- তিন মাসে আমানতকারী কমেছে সাড়ে ৪৭ হাজার
- ক্ষুদ্র আমানতকারীদের সাড়া মিলছে না
- বাড়ছে প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারীর সংখ্যা
বিল-বন্ডের সুদহার বাড়ায় আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কমছে আমানতকারীর সংখ্যা। ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানে (এনবিএফআই) মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে ব্যক্তি আমানতকারী কমেছে সাড়ে ৪৭ হাজারের বেশি। সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে দেশের মোট ৩৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ৩০৮টি শাখার তথ্য পর্যালোচনা করে এই তথ্য পাওয়া গেছে। তবে ক্ষুদ্র আমানতকারীর সংখ্যা কমলেও প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারীর ওপর ভর করে সার্বিক খাতে মোট আমানতে তেমন প্রভাব পড়েনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, চলতি বছরের এপ্রিল থেকে জুন সময়ে সাড়ে ৪৭ হাজার আমানতকারী আর্থিক প্রতিষ্ঠান ছেড়ে চলে গেছেন। এছাড়া আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে এখন আমানত সংগ্রহের চেয়ে ঋণ বিতরণের পরিমাণ বাড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালের মার্চ শেষে দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানতকারীর সংখ্যা ছিল চার লাখ ২৭ হাজার ৩৪১ জন। চলতি বছরের জুন শেষে আমানতকারীর সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে তিন লাখ ৭৯ হাজার ৭৩৭ জন। সেই হিসাবে তিন মাসে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানতকারীর সংখ্যা কমেছে ৪৭ হাজার ৬০৪ জন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২২ সাল থেকে নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধারাবাহিকভাবে আমানতকারী কমছে।
আর্থিক খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে আস্থাহীনতা ও অব্যবস্থাপনার কারণেই এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। তবে প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, মূল্যস্ফীতির চাপ এবং বন্ডে সুদহার বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে কিছু ক্ষুদ্র আমানতকারী তাদের হিসাব বন্ধ করেছেন। তবে বড় আমানতকারীদের অংশগ্রহণে সার্বিক আমানত কমেনি। খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঋণ জালিয়াতিসহ নানা অনিয়মের কারণে বেশ কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান দুর্বল হয়ে পড়েছে। এসব কারণে সাধারণ মানুষও এখন আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে আমানত রাখতে ভয় পান। যার কারণে প্রতি মাসেই আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানতকারীর সংখ্যা কমছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে যেভাবে তদারকি করার দরকার ছিল, সেটাও হচ্ছে না। এখন গ্রাহকের আস্থা ফেরাতে বাংলাদেশ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কায়সার হামিদ বলেন, ‘উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে কিছু ক্ষুদ্র আমানতকারী তাদের হিসাব বন্ধ করেছে। কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষুদ্র আমানত হিসাব প্রডাক্ট ছিল, যেগুলো এখন কম সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। তবে বড় আমানতকারী কমেনি। বিশেষ করে প্রাতিষ্ঠানিক আমানত বেড়েছে। ফলে সার্বিক আমানত প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক রয়েছে।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানতকারীর সংখ্যা কমেছিল তিন হাজার ৮৮০ জন। এর আগে ২০২৩ সালের চতুর্থ প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানতকারীর সংখ্যা কমেছিল ২৫ হাজার ৭৮২ জন। এর আগের তিন মাসে (এপ্রিল-জুন) এ সংখ্যা কমেছিল ১৮ হাজার ৪৯৩ জন। এছাড়া ২০২৩ সালের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) এ সংখ্যা কমেছিল ৩৫ হাজার পাঁচজন।
আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিএলএফসিএ) চেয়ারম্যান ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট ফাইন্যান্স কোম্পানি (আইআইডিএফসি) লিমিটেডের এমডি ও সিইও মো. গোলাম সরওয়ার ভূঁইয়া বলেন, জুন প্রান্তিকে আমানতকারীর সংখ্যা কমেছে। বাস্তবতা হলো এই সময়ে সরকারের বিল-বন্ডের সুদহার বেশি থাকায় আমানতকারীরা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে তাদের আমানত তুলে সেখানে রেখেছে। মানুষ তো টাকা রাখে লাভের জন্য। আর যেখানে বেশি লাভ পাবে সেখানেই তো তারা যাবেন।
নানা অনিয়মের কারণে মানুষ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলার কারণে আমানত তুলে নিচ্ছে কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে গোলাম সরওয়ার ভূঁইয়া বলেন, ‘বিভিন্ন কারণে কিছু আস্থার সংকট আছে। আমরা চেষ্টা করতেছি কীভাবে মানুষের আস্থা বাড়ানো যায়।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, জুন প্রান্তিকে এসব প্রতিষ্ঠানে আমানত বেড়েছে মাত্র ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ। তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিক (এপ্রিল-জুন) শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানত দাঁড়িয়েছে ৪৫ হাজার ১১৬ কোটি আট লাখ টাকা। আর প্রথম প্রান্তিক (জানুয়ারি-মার্চ) শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানত ছিল ৪৪ হাজার ৩০৪ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। সেই হিসাবে তিন মাসে আমানত বেড়েছে আট হাজার ১১৩ কোটি ৯ লাখ টাকা।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালের মার্চ শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ বিতরণের স্থিতি ছিল ৭৪ হাজার ৫২৯ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। আর তিন মাস পর (এপ্রিল-জুন) আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৭৪ হাজার ৯১৮ কোটি ৪১ লাখ টাকা। সে হিসাবে তিন মাসে ঋণ বিতরণ বেড়েছে ৩৮ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা।
আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে আমানত কমে যাওয়ায় আট বিভাগের সবশেষ দুটি প্রান্তিক হিসাব করে দেখা যায়, ঋণ এবং আমানত জমার পরিমাণ আগের তুলনায় শূন্য দশমিক শূন্য দুই শতাংশ কমেছে ঋণ ও আমানত রেশিও। চলতি বছরের (জানুয়ারি-মার্চ ’২৪) প্রান্তিকে ১ দশমিক ৬৮ শতাংশ থেকে কমে (এপ্রিল-জুন ’২৪) প্রান্তিকে ১ দশমিক ৬৬-তে দাঁড়িয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের জুন শেষে এনবিএফআইগুলোতে কোটি টাকার বেশি আমানত থাকা অ্যাকাউন্টের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে পাঁচ হাজার ২২৮টি। মার্চ শেষে এমন অ্যাকাউন্টের সংখ্যা ছিল পাঁচ হাজার ২০৪টি। অর্থাৎ তিন মাসে কোটি টাকার বেশি আমানত থাকা অ্যাকাউন্টের সংখ্যা বেড়েছে মাত্র ২৪টি।