ছাত্র-জনতার ওপর ছাত্রলীগ যুবলীগের গুলি
- স্বৈরাচার যুগের অবৈধ অস্ত্রধারীরা বিভিন্ন আন্দোলনে ঢুকে পড়ার শঙ্কা
- এক মাসেও স্বৈরাচার হাসিনা দলের ব্যক্তিদের অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার হয়নি
শত শত ছাত্র-জনতাকে গুলি করে হত্যা করেছে ছাত্রলীগ-যুবলীগ তাদের অবৈধ অস্ত্র সার্বভৌমত্বের জন্য বড় হুমকি
—আখতার হোসেন, নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব
প্রতিটি ক্যাম্পাসে-ওয়ার্ডে রয়েছে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের অবৈধ অস্ত্র। ৩৬ জুলাইয়ে যেখানেই শিক্ষার্থীরা ন্যায্য দাবি নিয়ে মাঠে নেমেছে, সেখানেই ছাত্রলীগ-যুবলীগ অবৈধ অস্ত্র উঁচিয়ে প্রকাশ্যে গুলি চালিয়েছে। তাদের গুলিতে নারী শিক্ষার্থীসহ শত শত ছাত্র-জনতা নিহত হয়েছেন। হাসিনা বাহিনীর হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে এখনো হাজার হাজার ছাত্র-জনতা হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন। স্বৈরাচারের পতনের পর নতুন উপদেষ্টার সরকার গঠনের এক মাস পার হলেও এখনো চিহ্নিত ব্যক্তিদের কাছ থেকে অস্ত্র উদ্ধার এবং তাদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। ছাত্র আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকা ব্যক্তিরা বলছেন, দ্রুত ছাত্রলীগ-যুবলীগের অস্ত্র উদ্ধার করা না গেলে নির্বিচারে গুলি চালানো বাহিনীটি পুনরায় যে কোনো সময় ছাত্র-জনতার ওপর আবার ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রতিবিপ্লবের মতো ঘটনার জন্ম দিতে পারে। এছাড়া আওয়ামী যুগের অবৈধ অস্ত্রধারীরা চলমান বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে হওয়া আন্দোলনেও ঢুকে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
সরেজমিনে কথা হয় গুলি করার দৃশ্য দেখা ফেনীর রাহাত ভূঁইয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, গত ৪ আগস্ট দুপুর ১টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত ফেনীর মহিপালে শিক্ষার্থীদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায় ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগ। ঘটনাস্থলেই তাদের গুলিতে ৯ জন মারা যান। পরে আরও দুজন নিহত হন। মোট ১১ জন ওইদিনের ঘটনায় শহীদ হন। এছাড়া শতাধিক মানুষ আহত হন বলেও রাহাতের দাবি। তিনি বলেন, ওইদিন ছাত্রলীগ-যুবলীগের অস্ত্রধারীদের গুলি জঙ্গিদেরও হার মানিয়েছে। একটুও ভুলতে পারছি না সেদিনের ঘটনা। রক্তাক্ত কত মানুষকে যে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠিয়েছি, তার হিসাব মেলাতে পারছি না। ফেনীর সংসদ সদস্য নিজাম হাজারী অস্ত্র ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তিনি ফেনীর প্রতিটি ওয়ার্ডে নেতাদের হাতে অস্ত্র তুলে দেন বলেও এই যুবকের দাবি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সেদিন প্রকাশ্যে শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালান ফেনী সদর উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও ছনুয়া ইউপি চেয়ারম্যান করিম উল্যাহ, জেলা যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও ফেনী পৌরসভার ২নং ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর লুৎফুর রহমান খোকন হাজারী, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি জিয়াউদ্দিন বাবলু, সদর উপজেলা ছাত্রলীগের শিক্ষা সম্পাদক ইমতিয়াজ ইমন, সদর উপজেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক শুসেন চন্দ্র শীলের দেহরক্ষী তানজীর। এছাড়া আরও কয়েকজন হেলমেট পরিহিত থাকায় তাদের চিহ্নিত করা যায়নি।
এমন ঘটনা শুধু ফেনীতেই নয়, সারা দেশেই ঘটেছে। গত ২০ জুলাই রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় ছিলেন আশ্রাফুল আমিন। তিনি বলেন, বিকালে যাত্রাবাড়ীর কাজলা এলাকায় পুলিশের পক্ষ থেকে সবার আগে প্রকাশ্যে গুলি চালায় ছাত্রলীগ-যুবলীগের স্থানীয় কাডাররা। তাদের হাতে ছিল অত্যাধুনিক অস্ত্র। তারা বেলা সাড়ে ৩টার দিকে যখন গুলি চালাতে চালাতে সামনে আসে, তখন ঘটনাস্থলেই তাদের নির্বিচার গুলিতে ১০-১২ জন ছাত্র-জনতা গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে যান। তারা ঘটনাস্থলেই মারা যান। এর আগের দিন সাইনবোর্ড এলাকাতেও ছাত্রলীগ-যুবলীগের গুলিতে ৫-৬ জন মারা যান বলে দাবি আশ্রাফুলের।
১৯ জুলাই রাজধানীর উত্তরায় লোমহর্ষক ঘটনার কথা জানান আন্দোলনে সম্পৃক্ত সানাউল হক সানী। তিনি বলেন, আমরা শান্তিপূর্ণভাবে উত্তরার রাজলক্ষ্মী এলাকায় আন্দোলন করছিলাম। বিকালের দিকে হঠাৎ ছাত্রলীগ-যুবলীগ আমাদের ওপর অতর্কিতভাবে গুলি চালায়। তাদের গুলিতে আমাদের ৮-৯ জন ভাই ঘটনাস্থলে পড়ে যান। যাদের ছয়জনকে তাৎক্ষণিক হাসপাতালে আনলে পুলিশ মৃত ঘোষণা করে। আরও অন্তত ২০ জন গুলিবিদ্ধ হন বলেও দাবি করেন সানী।
গত ৪ আগস্ট ধানমন্ডি এলাকা ও ঝিগাতলায় প্রকাশ্যে ছাত্রলীগের গুলির দৃশ্য দেখেছেন ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী মহিউদ্দিন। তিনি বলেন, দুপুর দেড়টার দিকে ঘটনাস্থলেই ছাত্রলীগ-যুবলীগের গুলিতে তিন শিক্ষার্থী নিহত হন। আরও অন্তত ১০ শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন বলে দাবি করেন এই শিক্ষার্থী।
রাজনীতিতে চোখ রাখা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত ১৬ বছর আওয়ামী লীগ দুঃশাসন চালিয়েছেন। ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে ছাত্রলীগ-যুবলীগ আওয়ামী লীগের পদধারী গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের হাতে অবৈধ অস্ত্র তুলে দিয়েছে। ৫ আগস্ট স্বৈরাচার হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলেও বাকি সব নেতাই দেশে আত্মগোপনে রয়েছেন। যৌথবাহিনীর বিশেষ অভিযানে থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্রগুলো একে একে ফেরত পাওয়া গেলেও গত ৩৬ জুলাই এবং আওয়ামী যুগে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশ্যে যেসব ব্যক্তি সাধারণ মানুষের ওপর গুলি চালিয়েছে, গণমাধ্যমে যেগুলোর চিত্র প্রকাশ হয়েছে, সেগুলো এখনো উদ্ধার হচ্ছে না। গুলি করা ব্যক্তিরাও আটক হচ্ছে না। কত হাজার হাজার অবৈধ অস্ত্র আওয়ামী অনুসারীদের কাছে আছে, তা এখনো অজানা। আওয়ামী যুগের অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও চিহ্নিত ব্যক্তিদের আটক করা না গেলে যে কোনো সময় ছাত্র-জনতার বিজয় অম্লান হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
একটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ পদে রয়েছেন ওমর ফারুক। তিনি বলেন, আমাদের প্রতিবেশী কয়েকটি দেশ আওয়ামী লীগকে কোটি কোটি টাকা অনুদান দিত। এখন আওয়ামী লীগ না থাকায় যারা বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দাবি নিয়ে বিভিন্ন আন্দোলন করছে, তাদের পেছনে খরচ করা হচ্ছে এবং নানা ইস্যু নিয়ে প্রতিবিপ্লবের ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। এসব আন্দোলনে যে কোনো সময় আত্মগোপনে থাকা ছাত্রলীগ-যুবলীগ ঢুকে পড়তে পারে এবং ছাত্রদের ওপর যেভাবে গুলি চালিয়েছিল, সেভাবে তারা আবারও পুরোনো রূপে ফিরতে পারে।
জানতে চাইলে নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব ও গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির আহ্বায়ক আখতার হোসেন আমার সংবাদকে বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ছাত্রলীগ-যুবলীগ ক্যাডাররা অবৈধ অস্ত্র উঁচিয়ে প্রকাশ্যে ছাত্র-জনতার ওপর বর্বরভাবে গুলি চালিয়েছে, যা সারা দেশের মানুষ দেখেছে। তাদের গুলিতে আমাদের শত শত শিক্ষার্থী নিহত, হাজার হাজার শিক্ষার্থী আহত হয়েছে। ঢাকাসহ সারা দেশে যেখানেই শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমেছে, সেখানেই তারা গুলি চালিয়েছে।
ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের অবৈধ অস্ত্র দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের জন্য এখন বড় হুমকি। আমরা বর্তমান সরকারকে অবগত করছি যে, ঢাকাসহ সারা দেশে এমন একটি জায়গাও নেই যেখানে ছাত্রলীগ গুলি চালায়নি। দেশের সব স্থানে হিংস্র কায়দায় তারা গুলি চালিয়েছিল। প্রতিটি ঘটনাস্থল থেকে ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করে ছাত্রলীগ-যুবলীগ ক্যাডারদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার এবং ছাত্র আন্দোলনে প্রদর্শন করা সব অস্ত্র উদ্ধারে আমরা জোর দাবি জানাচ্ছি।
একইসঙ্গে তাদের এমন শাস্তি নিশ্চিতের জোর দাবি জানাচ্ছি, যাতে ভবিষ্যতে এমন কোনো রাজনৈতিক শক্তি ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালানোর চিন্তা আর না করতে পারে। স্বৈরাচার হাসিনা পালালেও এখনো তার ক্যাডার বাহিনী প্রতিবিপ্লবের মতো অনেক ঘটনার জন্ম দিতে ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে।