পোশাক খাতে সৃষ্ট অস্থিরতা যেন থামছেই না। এবার ঘটল প্রাণহানির ঘটনাও। গতকাল সোমবার ঢাকার অদূরে সাভারের আশুলিয়ায় তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিকদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া-সংঘর্ষের ঘটনায় গুলিতে এক শ্রমিক নিহতের ঘটনা ঘটে। আহত হয়েছেন অন্তত পাঁচজন। আহতদের সাভারের বেসরকারি একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এদিকে সংঘর্ষের সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর বেশ কয়েকটি গাড়িও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।
গতকাল দুপুরে আশুলিয়ার টঙ্গাবাড়ি এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত ব্যক্তি হলেন ম্যাংগো টেক্স লিমিটেড নামে একটি কারখানার সুইং অপারেটর কাওসার হোসেন খান (২৭)। তার বাড়ি বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার মধ্য রতনপুর এলাকায়। আহতরা হলেন আশুলিয়ার ন্যাচারাল ডেনিমসের শ্রমিক হাবীব, ন্যাচারাল ইন্ডিগো লিমিটেডের মো. নাজমুল হোসেন, মো. ওবায়দুল মোল্লা, রাসেল মিয়া ও নয়ন।
সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইনচার্জ মো. ইউসুফ বলেন, দুপুরে গুলিবিদ্ধ পাঁচজনকে হাসপাতালে আনা হয়েছে। এর মধ্যে একজনকে মৃত অবস্থায় আনা হয়। গুলিবিদ্ধ বাকি চারজনকে ভর্তি করা হয়েছে।
বিভিন্ন কারখানার শ্রমিক ও শ্রমিক সংগঠনের নেতারা জানান, গতকাল সোমবার সকালে মণ্ডল নিটওয়্যার লিমিটেড কারখানা খুলে দেয়া, দুজন শ্রমিক নিখোঁজের অভিযোগ ও শ্রমিকদের মারধরসহ নানা বিষয় নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী, শ্রমিক ও মালিকপক্ষ আলোচনায় বসে। একপর্যায়ে শ্রমিকরা বাইরে বের হয়ে আসেন। এ সময় পাশের ন্যাচারাল ডেনিম ও ন্যাচারাল ইন্ডিগো কারখানার শ্রমিকদের মাঝে মণ্ডলের শ্রমিকদের আটকে রেখে মারধর করা হচ্ছে— এমন কথা ছড়িয়ে পড়ে। পরে এ দুটি কারখানার শ্রমিকরা কারখানা থেকে বের হয়ে মণ্ডল নিটওয়্যার লিমিটেড কারখানার সামনে বিক্ষোভ করেন। এ সময় আশেপাশের কিছু কারখানার শ্রমিকও তাদের সঙ্গে যোগ দেন। একপর্যায়ে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করেন। এরপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের ধাওয়া দেন। পরে উভয় পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় গুলিতে কয়েকজন আহত হন। এছাড়া উভয় পক্ষের অন্তত ১০-১৫ জন আহত হন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে আশুলিয়া শিল্পাঞ্চল পুলিশ-১-এর একজন কর্মকর্তা বলেন, বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর বেশ কয়েকটি গাড়ির কাচ ইটপাটকেল ছুড়ে ভেঙে ফেলেন। শিল্প পুলিশের এসপি, র?্যাবের অতিরিক্ত পুলিশ সুপারসহ কয়েকজন আহত হন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাবার বুলেট ব্যবহার করা হয়েছে।
ন্যাচারাল ডেনিম কারখানার একজন শ্রমিক বলেন, মজুরি নিয়ে সমস্যা, দুজন শ্রমিক নিখোঁজ— এসব নিয়ে মণ্ডল কারখানার শ্রমিকদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করতে আমরা গেয়েছিলাম। মণ্ডলের শ্রমিকদের আটকে মারধর করছে— এটাও শুনেছিলাম। বেলা ১১টার দিকে ওখানে গেয়েছিলাম, ন্যাচারাল ইন্ডিগো কারখানার শ্রমিকরাও গেয়েছিল। ওখানে যাওয়ার পর প্রশাসন ও সাধারণ শ্রমিকরা মুখোমুখি হয়। দুই পক্ষেরই পালটাপালটি ধাওয়া হয়। শ্রমিকরা যখন গাড়ি ভাঙচুর করছে, ওদের ওপর চড়াও হয়েছে, তখন তারা গুলি ছুড়ছে। দেখেছি তিনজনের গুলি লেগেছে; একজন মারা গেছে। দুজনকে এনাম মেডিকেলে নিয়ে রাখা হয়েছে।
বাংলাদেশ গার্মেন্ট ও সোয়েটার্স শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের আইনবিষয়ক সম্পাদক খায়রুল মামুন বলেন, গত কদিনে আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলের সার্বিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল। কিন্তু আজকে (সোমবার) একজন শ্রমিক নিহত ও একাধিক শ্রমিক আহতের ঘটনা কাম্য নয়। যেখানে সমস্যার সমাধান হয়ে যাচ্ছিল, সেখানে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন মণ্ডল নিটওয়্যারে কেন এ ধরনের ঘটনা ঘটল। দ্রুত এ সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নিতে হবে, না হলে এ শিল্প খাতটি গভীর সংকটের মুখে পড়বে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তবে শ্রমিক নিখোঁজের গুজব রটিয়ে কারখানায় অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ)। গতকাল বিজিএমইএর জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আবদুল্লাহ হিল রাকিব সংবাদ সম্মেলন ডেকে এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, কারখানার নিরাপত্তা নিয়ে পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা অসন্তুষ্ট। তাদের অভিযোগ, নিখোঁজের গুজব রটিয়ে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করা হচ্ছে। সময়মতো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতা মিলছে না। রাকিব আরও বলেন, আমরা নিরাপত্তার দাবি জানাচ্ছি, তা না হলে শ্রমিক অসন্তোষের কারণে আমাদের কারখানাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
সম্মেলনে কারখানা মালিকরা বলেন, শ্রমিকদের ১৮ দফা দাবি আদায়ের পরও পোশাক খাতে অসন্তোষ বিরাজ করছে। কারণ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির সুযোগ নিয়ে কিছু মহল গুজব ছড়াচ্ছে। বিজিএমইএর সদস্যরা জানান, নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব সরকারের। এ বিষয়ে কঠোর অবস্থান নিতে হবে। তদন্ত করে নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তৈরি পোশাকশিল্পে সরাসরি প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক নিয়োজিত। আর পরোক্ষভাবে উপকারভোগী কমপক্ষে দুই কোটি মানুষ। এ শিল্প বিপদে পড়লে বিশাল জনগোষ্ঠী বিপদে পড়বে, ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের অর্থনীতি।