- দেশের ২৪ ব্যাংকের অবস্থা খুবই নাজুক
- স্বাধীন ব্যাংকিং কমিশন গঠনের সুপারিশ
- এফআইডি বাতিলের আহ্বান সিপিডির
আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্নীতি ও দলীয়করণের ফলে দেশের অনেক ব্যাংক এখন ‘ক্লিনিক্যালি ডেড’। গত ১৫ বছরে দেশের প্রায় দুই ডজনের বেশি ব্যাংক দলীয় লোকদের দিয়ে পরিচালনার পাশাপাশি বেনামি ঋণ বিতরণ, বিদেশে টাকা পাচার, ব্যাংকের টাকা আত্মসাতের মাধ্যমে এ খাতকে প্রায় পঙ্গু করে দিয়েছে— এমন অভিযোগ দেশের অর্থনীতিবিদদের। ডুবতে থাকা ব্যাংকের তালিকায় নাম উঠেছে তৃতীয় ও চতুর্থ প্রজন্মের বেশিরভাগ ব্যাংকের। এসব ব্যাংকের কোনো কোনোটির শেয়ারদর এক কাপ চায়ের চেয়েও কম। তালিকায় থাকা ব্যাংকগুলোর মধ্যে ইউসিবিএল ব্যাংককে নিজের পারিবারিক সম্পত্তির মতো ব্যবহার করে বিপুল অঙ্কের টাকা বিদেশে পাচার করেছেন সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী। আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীরের মালিকানাধীন ফার্মার্স ব্যাংকে ব্যাপক দুর্নীতির কারণে ভেঙে দেয়া হয় পরিচালনা পর্ষদ। পুনরুদ্ধারে নাম পাল্টে ‘পদ্মা ব্যাংক’ করলেও সেটিও ডুবন্ত অবস্থায় রয়েছে।
বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর অনিয়ম-দুর্নীতির গল্প দেশের সব মহলেরই জানা। বেসরকারি খাতের সবচেয়ে বড় ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশসহ সাত ব্যাংকের মালিকানা দেয়া হয় সরকারের ঘনিষ্ঠ চট্টগ্রামভিত্তিক শিল্পগ্রুপ এস আলমের হাতে। এই গ্রুপটির বিরুদ্ধে প্রায় ৫৩ হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ রয়েছে। আর এতে সহযোগিতা করেছেন আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকের সদ্য পদত্যাগকারী গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার। বিপুল অঙ্কের টাকা পাচার হলেও প্রভাব খাটিয়ে আদালতকে ব্যবহার করে পাচারের বিষয়ে তদন্তও বন্ধ করে দিয়েছে এই গ্রুপটি। এভাবে দেশের প্রায় ২৪টি ব্যাংক বেনামি ঋণ বিতরণ, লুটপাট, বিপুল অঙ্কের খেলাপি ঋণ নিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। এ তালিকা থেকে বাদ যায়নি রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, রূপালী ও অগ্রণী ব্যাংকও। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সবশেষ বোর্ড মিটিয়ে রূপালী ও অগ্রণী ব্যাংক বাদে সোনালী ও জনতাকে আগ্রাসী ঋণ বিতরণ ও আদায় কম হওয়ায় ভর্ৎসনা করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
গতকাল সোমবার রাজধানীতে এক সংবাদ সম্মেলনে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্ট্রাল ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) জানিয়েছে, ২০০৮ থেকে ২০২৩— এই ১৫ বছরে ২৪টি বড় ব্যাংক কেলেঙ্কারিতে প্রায় ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। ‘ব্যাংক খাতে সুশাসন ফিরিয়ে আনতে করণীয়’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে, বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা সমুন্নত রাখতে হবে এবং সময়মতো তথ্যের সত্যতা ও সহজলভ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। সিপিডি ব্যাংক খাতের স্বচ্ছতা আনতে একটি সুনির্দিষ্ট, সময়োপযোগী, স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও স্বাধীন ব্যাংকিং কমিশন গঠনের সুপারিশ করেছে। তারা বলছে, এই সংস্কার অবশ্যই রাজনৈতিকভাবে হতে হবে; কারণ স্বার্থান্বেষী মহল এতে বাধা তৈরি করবে।
বেশ কয়েকটি ব্যাংকের অবস্থা সংকটজনক হলেও বেইল আউটের মাধ্যমে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে উল্লেখ করে সিপিডি বলেছে, ধসের দ্বারপ্রান্তে থাকা ব্যাংকগুলোকে বন্ধ করে দিতে হবে।
সিপিডির তথ্য অনুযায়ী, আত্মসাৎ করা অর্থের পরিমাণ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের প্রায় ১২ শতাংশ বা জিডিপির দুই শতাংশের সমান।
সিপিডির নির্বাহী ড. ফাহমিদা খাতুন আরও বলেন, তৃতীয় ও চতুর্থ প্রজন্মের বেশিরভাগ ব্যাংক এখন ‘ক্লিনিক্যালি ডেড’। কতগুলো ‘ক্লিনিক্যালি ডেড’— সেটার সুনির্দিষ্ট সংখ্যা আমার কাছে নেই। আমরা দেখেছি তৃতীয় ও চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংকগুলোর প্রায় সবগুলোই একেবারেই চলার মতো নয়। সেগুলোকে ‘ক্লিনিক্যালি ডেড’ বলা যায়। অধিগ্রহণের মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংককে দুর্বল করা হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন ড. ফাহমিদা।
তিনি এসব ব্যাংকের বোর্ড বিলুপ্ত করে, ম্যানেজমেন্ট পরিবর্তন করে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনারও পরামর্শ দেন।
আর্থিক খাত সংস্কারের জন্য কয়েকজন বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে ব্যাংকিং কমিশন গঠন করার পরামর্শ জানিয়ে সিপিডির নির্বাহী বলেন, এর জন্য আলাদা কোনো রুম, লোকবল বা ইনস্টিটিউটের প্রয়োজন নেই। এই কমিশন ব্যাংক খাতের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে তা সমাধানের সুপারিশ অর্থ মন্ত্রণালয়কে দেবে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করতে নিয়ম-নীতি প্রতিপালন করা ও নিয়োগে স্বচ্ছতা বাড়ানোর তাগিদও দেন এই অর্থনীতিবিদ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন ফিরিয়ে আনতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ (এফআইডি) বন্ধ করে দেয়ারও সুপারিশ করেছে সিপিডি।
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘পৃথিবীর সব দেশেই তো কেন্দ্রীয় ব্যাংক
আছে। সেখানে কী আলাদা কোনো সংস্থা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে এভাবে নিয়ন্ত্রণ করে? আমাদের দেশে তো এফআইডি আমরা তুলে দিয়েছিলাম। যদি আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে স্বাধীনতা দিতে পারি এবং স্বায়ত্তশাসন বজায় রাখতে পারি আর তারা যদি সংসদের কাছে তার জবাবদিহি করে, তাহলে এরকম দ্বৈতশাসন দরকার হয় না।’
এফআইডির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের চেয়ারম্যান, পরিচালক নিয়োগের ক্ষেত্রে অনিয়ম হয় অভিযোগ তুলে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এটা যে কীভাবে নিয়ম-কানুন না মেনে করা হয়, সেটা তো আমরা দেখেছি। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আমরা যদি শক্তিশালী ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে পারি, তাহলে আমরা নিশ্চিত হতে পারি এফআইডি না থাকলেও আমরা এটা করতে পারব।
স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেই তার সব দিক সামাল দিতে পারবে বলেও মনে করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। তার মতে, এফআইডি বিভাগটি বিলুপ্ত করার সময় এসেছে। এটিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলেও মত তার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ১৯৭২ সালে জারি করা হয় বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার। যার মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেই তার সব কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারত।
সিপিডির অভিযোগ, বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকাণ্ডে নানা ধরনের প্রভাব বিস্তারের জন্যই এফআইডি গঠন করা হয়েছিল।
ফাহমিদা খাতুন বলেন, অর্থনৈতিক অবদানে সহযোগিতার জন্য ব্যাংক খাতকে বিশদ কাঠামোগত সংস্কার করা দরকার। এর জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা দরকার, যা আমরা অতীতে দেখতে পাইনি। ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা, তারা ব্যাংক খাত ও অর্থনীতির অন্যান্য খাতকে পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট হবে। পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার-বিশ্লেষণ না করে নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়া বন্ধ করতে হবে।
এ সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হয়ে যাওয়া প্রত্যেকটি আর্থিক কেলেঙ্কারির তদন্ত ও প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায় আনারও দাবি জানায় সিপিডি।
সংবাদ সম্মেলনে সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান, গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।