঙ্খলাসহ যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় ঢাকায় পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। মানুষের জান-মালের নিরাপত্তায় মোড়ে মোড়ে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। 

এর আগে কোটা সংস্কারের মূল দাবি পূরণ হওয়ায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম রোববার রাতে সব কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। আরও পাঁচ সমন্বয়কের উপস্থিতিতে এক ভিডিও বার্তায় তিনি এ ঘোষণা দেন। এ ঘোষণা আসার আগে থেকেই তারা ডিবির হেফাজতে ছিলেন এবং ডিবি কার্যালয় থেকেই ওই ভিডিও বার্তা দেয়া হয়। নিরাপত্তাজনিত কারণেই তারা সেখানে থাকছেন বলে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়। লিখিত বক্তব্যে নাহিদ বলেন, ‘আমাদের প্রধান দাবি ছিল কোটার যৌক্তিক সংস্কার, যা সরকার ইতোমধ্যে পূরণ করেছে। এখন শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দ্রুত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার জন্য সরকারের প্রতি জোর আহ্বান জানাই। সার্বিক স্বার্থে এ মুহূর্ত থেকে আমরা কর্মসূচি প্রত্যাহার করছি’— বলেন নাহিদ। তবে কর্মসূচি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে ফের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলনের আরও তিন সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসুদ, মাহিন সরকার ও সহ-সমন্বয়ক রিফাত রশীদ। ফেসবুকে তিনজনের একটি ছবি শেয়ার করে এক পোস্টে রিফাত রশীদ লেখেন, সিনিয়ররা আগেই নির্দেশনা দিয়েছিলেন এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলনের শুরু থেকেই নীতিগত সিদ্ধান্ত ছিল সমন্বয়কদের মাঝে এক গ্রুপকে তুলে নিয়ে গেলে বাকিরা নেতৃত্ব দেবেন। কাউকে যদি আটক করে জোরপূর্বক কোনো বিবৃতি আদায় করা হয়, তবে আমরা সেটা না মেনে যারা মাঠে থাকবেন, তারা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। ওই পোস্টে তিনি লেখেন, জোরপূর্বক আদায় করা বিবৃতি বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ প্রত্যাখ্যান করছে।

গতকাল বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলনের আরেক সমন্বয়ক আব্দুল কাদের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ছয় সমন্বয়কের ‘ঘোষণা’ প্রত্যাখ্যান করে নতুন কর্মসূচির ঘোষণা দেন। গতকাল সোমবার সারা দেশে ছাত্র-জনতার অংশগ্রহণে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশ করার ঘোষণা দেন তিনি। এর সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন রাজধানীর বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এ নিয়েই মূলত গতকাল সকাল থেকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সতর্ক অবস্থান নেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর সদস্যরা।

উত্তরার সড়কে গতকাল পুলিশের উপস্থিতি ছিল ব্যাপক। জমজম টাওয়ার এলাকায় সারি সারি পুলিশের গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখতেও দেখা যায়। এছাড়া জাতীয় প্রেস ক্লাব, নয়াপল্টন, মিরপুর-১০, সায়েন্স ল্যাবসহ ঢাকার অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি ছিল বেশ। 

এদিকে একই কর্মসূচিতে চট্টগ্রামেও পুলিশ ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। একপর্যায়ে পুলিশ শিক্ষার্থীদের লক্ষ করে টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। বিকাল ৪টার দিকে নগরের কোতোয়ালি থানার চেরাগী পাহাড় মোড়ে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। এর আগে বেলা সাড়ে ৩টা থেকে সেখানে জড়ো হয়ে শিক্ষার্থীরা স্লোগান দিতে থাকেন। ঘটনাস্থলে থাকা পুলিশ তাদের সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। পরে পুলিশ শিক্ষার্থীদের লক্ষ  করে টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। এর ফলে শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। পরবর্তীতে কয়েকজন শিক্ষার্থী জড়ো হওয়ার চেষ্টা করলে সেখান থেকে সাতজনকে আটক করে পুলিশ। কর্মসূচির অংশ হিসেবে নোয়াখালী-কুমিল্লা আঞ্চলিক মহাসড়ক অবরোধ করেছেন শিক্ষার্থীরা। বেলা ৩টার দিকে নোয়াখালী জিলা স্কুলের সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন তারা। এতে প্রায় আড়াই ঘণ্টা ধরে সোনাপুর-কুমিল্লা আঞ্চলিক মহাসড়কে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ থাকে। নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, আব্দুল মালেক উকিল মেডিকেল কলেজ, নোয়াখালী জিলা স্কুলসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিলে যোগ দেন। 

বিক্ষোভকারীরা জানান, দেশব্যাপী ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর হামলায় শিক্ষার্থী নিহতের বিচার ও  বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলনের দেয়া ৯ দফা দাবিতে তারা বিক্ষোভ করছেন। শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ চলাকালে নোয়াখালী-কুমিল্লা আঞ্চলিক সড়কে বিপুলসংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যকে দেখা যায়। একই কর্মসূচি পালনের সময় বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর ফের হামলা চালায় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। এ ঘটনায় প্রায় ১৫ শিক্ষার্থী আহত হন। আহতদের মধ্যে ৯ জনকে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। গতকাল দুপুর ২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের নিচে এ ঘটনা ঘটে। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কমিটি না থাকলেও হামলাকারীরা ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় বলে জানা গেছে। হামলার সময় বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থিত ছিলেন বন্দর থানার ওসি আবদুর রহমান মুকুল। 

তিনি বলেন, হামলার খবর শুনে আমরা উপস্থিত হয়ে তাদের নিবৃত্ত করি। আমরা যতদূর শুনেছি, আন্দোলনের পক্ষের ছাত্রদের সঙ্গে সাধারণ ছাত্রদের হাতাহাতিতে বেশ কজন আহত হন। আহতদের হাসপাতালে  পাঠানো হয়েছে। এছাড়াও হতাহতের প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেছেন সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) শিক্ষার্থীরাও। গতকাল বেলা ৩টা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে শতাধিক শিক্ষার্থী জড়ো হয়ে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন। বিক্ষোভের সময় শিক্ষার্থীরা ‘স্বৈরাচারের গদিতে আগুন জ্বালো একসাথে’, ‘গুলি করে আন্দোলন বন্ধ করা যাবে না’সহ বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন। এ সময় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সিলেটের অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদেরও কর্মসূচিতে যোগ দিতে দেখা যায়। সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক বন্ধ করে ভেতরে অবস্থান নেয় পুলিশ ও বিজিবি। একই সময়ে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান নেয় সেনাবাহিনী।

কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে শিক্ষার্থীদের নিহত হওয়ার ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত, বিচারসহ ৯ দফা দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও। গতকাল বিকাল ৪টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে বিক্ষোভ করেন তারা। একই দাবিতে প্রধান ফটকে গতকাল বেলা ৩টার দিকে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সতর্ক অবস্থানে থাকতে দেখা গেছে।