বিশ্বমঞ্চে উঠছে বিপ্লবের ইতিহাস

আবদুর রহিম প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২৪, ১২:৩০ এএম
বিশ্বমঞ্চে উঠছে বিপ্লবের ইতিহাস

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গতকাল সোমবার ভোর ৫টা ৫ মিনিটে কাতার এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে সফরসঙ্গীদের নিয়ে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ছেড়ে যান তিনি। নিউইয়র্কের স্থানীয় সময় মঙ্গলবার (আজ) জাতিসংঘ সদর দপ্তরে ইউনূস-বাইডেন বৈঠকে বসবেন। নিরাপত্তারক্ষী ও গণমাধ্যমকর্মীসহ সব মিলিয়ে মোট ৫৭ জন প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গী রয়েছেন। সফরকালে নেদারল্যান্ডস, পাকিস্তান, নেপাল, ইউরোপীয় কমিশন প্রধান, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ উচ্চপর্যায়ের বৈঠক করবেন প্রধান উপদেষ্টা। যদিও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে আলোচনার কোনো সম্ভাবনা নেই বলে জানা গেছে।  

কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, এবার বিশ্বমঞ্চে উঠে আসবে নতুন বাংলাদেশের ইতিহাস। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে বাংলাদেশের নতুন ইতিহাসের কথা শুনতে বিশ্বনেতারা অপেক্ষায় রয়েছেন। এতদিন ইউনূসের কাছে সামাজিক ব্যবসা, বিভিন্ন দেশের পাঠ্যসূচিতে চিন্তা-দর্শনের প্রভাব, অর্থনীতির গতিশীলতার বিষয়ে তার গুরুত্বপূর্ণ কথা শুনলেও এবার বাংলাদেশের নেতৃত্ব নিয়ে যাওয়া ইউনূসের মুখে বিশ্বনেতারা শুনবেন রক্তস্রোতের বিজয়ের কথা। গুলির মুখে দাঁড়িয়ে আবু সাঈদ ও মুগ্ধরা কিভাবে জীবন দিয়ে বিপ্লব এনেছেন। তার ভাষণের বড় অংশে থাকবে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের বীরত্বগাথার ইতিহাস। ড. ইউনূস সরকার কিভাবে গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী দেশ সংস্কার করবেন সেগুলোও যুক্ত থাকবে। 

এছাড়া গত ১৫ বছরে দেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং দেশের সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে সরকারের অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ নিয়ে অস্বস্তিতে থাকা বিশ্বনেতাদের নতুনভাবে পাশে থাকার জন্যও আহ্বান জানাবেন তিনি। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির যুগ্ম সদস্য সচিব ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ আমার সংবাদকে বলেন, বাংলাদেশে গত ১৭ বছর থেকে কোনো নির্বাচিত সরকার নেই, তাই আগস্ট বিপ্লবের মধ্য দিয়ে দেশে যে ঐতিহাসিক পরিবর্তন ঘটে গেছে সেটা সম্পর্কে দুনিয়াবাসী জানতে চাইবেন। এত বড় স্বৈরশাসককে হটানোর পেছনে যে হাজারো তরুণ বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছে, তা বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে সারা দুনিয়াকে নাড়া দিয়েছে। এটা শুধু বক্তব্য দিয়ে নয়, সম্ভব হলে ছবি ও ভিডিও প্রদর্শনী করে দুনিয়াকে দেখানো প্রয়োজন, যাতে স্বৈরশাসকরা শিক্ষা নেয় আর সতর্ক হতে পারে। সাথে সাথে আমাদের শহীদদের ত্যাগ ও কুরবানি যেন সবার প্রেরণা হয়ে ওঠে, তেমনটা আমরা প্রত্যাশা করি। সাধারণ অধিবেশনে যেহেতু তাবত দুনিয়ার নেতারা থাকবেন, বাংলাদেশ সম্পর্কে যেন কোনো অপপ্রচারে তারা বিভ্রান্ত না হন, সে ব্যাপারে উনি সতর্ক থাকবেন, সেটা আমরা আশা করতে পারি। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা যে সবার জন্য সুফল বয়ে আনবে, সেটা আমাদের উন্নয়ন অংশীজনদের পরিষ্কার করে বুঝিয়ে বলা জরুরি।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক মাহিন সরকার আমার সংবাদকে বলেন, যেহেতু ড. ইউনূস দেশে প্রত্যাবর্তনের পর শহীদ এবং আহতদের এই অভ্যুত্থানের সর্বোচ্চ কৃতিত্ব দিয়েছেন, সেহেতু বিপ্লবের স্পিরিটকে তিনি সর্বোচ্চ সম্মান করেন। তিনি অবশ্যই বিশ্বনেতাদের কাছে রক্তস্রোতের বিজয়ের ইতিহাস তুলে ধরবেন। তার সব বক্তব্যে বিপ্লবের স্পিরিট আছে এবং আন্তর্জাতিক সব স্তরে তিনি এই বার্তা পৌঁছানোর ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবেন বলেই বিশ্বাস রাখি। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, এবার সরকার প্রধান হিসেবে ড. ইউনূসের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক নিয়ে রীতিমতো উচ্ছ্বসিত বিশ্বনেতারা। ২৫ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের দেয়া সংবর্ধনায় যোগ দিচ্ছেন ড. ইউনূস। সেখানে সাইড লাইনে এ দুই নেতার কুশলাদি বিনিময় হবে। জাতিসংঘ সফরকালে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী (সেক্রেটারি অব স্টেট) অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক হবে।

এবারের এই সম্মেলনের মূল আহ্বান হচ্ছে একযোগে সহযোগিতা, কেবল তাৎক্ষণিক সমস্যাগুলো সমাধান করতেই নয় বরং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী প্রতিষ্ঠানগুলোকে আধুনিকীকরণ করা, যাতে করে ভবিষ্যতের বৈশ্বিক হুমকিকে মোকাবিলা করা যায়।

জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস গত বছর এ বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছিলেন। তিনি বিশ্বনেতাদের ‘ভবিষ্যতের শীর্ষ সম্মেলন’-এর জন্য একত্রিত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি সতর্ক করেছিলেন যে, মানবতা এবং পৃথিবী ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে এবং বহুপাক্ষিকতায় নতুন করে অঙ্গীকার করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেয়া উচিত। এটি জাতিসংঘের মূল ভিত্তি এবং উদীয়মান সংকট মোকাবিলায় পুরোনো বৈশ্বিক কাঠামোগুলোর সংস্কার দরকার।

গত সপ্তাহে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে গুতেরেস পুনরায় উল্লেখ করেন, বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জগুলো সমাধানের চেয়ে দ্রুতগতিতে অগ্রসর হচ্ছে। তিনি রাজনৈতিক সংঘাত, জলবায়ু পরিবর্তন, সামাজিক বৈষম্য, ঋণের বৃদ্ধি এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো উদীয়মান প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণকে উদ্বেগজনক বিষয় হিসেবে তুলে ধরেন। দুদিনের শীর্ষ সম্মেলনে ১৩০টিরও বেশি দেশের নেতারা গাজা, ইউক্রেন এবং সুদানের যুদ্ধসহ অন্যান্য বিষয় নিয়ে আলোচনা করবেন। সেখানে একটি প্রধান প্রশ্ন রয়ে গেছে— নেতারা কি ভবিষ্যতের সহযোগিতার জন্য বাস্তব পদক্ষেপ নেবেন? সেখানে আরও একটি বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সম্মেলনের প্রধান নথির বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো, যেখানে রাশিয়া এবং কয়েকটি অন্যান্য দেশ চূড়ান্ত পাঠ্যটির বিরুদ্ধে আপত্তি জানিয়েছে।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো মানবাধিকার কর্মীরা যেমন- অ্যাগনেস কলামার্ড, নেতাদের এই মুহূর্তটি কাজে লাগানোর আহ্বান জানিয়েছেন। সতর্ক করে বলেছেন যে, এই সুযোগ হারানো ভবিষ্যতে মারাত্মক পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে পারে। উচ্চপর্যায়ের আলোচনায় উল্লেখযোগ্য বক্তৃতা অন্তর্ভুক্ত থাকবে, যার মধ্যে সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বিশ্বমঞ্চে শেষ বড় বক্তব্য থাকতে পারে। বাইডেনের ফোকাস, অন্যান্য নেতাদের মতো, সংঘাত সমাধানের দিকে থাকবে, যেখানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত লিন্ডা থমাস-গ্রিনফিল্ড সারা বিশ্বের যুদ্ধ-প্রভাবিত কোটি কোটি মানুষের মধ্যে আশা আনার গুরুত্বের ওপর জোর দিয়েছেন। গাজা এবং ইউক্রেনে ক্রমবর্ধমান সহিংসতা, পাশাপাশি বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্য সংঘাতের হুমকি এই সপ্তাহের আলোচনায় প্রধান বিষয় হিসেবে থাকবে। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস এবং ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান বক্তৃতা দেবেন। 

এদিকে, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ এবং সাধারণ পরিষদ উভয়েই বক্তব্য দেবেন, তার দেশে চলমান সংঘাতের ওপর আলোকপাত করবেন। এদিকে নিরাপত্তা পরিষদের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হলো এর পাঁচ স্থায়ী সদস্যের মধ্যে গভীর বিভাজন, যারা প্রত্যেকে ভেটো ক্ষমতা রাখে। যেখানে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স এবং ব্রিটেন ইউক্রেনকে সমর্থন করে। অন্যদিকে রাশিয়া, যারা ইউক্রেনে আগ্রাসন চালিয়েছে। চীনের সাথে রাশিয়া শক্তিশালী সামরিক ও অর্থনৈতিক জোট বজায় রেখেছে। এই বৈঠকে রাশিয়া এবং চীন উভয় দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা প্রতিনিধিত্ব করবেন।