রাজনীতিতে শিবির আলোচনা

আবদুর রহিম প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২৪, ০১:০১ এএম
রাজনীতিতে শিবির আলোচনা

হঠাৎ রাজনীতিতে শিবিরবিষয়ক আলোচনা চলছে। এ নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম, দেশি গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলছে গরম হাওয়া। একইভাবে নানা আলোচনা-সমালোচনা চলছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) রাজনীতিতে শিবিরের প্রকাশ্যে আসাকে কেন্দ্র করে। চলছে পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তিও। সম্প্রতি ঢাবিতে শিবির সভাপতি-সেক্রেটারির নাম প্রকাশ্যে এসে গেছে। একইসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও শিবির নেতাদের নাম প্রকাশ্যে এসেছে। যাদের নাম সামনে এসেছে, তাদের অধিকাংশই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সামনে থেকে সরকার পতনে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছেন। এ নিয়ে শিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি মঞ্জুরুল ইসলাম ঘোষণা দিয়েছেন, শিগগিরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হবে। একে একে অচেনা মুখগুলোর পরিচয় প্রকাশ পাওয়ায় দেশের কয়েকটি ছাত্রসংগঠনের মধ্যে ক্ষোভের প্রকাশ হতে দেখা যাচ্ছে। 

ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব আহ্বান জানিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৫ বছরে শিবিরের যত কমিটি রয়েছে, তা যেন প্রকাশ করা হয়। তিনি শিবিরকে ‘নিষিদ্ধ সংগঠন’ বলেও দাবি করেন। ছাত্রলীগের অপকর্মের দোসর বলেও মন্তব্য করেন তিনি। এই নেতার এমন আক্রমণাত্মক বক্তব্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষোভের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। 

তবে এ নিয়ে শিবির সভাপতি জানিয়েছেন, তারা কখনো গোপনে রাজনীতি করেননি। শিবির অতীত থেকে এখন পর্যন্ত প্রকাশ্যে রাজনীতি করছে। মিডিয়ায় তাদের খবর প্রচার না হওয়ায় জনগণ সত্যে জানতে পারেনি। এ নিয়ে অন্য ছাত্রসংগঠনগুলো বলছে, ছাত্রদল সভাপতি শিবির নিয়ে সম্প্রতি যে মন্তব্য করেছে, তা রাজনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত। তবে সব ছাত্রসংগঠনই চাচ্ছে শিবির যেন এখন প্রকাশ্যে রাজনীতির মাঠে আসে। 

এ নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি মঞ্জুরুল ইসলাম আমার সংবাদকে বলেন, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রকাশ্যেই রাজনীতি করে আসছে। এখন যে বা যারা আমাদের বলছেন আমরা গোপন সংগঠন, তারা মিথ্যাচার করছেন। বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদের অধিকারসহ গণতান্ত্রিক সব আন্দোলনে ইসলামী ছাত্রশিবিরের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। ঢাবিসহ সব জায়গায় আমরা ওপেন রাজনীতি করেছি। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলেও সত্যি— মিডিয়া ছাত্রশিবিরের সংবাদগুলো প্রকাশ করেনি। মিডিয়াকে এতদিন সরকার নিয়ন্ত্রণ করেছে; তাই নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ার কারণে ঢাবিসহ সারা দেশ থেকে শিবিরের কার্যক্রম গণমাধ্যমে সেভাবে প্রচার করা হয়নি। এখন যেহেতু মিডিয়া থেকে সরকারের নিয়ন্ত্রণ কিছুটা কমেছে, তাই ধীরে ধীরে শিবির সম্পর্কে সবাই অবহিত হচ্ছেন। কিন্তু শিবিরের কার্যক্রম প্রতিষ্ঠাকালীন থেকে বাংলাদেশের সব যৌক্তিক আন্দোলনে সম্পর্কিত ছিল। ছাত্রদের পক্ষে সব সময় শিবির কাজ করেছে। সেগুলো এতদিন ধামাচাপায় ছিল। আমরা অতীতেও প্রকাশ্যে রাজনীতি করেছি; ইনশাআল্লাহ আগামীতেও প্রকাশ্য রাজনীতি করব।

বাংলাদেশ জাতীয় ছাত্রসমাজের কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম আমার সংবাদকে বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবির প্রকাশ্যে রাজনীতিতে আসায় আমি তাদের স্বাগত জানাই। কিন্তু তারা মাত্র গুটিকয়েক প্রকাশ্যে এসেছে।  তাদের অনেকেই এখনো আড়ালে রয়েছে। আমি মনে করি তাদের এখন রাজনীতিতে প্রকাশ্যে আসা উচিত। তারা যদি অন্যান্য ছাত্রসংগঠন কিংবা বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে রাজনীতি করে, তাহলে তা দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য একটা থ্রেট হবে। অনুপ্রবেশের মাধ্যমে রাজনীতিতে এলে অনেক আশঙ্কা থেকে যায়। তারা যদি গোপনে থেকে ভিন্ন কোনো রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের চেষ্টা করে, তাহলে ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য তা ভয়াবহ হুমকি বলে আমি মনে করি। তাদের গোপনীয়তার কারণে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের জন্য একটা থ্রেট (হুমকি) হয়ে থাকবে। তাই আমি মনে করছি  ভবিষ্যতে ফ্যাসিবাদের দোসর ছাড়া সবারই রাজনীতিতে প্রকাশ্যে আসা উচিত। একইসঙ্গে এও বলছি, সম্প্রতি ছাত্রদল সভাপতি শিবির সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছেন,  এটি অবশ্যই রাজনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত। এমন আক্রমণাত্মক আচরণ রাজনীতিতে কখনই  শোভন নয়।

ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে এ নিয়ে বলেছেন, বিগত সাড়ে ১৫ বছর ধরে ছাত্রদল প্রতিটি ক্যাম্পাসে কমিটি দিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করেছিল। আমরা পূর্ণাঙ্গ কমিটি প্রকাশের মাধ্যমে প্রকাশ্যে দিবালোকে কার্যক্রম পরিচালনা করেছি। ছাত্রশিবিরকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে একটি গোপন ও নিষিদ্ধ সংগঠন রয়েছে; তারা সাড়ে ১৫ বছর ছাত্রলীগের পতাকাতলে এবং তাদের আশ্রয়ে থেকেছিল; তাদের একজনও প্রকাশ্যে আসার সাহস পায়নি। 

‘আমরা দাবি জানাচ্ছি, যদি নৈতিক সাহস থেকে থাকে, তাহলে বিগত সাড়ে ১৫ বছরের প্রতিটি কমিটি আপনারা প্রকাশ করুন। আমরা দেখতে চাই এ সমুয়ে আপনাদের ব্যানারে কারা কারা ছাত্ররাজনীতি করেছে। ছাত্রসমাজ জানতে চায়, আপনাদের নেতাকর্মী কারা। তিনি বলেন, যদি তাদের (শিবির) কমিটি প্রকাশ হয়, দেখবেন ছাত্রলীগের অপকর্মের দোসররাই তাদের নেতাকর্মী। এরকম সংগঠন আগামী দিনে কোনো ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকলে সঙ্গে সঙ্গে আমরা ব্যবস্থা নেব।’

গত সাড়ে ১৫ বছরে হাসিনা সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ছাত্রদল নীতি-আদর্শকে বুকে ধারণ করে সব ক্যাম্পাসে রাজনীতি করেছে। এ সময়ে আমরা একটি দিনের জন্যও পরিচয় লুকিয়ে রেখে কোনো ক্যাম্পাসে প্রবেশ করিনি। আমরা ছাত্রলীগ কিংবা ফ্যাসিস্টদের দোসরদের সঙ্গে হাত মেলাইনি। আমার ভাইদের গুলি করা হয়েছে, হত্যা করা হয়েছে; তারপরও আমাদের সহকর্মীরা ভয় পেয়ে রাজপথ ছেড়ে যায়নি। সেভাবেই ফ্যাসিস্টদের মোকাবিলা করে আজ আমরা হাসিনামুক্ত বাংলাদেশে বসবাস করছি। এক্ষেত্রে গোপন কোনো সংগঠনের বাধা থাকলে আমরা দাঁতভাঙা জবাব দেব। 

তিনি বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কৃতিত্ব নিয়ে অনেক গোপন সংগঠন অনেক কৃতিত্ব দাবি করছে; এসবে আমরা ছাত্রদলকর্মীরা মুচকি মুচকি হাসছি। যে কোনো ধরনের ষড়যন্ত্র করলে বাংলাদেশ থেকে উচ্ছেদ করার হুঁশিয়ারি দিয়ে তিনি আরও বলেন, আপনারা (শিবির) এমন কোনো ষড়যন্ত্র করবেন না যেন ১৯৭১ সালের মতো আপনাদের আবার বড় ধরনের বিচারের মুখোমুখি হতে হয়। এভাবে এই গোপন সংগঠনের তৎপরতার মাধ্যমে ইতোমধ্যে সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের বয়কট করেছে।  সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও আপনারা  তাদের দেখেছেন।

ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি জাহিদুল ইসলাম এক বিবৃতিতে বলেন, সম্প্রতি ছাত্রদল সভাপতির একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকেই লেখালেখি করছেন। আমরা আমাদের সব দায়িত্বশীল কর্মী ও ভাইদের প্রতি কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া না দেখানোর আহ্বান জানাচ্ছি। ব্যক্তি ও দলীয় বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় ঐক্যকে প্রাধান্য দিতে চাই উল্লেখ করে তিনি বলেন, ছাত্র-জনতার বিপ্লবের অন্যতম স্পিরিট হলো জাতীয় ঐক্য ও ফ্যাসিবাদ নির্মূল। তাই আমাদের সবাইকে উদারতা ও দায়িত্বশীল আচরণ অব্যাহত রাখতে হবে। মহান আল্লাহ আমাদের ধৈর্য ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে কাজ করার তাওফিক দান করুন।