ফেঁসে যাচ্ছেন ওরিয়ন চেয়ারম্যান

আনোয়ার হোসাইন সোহেল প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২৪, ১২:২৭ এএম
ফেঁসে যাচ্ছেন ওরিয়ন চেয়ারম্যান
  • অধরা অপকর্মের সহযোগী আলাউদ্দিন, শামীম ওসমান, মির্জা আজম
  • গ্রুপের চেয়ারম্যানসহ ছয়জনের ব্যাংক হিসাব জব্দ

ওরিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান, তার স্ত্রী ও সন্তানদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করার নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর ওরিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান তার রূপ বদলে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলে চালান লুটপাট। তবে দীর্ঘ ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে যেসব প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা ব্যবসায়িক পার্টনার ছিলেন তারা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে।  

গতকাল বুধবার ওরিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান ওবায়দুল করিমের ব্যাংক হিসাব জব্দ করার নির্দেশ দিয়েছে বিএফআইইউ। একই সঙ্গে তার স্ত্রী-সন্তানসহ ছয়জন ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবও স্থগিত রাখতে বলা হয়েছে। দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে এ সংক্রান্ত নির্দেশনা পাঠিয়ে অ্যাকাউন্ট জব্দ করতে বলেছে বিএফআইইউ। ব্যাংক হিসাব জব্দ করাদের ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে সব লেনদেন বন্ধ থাকবে। আগামী ৩০ দিন এসব হিসাবে কোনো ধরনের লেনদেন করতে পারবে না। প্রয়োজনে লেনদেন স্থগিত করার এ সময় বাড়ানো হবে।

লেনদেন স্থগিত করার এ নির্দেশের ক্ষেত্রে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ বিধিমালা সংশ্লিষ্ট ধারা প্রযোজ্য হবে বলে বিএফআইইউর চিঠিতে বলা হয়েছে। চিঠিতে ওবায়দুল করিম ও তার স্ত্রী আরজুদা করিম, ছেলে সালমান ওবায়দুল করিম, মেহেদি হাসান ও মেয়ে জারিন করিমের নামসহ জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া রেজাউল করিমের নামসহ জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যও দেয়া আছে।

বিএফআইইউর নির্দেশনায় আরও বলা হয়েছে, কোনো হিসাব স্থগিত করা হলে হিসাব সংশ্লিষ্ট তথ্য বা দলিল যেমন- হিসাব খোলার ফরম, কেওয়াইসি ও লেনদেন বিবরণী ইত্যাদি চিঠি দেয়ার তারিখ থেকে দুই কার্যদিবসের মধ্যে তাদের কাছে পাঠানোর জন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বলা হয়েছে। সম্প্রতি ওরিয়নের মালিকানাধীন সাতটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যাপক অনিয়ম পাওয়া গেছে। 

এসব প্রকল্পে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ক্ষমতাসীনদের ব্যবসায়িক অংশীদার বানিয়ে সরকারি অর্থ লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে ওরিয়ন গ্রুপের বিরুদ্ধে। এই শিল্প গ্রুপটি ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে একে একে সাতটি পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপনের নামে অন্তত আড়াই হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা করেছে ওরিয়ান গ্রুপ। আবার সরকারকে কোনো কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ না দিয়ে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ আরও সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগও উঠছে এই গ্রুপটির বিরুদ্ধে।

ধুরন্ধর ওবায়দুল করিম সরকারের প্রভাবশালী এমপি-মন্ত্রীদের ম্যানেজড করে অর্থ লুটপাটে ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তিনি নিজের সহযোগী হিসেবে ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন প্রভাবশালী এমপি-মন্ত্রীকে বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকানাও দিয়েছেন। যাদের মাধ্যমে টেন্ডার বা প্রতিযোগিতা ছাড়াই সরকারের কাছ থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বড় বড় প্রকল্প বাগিয়ে নেন ওবায়দুল করিম। 

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ওরিয়নের সাত বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকানায় থাকা আওয়ামী লীগ নেতারা হলেন মির্জা আজম, আলাউদ্দীন নাসিম ও শামীম ওসমান। বিদ্যুৎ খাতে মাফিয়া সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য ফেনী-১ আসনের আওয়ামী লীগের এমপি আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম। তার হাত ধরে গত সাড়ে ১৫ বছরে বেসরকারি বিদ্যুৎ খাতে মহালুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠজন হওয়ায় বিনা পুঁজিতে ওরিয়নসহ ব্যবসায়িক পার্টনার হয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্রের প্রকল্প থেকে বিদেশে পাচার করেছেন হাজার হাজার কোটি টাকা। 

ডাচ-বাংলা পাওয়ার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেডের ৩০ শতাংশ শেয়ারের মালিক ফেনী-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম। শুধু বিদ্যুৎ প্রকল্প নামে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে শত শত কোটি টাকা ঋণ নিয়ে বিদেশে পাচার করেছেন। জালিয়াতি ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে ঋণ নেয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। আলাউদ্দিন নাসিম ও তার মেয়ের নামে কানাডায় বাড়ি-গাড়িসহ বিপুল সম্পদের খোঁজ পাওয়া  গেছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক প্রটোকল অফিসার আলাউদ্দিন নাসিমকে দলের অনেক নেতা মিস্টার টোয়েন্টি পার্সেন্ট হিসেবে ডাকেন। তাকে ২০ পার্সেন্ট কমিশন না দিলে কোনো টেন্ডারই পেতো না ব্যবসায়ীরা। প্রকল্পের কাজ শুরুর আগেই আলাউদ্দিন নাসিম বুঝে নিতেন তার কমিশনের টাকা। তাকে ব্যবসায়ীরা শেখ হাসিনার ম্যানেজার বলেও ডাকতেন। 

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক এবং সাবেক বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী ও জামালপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য মির্জা আজমের সম্পদ গত ১৫ বছরে বেড়েছে ১২২ গুণ। আওয়ামী লীগ সরকারের টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকায় জামালপুর-৩ (মেলান্দহ-মাদারগঞ্জ) আসনের এ সংসদ সদস্যের বার্ষিক আয় বৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ৮২ গুণ। ১৫ বছরের ব্যবধানে মির্জা আজমের বার্ষিক আয় সাড়ে চার লাখ টাকা থেকে পৌনে চার কোটি টাকার কাছাকাছি পৌঁছেছে। গত পাঁচ বছরেই তার সম্পদ বেড়েছে পৌনে ২৬ কোটি টাকা।

আলোচিত-সমালোচিত প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা শামীম ওসমানও ওরিয়ন গ্রুপের মালিকানাভুক্ত কোম্পানির শেয়ার হোল্ডার। নারায়ণগঞ্জের কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকানায় আছেন প্রভাবশালী এই সংসদ সদস্য। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সরকার পতনের পর থেকে বিভিন্ন মন্ত্রী, এমপি, রাজনীতিক, সাবেক আমলাসহ বিভিন্ন ব্যক্তির অ্যাকাউন্ট জব্দ করেছে বিএফআইইউ। একইভাবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকেও বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কর ফাঁকির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। তবে এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন সাবেক সরকারের সুবিধাভোগী অনেকে।