স্বৈরাচার হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর প্রায় তিন মাসে পা দিচ্ছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার। এখনও ছাত্র-জনতার রক্তস্রোতের বিজয়ের স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয়নি। দেশের সচেতন মহল থেকে আসছে নানা হতাশার কথা। ছাত্র-জনতার বুকে গুলি চালানো ঘাতকরা অনেকেই পালিয়ে গেছেন। আবার অনেকেই এখনো আত্মগোপনে রয়েছেন। যারা আটক হয়েছেন তাদেরও প্রত্যাশা অনুযায়ী বিচার শুরু হয়নি। দেশের গুরুত্বপূর্ণ সব সেক্টরেই বসে আছেন হাসিনার দোসররা। হাসিনার অনুগত আমলা প্রশাসন দিয়েই চলতে হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারকে।
এমন জনআকাঙ্ক্ষাকে সামনে রেখে শিগগিরই নির্বাচনব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, সংবিধান ও দুর্নীতি দমন বিষয়ে সংস্কারে উদ্যোগী হয়েছে ড. ইউনূস সরকার। এজন্য দেশের অন্যতম রাজনৈতিক দলগুলো থেকে নেয়া হবে পরামর্শ। সংস্কারে যদি রাজনৈতিক দলগুলোর প্রস্তাব থেকে থাকে সেগুলোও অন্তর্বর্তী সরকার গ্রহণ করবে। অল্প সময়ের মধ্যে সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলোর প্রস্তাবের আলোকে বিশেষ ছয়টি সেক্টরের কাজ বাস্তবায়নে নতুন যাত্রা শুরু হচ্ছে। এর মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোর চাওয়া-চাহিদায় মতানৈক্য দূর হবে। অল্প সময়ে ছাত্র-জনতার চাওয়া বাস্তবায়ন করা হবে। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলো থেকে মতামত ছাড়াও লিখিত প্রস্তাবকে গুরুত্ব দেয়া হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, সমপ্রতি নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো থেকে চাপ তৈরি হয়েছে। তাই এ বিষয়ে দলগুলো থেকে দাবি ও চাওয়া শুনে নেবে ড. ইউনূস সরকার। সরকার এবং রাজনৈতিক দলের মতামতের গুরুত্বে কিভাবে দ্রুত নির্বাচনের সময়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছা যায় এ নিয়েও মতামত গ্রহণ করবেন। একই সঙ্গে স্বৈরাচার সরকারের খুনি, দুর্নীতিবাজদের বিচার প্রক্রিয়ার বিষয়েও মতামত চাওয়া হবে। স্বৈরাচারের অনুগত প্রশাসনের বিকল্প বিষয়েও জেনে নেয়া হবে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে হাসিনা সরকারের সময়ে কাটাছেঁড়া সংবিধান কিভাবে সংস্কার করা যায় এ ব্যাপারে অধিক মতামত গ্রহণ করা হবে। তবে সর্বাপেক্ষায় দেশের সব সেক্টরে গুরুত্ব থাকবে ছাত্র-জনতার স্বপ্ন বাস্তবায়ন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এ নিয়ে বিএনপিকে দিয়েই কাল থেকে শুরু হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের আলোচনা। আগামীকাল বেলা আড়াইটায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় এ আলোচনা হবে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেবেন। দলটির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান এ তথ্য নিশ্চিত করেন। মির্জা ফখরুল ইসলাম ছাড়া বিএনপির প্রতিনিধিদলে জ্যেষ্ঠ নেতাদের মধ্যে আরও কয়েকজন অংশ নেবেন আলোচনায়। বিএনপি ছাড়াও অন্যান্য দলের সঙ্গেও শনিবার সংলাপ করবেন প্রধান উপদেষ্টা।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ও বাম গণতান্ত্রিক জোটের নেতাদেরও এদিন সংলাপের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। গতকাল সকালে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একজন উপদেষ্টা সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেনকে (প্রিন্স) এই বৈঠকের কথা জানিয়েছেন। এ বিষয়ে রুহিন হোসেন বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে শনিবার বিকাল চারটায় বৈঠকের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রেস সচিব শফিকুল আলম গত বুধবার সন্ধ্যায় সংবাদ ব্রিফিংয়ে জানান, প্রধান উপদেষ্টা আগামী শনিবার থেকে আবারও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবেন। সেখানে উপদেষ্টারাও উপস্থিত থাকবেন।
গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর ইতোমধ্যে দুই দফায় উপদেষ্টা পরিষদের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিদের সভা হয়েছে। তারই চলমান প্রক্রিয়ায় শনিবার থেকে আবারও নতুন দফায় আলোচনা শুরু হবে। দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এই আলোচনা হবে। এ আলোচনার প্রধান বিষয় হচ্ছে ছয় সংস্কার কমিশনের কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে দলগুলোকে অবহিত করা। এ ছাড়া দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়েও কথা হবে এবং তাদের পরামর্শ নেয়া হবে। দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে সংস্কার কমিশন গঠিত হবে বলে আশা প্রকাশ করেন প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ১১ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে নির্বাচনব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, সংবিধান ও দুর্নীতি দমন বিষয়ে সংস্কারের জন্য ছয়টি কমিশন গঠনের কথা জানান। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন বদিউল আলম মজুমদার, পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান সফর রাজ হোসেন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমান, দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশনের প্রধান ইফতেখারুজ্জামান, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী। আর সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে অধ্যাপক আলী রীয়াজকে দায়িত্ব দেয়া হয়।
এদিকে সংবিধানসহ প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারে অন্তর্বর্তী সরকার যে ছয়টি কমিশন করেছে, তার আলোকে ছায়া কমিটি করেছে বিএনপিও। গত মঙ্গলবার রাতে অনুষ্ঠিত দলের স্থায়ী কমিটির সভায় এ কমিটি চূড়ান্ত করা হয়। শিগগিরই কমিটিকে সংস্কার প্রস্তাব তৈরি করতে বলা হয়েছে। বিএনপির সূত্র জানিয়েছে, স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, নজরুল ইসলাম খান, হাফিজ উদ্দিন আহমদ, সালাহউদ্দিন আহমেদ ও এ জেড এম জাহিদ হোসেনকে প্রধান করে পৃথক সংস্কার কমিটি করা হয়েছে। তবে কাকে কোন সংস্কার কমিটির প্রধান করা হয়েছে এবং কমিটিতে আর কারা কারা আছেন, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।