- তিন বছর বৈঠকের নামে কর্মকর্তাদের খরচ তিন কোটি টাকা
- সিএমএসএফের গঠন পদ্ধতিই আপত্তিকর
—ডিবিএ সভাপতি
বিনিয়োগকারীদের অবণ্টিত টাকায় বিলাসিতায় মেতেছে ক্যাপিটাল মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ডের (সিএমএসএফ) সাবেক চেয়ারম্যান ও পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সমালোচনা উঠলেও তাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছেন বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলাম। যদিও পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের অবণ্টিত লভ্যাংশ বণ্টন, বাজারের স্থিতিশীলতা রক্ষা করাই ছিল সংস্থাটির অন্যতম কাজ। তা না করে বিনিয়োগকারীদের টাকায় বিলাসবহুল অফিস, চেয়ারম্যান-এমডির জন্য কোটি টাকার দামি গাড়ি, পাঁচতারকা হোটেলে লাখ লাখ টাকা খরচ করে মিটিংয়ের নামে বিপুল অঙ্কের টাকা অপচয় করেছেন পতিত সরকারের ঘনিষ্ঠরা।
অভিযোগ রয়েছে, শেয়ারবাজার থেকে দলীয় লোকদের বিশেষ সুবিধা পাইয়ে দিতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একসময়ের মুখ্য সচিব নজিবুর রহমান, শ্যামল দত্তদের পুনর্বাসিত করা ছিল সিএমএসএফ গঠনের অন্যতম উদ্দেশ্য। পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান তার ঘনিষ্ঠদের নানা সুবিধা দিয়ে শেয়ারবাজারে একটি শক্তিশালী বলয় তৈরি করার যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন, সিএমএসএফ ছিল তার ওই পরিকল্পনার একটি অংশ। সিএমএসএফ বিনিয়োগকারীদের প্রাপ্য লভ্যাংশ ফিরিয়ে দেয়ার কার্যকর উদ্যোগ নেয়ার চেয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম-মৃত্যুবার্ষিকীসহ নানা দিবস পালনের মাধ্যমে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিবার ও তাদের মনোযোগ আকর্ষণই ছিল এ প্রতিষ্ঠানটির কর্তাব্যক্তিদের লক্ষ্য। যার সবশেষ উদাহরণ বিনিয়োগকারীদের প্রাপ্য লভ্যাংশের টাকায় সংস্থাটির সাবেক চেয়ারম্যানের জন্য কেনা হয়েছে কোটি টাকা মূল্যের গাড়ি। অপ্রয়োজনীয় নানা কমিটি গঠন করে সভায় অংশগ্রহণের সম্মানি হিসেবে বিতরণ করা হয়েছে কয়েক কোটি টাকা।
ফান্ডের টাকায় পরিচালকদের বিলাসী গাড়ি বা সম্মানি নেয়া প্রসঙ্গে সিএমএসএফের সিইও মনোয়ার হোসেন আমার সংবাদকে বলেন, কমিটির সদস্যরা কেউ বেতনভুক্ত ছিলেন না। যে কারণে তারা মিটিং ফি থেকে সম্মানি বাবদ প্রায় আট হাজার টাকা পেতেন। সেখান থেকে ভ্যাট-ট্যাক্স কেটে বাকি টাকা তাদের দেয়া হতো। তবে এর বাইরে কেউ কোনো বিশেষ সুবিধা পেয়েছেন কি না, তা আমার জানা নেই।
যদিও প্রতিষ্ঠানটির সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কোম্পানি থেকে সংগৃহীত অবণ্টিত লভ্যাংশের টাকা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা রেখে তার থেকে পাওয়া সুদের টাকা দিয়ে অফিস, একটি মিৎসুবিশি পাজেরো স্পোর্টস ও একটি টয়োটা করোলা ক্রস গাড়ি এবং পাঁচতারকা হোটেলের খরচ মেটানো হয়েছে। এছাড়া চেয়ারম্যানের বিশেষ অনুগতদের এই অর্থ থেকে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ ও ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহারের ঘটনাও ঘটেছে।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, এই সুদের টাকার দাবিদারও বিনিয়োগকারীরা। তারা মনে করেন, বিনিয়োগকারীদের সম্পদ ব্যাংক কিংবা কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানে রেখে অন্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সেই টাকার সুদ ভোগ করার কোনো সুযোগ নেই।
এ বিষয়ে সিএমএসএফের সিইও মনোয়ার হোসেন আমার সংবাদকে আরও বলেন, প্রায় দুই মাস ধরে আমাদের বোর্ডে পরিচালক নেই। বোর্ড না থাকায় আমরা রুটিন কাজের বাইরে কোনো কাজ করতে পারছি না। বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষার জন্য এই বোর্ড খুবই প্রয়োজন। বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা দিতেই এই ফান্ড গঠন করা হয়েছে। আমরা ২৭০০ ডিভিডেন্ড দাবি পরিশোধ করেছি। ইতোমধ্যে ফান্ডের টাকার সুদ বৃদ্ধি পেয়ে ৭০ কোটি টাকা যুক্ত হয়েছে।
সিএমএসএফ ফান্ড প্রসঙ্গে ঢাকা ব্রোকারেজ অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, সিএমএসএফের গঠন পদ্ধতিটিই আপত্তিকর। সিএমএসএফের সৃষ্টি, গঠনতন্ত্র এবং পরিচালনা নিয়ে আমাদের আপত্তিকর। সিএমএসএফ নিয়ে একটি বড় অডিট বা নিরীক্ষার দাবি জানাচ্ছি। সংগৃহীত ফান্ডগুলো কীভাবে এবং কোথায় কোথায় ব্যবহার করা হয়েছে— তা তদন্ত করে দেখতে হবে। সিএমএসএফের একটি গঠণযোগ্য, পুঙ্খানুপুঙ্খ নিরীক্ষা করা হোক। ভবিষ্যতে সিএমএসএফ কীভাবে পরিচালিত হবে এবং আদৌ এর প্রয়োজন আছে কি না, তা খতিয়ে দেখে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া উচিত বলে মনে করি।
এছাড়াও পুঁজিবাজারে সংকটে স্থিতিশীলতা আনতে সহায়তার জন্য গঠন করা হয় মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ড (সিএমএসএফ)। তবে এ ফান্ডের সুফল তো আসেইনি, বরং পুঁজিবাজারে উল্টো তিন বছরে শুধু বৈঠক করেই তিন কোটি টাকার বেশি পকেটে পুরেছেন এই ফান্ডের পর্ষদ ও বিভিন্ন কমিটির দায়িত্বে থাকা বিগত সরকারের ঘনিষ্ঠ এবং সুবিধাভোগীরা।
সিএমএফএসের কর্মকর্তাদের দেয়া তথ্যমতে, গত তিন বছরে কারণে-অকারণে ৩২৩টি বৈঠক করেছে সিএমএসএফের বিভিন্ন কমিটি। অর্থাৎ, প্রতি বছর ১০০টির বেশি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসব বৈঠকে অংশ নেয়া প্রত্যেক সদস্যের সম্মানি ভাতা ছিল আট হাজার টাকা করে। তিন বছরে পুঁজিবাজারের উন্নয়নে তেমন কোনো পদক্ষেপ না নিলেও কেবল বৈঠক করেই তারা সম্মানি হিসেবে পকেটে পুরেছেন তিন কোটি ৩২ লাখ টাকা।
বিনিয়োগকারীরা জানিয়েছেন, সিএমএসএফের লক্ষ্য ও আকার যত বড়, সে তুলনায় ফলাফল কিছুই আসেনি। চলতি বছরের ৩০ জুলাই পর্যন্ত সিএমএসএফের তহবিল দাঁড়ায় এক হাজার ৫৪৫ কোটি টাকা। এ থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশকে (আইসিবি) ২২৫ কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়েছে। আইসিবি সেই টাকা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেছে। কিন্তু এই সামান্য বিনিয়োগ বাজারের সার্বিক স্থিতিশীলতা আনার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য প্রভাব রাখতে পারেনি। এছাড়া ৫০ কোটি টাকা দিয়ে একটি মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ড চালু করা হয়েছিল। বিশাল ব্যয়ে এই ফান্ডের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় রাজধানীর একটি পাঁচতারকা হোটেলে। এর বাইরে বাজার স্থিতিশীলতায় সিএমএসএফের কোনো ভূমিকাই নেই।
সিএমএসএফের সদ্যবিদায়ী চেয়ারম্যান মো. নজিবুর রহমান জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য সচিব ছিলেন। তাকে নিয়েও বাজার-সংশ্লিষ্টদের মাঝে রয়েছে নানা সমালোচনা। মুখ্য সচিব থেকে অবসরে যাওয়ার পর তাকে সিএমএসএফের চেয়ারম্যান করা হয়। পুঁজিবাজারের ব্যাপারে ন্যূনতম অভিজ্ঞতা না থাকার পরও এই ব্যক্তিকে প্রশাসনের আস্থাভাজন হওয়ায় গুরুত্বপূর্ণ পদটি দেয়া হয়। পুঁজিবাজার থেকে এসব সুবিধা নেয়ার ব্যাপারে তাকে সহায়তা করেন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম।
এদিকে, সিএমএসএফের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে তৎপর হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এ ব্যাপারে একটি রূপরেখা প্রণয়নের জন্য ছয় সদস্যের কমিটি করা হয়েছে। তাদের কর্মপরিধি হবে সিএমএসএফের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে করণীয় নির্ধারণ, তহবিল ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত সুপারিশ প্রণয়ন এবং অন্যান্য কার্যক্রম নির্ধারণ করা।
এর আগে গত ২৬ সেপ্টেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়ের ট্রেজারি ও ঋণ ব্যবস্থাপনা অনুবিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব কাজী লুতফুল হাসান স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে এই নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় বলা হয়েছে, কমিটির আহ্বায়ক থাকবেন অর্থ বিভাগের ট্রেজারি ও ঋণ ব্যবস্থাপনা অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব। আর আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের উপযুক্ত প্রতিনিধি সদস্য সচিব হিসেবে কাজ করবেন।
অর্থ বিভাগের ঋণ ব্যবস্থাপনা অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপযুক্ত প্রতিনিধি, যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধক বা আরজেএসসির উপযুক্ত প্রতিনিধি, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের উপযুক্ত প্রতিনিধি এ কমিটির সদস্য থাকবেন।
ওই নির্দেশনায় আরও বলা হয়েছে, ‘সিএমএসএফের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতকরণে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণে কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী ১০ কার্যদিবসের মধ্যে ওই কমিটিকে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।’