- প্রশ্নবিদ্ধ নিয়োগ ও নানা অনিয়ম
- সাবেক মন্ত্রী তাজুল ইসলাম ও মায়া চৌধুরীর তদবিরে নিয়োগ
- নামমাত্র হাজিরা, ক্লাস বাদ দিয়ে করেন রড-সিমেন্টের ব্যবসা
সাবেক স্বৈরাচার সরকারের দুই মন্ত্রীর নির্দেশে নিয়োগপ্রাপ্ত কুমিল্লার লাকসাম উপজেলার ৩নং মুদাফফরগঞ্জ দক্ষিণ ইউনিয়নের অন্তর্গত কালিয়াপুর কাজিমুদ্দিন সৈয়দ আলী আলিম মাদ্রাসার অধ্যক্ষ অজিউল্যা এখনো রয়েছেন বহাল তবিয়তে। যিনি ২০১১ সালে লাকসাম-মনোহরগঞ্জের সংসদ সদস্য সাবেক স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলামের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য অসদুপায়ে অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ পান। তার নিয়োগে তৎকালীন মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ারও জোর তদবির ছিল। শুধু তাই নয়, তিনি নিজেও লাকসাম উপজেলা আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক। যে কারণে নিয়োগের পর থেকেই শিক্ষকতার চেয়েও তাজুল ইসলাম ও তার নিজস্ব পদের প্রভাবে করেছেন অনিয়ম-দুর্নীতি। দলীয় বিবেচনায় পরিচালনা করতেন মাদ্রাসার সব কার্যক্রম। মাদ্রাসার কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে তিনিই ছিলেন সর্বেসর্বা।
তিনি নিজেই কমিটি গঠন করতেন কাগজে-কলমে। যাদের নাম কমিটিতে রাখা হতো, তারাও জানতেন না কমিটিতে আছেন। তাদের সই জালিয়াতি করে মাদ্রাসার সব অর্থনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করতেন তিনি। স্থানীয়দের অভিযোগ, অধ্যক্ষ অজিউল্যা ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে মাদ্রাসা সংলগ্ন ঈদগাহের জায়গাও দখলে রেখেছেন। সেখানে তানকিয়া এন্টারপ্রাইজ নামে একটি দোকান ও দুটি গোডাউন নির্মাণ করেছেন, যেখানে নিজের রড সিমেন্টের ব্যবসা পরিচালনা করে আসছেন। মাদ্রাসা চলাকালীন দৈনিক হাজিরা খাতায়ও নামমাত্র স্বাক্ষর করেই ওই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেই সময় দিতেন তিনি। স্থানীয়রা আরও জানান, ঈদগাহের সামনে থাকা নিজেদের পারিবারিক জায়গাটিও ঈদগাহের নামে লিখে দিবেন জানিয়ে এলাকাবাসীর কাছ থেকে চাঁদা তুলে জায়গাটি ভরাটও করেন।
অথচ ভরাট শেষে আদৌ তিনি সেই জায়গাটি ঈদগাহকে বুঝিয়ে দেননি। এমন সব সুবিধা ভোগ করা অধ্যক্ষ অজিউল্ল্যাহর নিয়োগেও রয়েছে প্রশ্ন। স্থানীয় সূত্র জানায়, ২০১১ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে এই পদের জন্য অজিউল্যাসহ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন ১৫ জন গ্র্যাজুয়েট শিক্ষক। সে সময় ১৫ জনের মধ্যে ১২ জনের কাগজপত্রই তাজুল ইসলাম ও মায়া চৌধুরীর নির্দেশে সরিয়ে রেখে বাকি তিনজনকে পরীক্ষার বোর্ডে ডাকা হয়। মৌখিক পরীক্ষায়ও তৃতীয় হওয়া অজিউল্যাকেই অধ্যক্ষ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। যার নিয়োগই প্রশ্নবিদ্ধ, সেই অজিউল্যাই আবার প্রতিষ্ঠানটিতে জড়িয়ে পড়েন অবৈধ নিয়োগ-বাণিজ্যে। শিক্ষক থেকে শুরু করে দপ্তরি, প্রহরী, নৈশ প্রহরী, পিয়ন নিয়োগের জন্যও চাকরিপ্রার্থীদের গুনতে হতো লাখ টাকা।
স্থানীয় সূত্র জানায়, খোদ মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতার এক ছেলের বউয়ের নিয়োগের জন্যও ৫৫ হাজার টাকা ঘুষ নিয়েছেন তিনি। সাবেক এক প্রিন্সিপালের ছেলেকে নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে নিয়োগের জন্য নিয়েছেন দেড় লাখ টাকা। নৈশপ্রহরী হিসেবে নিয়োগের জন্য স্থানীয় একজনের কাছ থেকে নিয়েছেন দুই লাখ টাকা। বর্তমান পিয়নের কাছ থেকে নিয়োগের জন্য ঘুষ বাবদ নেয়া হয় পাঁচ লাখ টাকা। দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই ধারাবাহিক নিয়োগ-বাণিজ্যের মাধ্যমে রাতারাতি কোটিপতিও বনে গেছেন অজিউল্যা। পদোন্নতির ক্ষেত্রেও বাণিজ্য করতেন তিনি।
সূত্র জানায়, কোনো শিক্ষক পদোন্নতির যোগ্য হলেও অর্থের বিনিময়েই পদোন্নতি নিতে হতো তাদের। মাদ্রাসার এক শিক্ষককে প্রমোশন দেয়ার পর তার স্কেলের বাড়তি টাকা থেকেও প্রতি মাসে ৬৫০ টাকা করে কেটে নিতেন তিনি। এছাড়া শিক্ষক মৃত খালেক মৌলভীকে চাকরিচ্যুত করার ভয় দেখিয়ে তার কাছ থেকেও প্রতি মাসে ৪৫০ টাকা করে কেটে নিতেন। শুধু তাই নয়, বাড়ি নির্মাণের ক্ষেত্রেও মাদ্রাসা-সংলগ্ন তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে মালামাল নিতেও চাপ দেয়া হতো অভিভাবকদের। অন্যথায় ওই শিক্ষার্থীকে বিভিন্নভাবে হয়রানি করা হতো। এমনকি শিক্ষার্থীদের ফরম-ফিলাপও আটকে দেয়া হতো। যে কারণে বাধ্য হয়েই তার দোকান থেকে বাড়তি দামে মালামাল কিনতে বাধ্য হতেন অভিভাবকরা। তার বিরুদ্ধে ছাত্রীদের শারীরিক নির্যাতনেরও বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। তবে এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে (মুঠোফোনে) অধ্যক্ষ অজিউল্যা মাদ্রাসার শিক্ষকদের কাছ থেকে জানতে বলেন। এছাড়া পরিচয় দিয়ে কথা বলার পরও তিনি প্রতিবেদকের পরিচয় নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন। নিয়োগ-বাণিজ্যের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রশ্নই উঠে না।
এছাড়াও উপজেলা আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক পদের বিষয়টিও অস্বীকার করেছেন তিনি। জানতে চাইলে লাকসাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আব্দুল হাই সিদ্দিকী আমার সংবাদকে বলেন, অভিযোগ পেলে আমরা অবশ্যই যথাযথ বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করব। এতে কোনো সন্দেহ নেই।