খেলাপি ঋণে ন্যুব্জ ছয় ব্যাংক

আনোয়ার হোসাইন সোহেল প্রকাশিত: অক্টোবর ১৩, ২০২৪, ১২:২৮ এএম
খেলাপি ঋণে ন্যুব্জ ছয় ব্যাংক
  • বিতরণ করা ঋণের ৫০ শতাংশই খেলাপি
  • কর্মকর্তাদের ম্যানেজড করে করা হয় পুনঃতফসিল

চাই না কোনো ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাক
— মুখপাত্র, কেন্দ্রীয় ব্যাংক

 আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিশেষ ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে বেশ উদারতা দেখিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত দুটি আর বেসরকারি চার ব্যাংক। শুধু তা-ই নয়, ব্যাংক কর্মকর্তাদের ম্যানেজড করে বারবার পুনঃতফসিল করে, আদালতের স্থগিতাদেশ ও অবলোপনের পরও ঋণখেলাপের সমস্যার সমাধান করা হয়নি। ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ দুই লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৫০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে ৩০ শতাংশের ওপর খেলাপি ঋণ রয়েছে আরও চার ব্যাংকের। ব্যাংকগুলো হলো— সরকারি খাতের বেসিক ও জনতা ব্যাংক এবং বেসরকারি খাতের বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, আইসিবি ইসলামী ব্যাংক ও পদ্মা ব্যাংক। ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান নামে একটি বিদেশি ব্যাংকও খেলাপি ঋণের তালিকায় রয়েছে।

ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০১৫-১৬ সালের পর ক্ষমতাসীন দলের লোকজনকে ব্যাংক আইন ভেঙে আগ্রাসীভাবে ঋণ দিয়েছে এসব ব্যাংক। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ও অর্থ মন্ত্রণালয়কে ম্যানেজড করে যারা ঋণখেলাপি করেছে তাদের অনেক সুযোগ দেয়া হয়েছে, তাদের অনুকূলে বিভিন্ন সময়ে ঋণ পুনঃতফসিলিকরণ, অবলোপন ও পুনর্গঠন করা হয়েছে। টাকা ছাপিয়েও কোনো কোনো গোষ্ঠীকে ঋণ সুবিধা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে বেশ কিছু ব্যাংক। এসব ব্যাংকের বিষয়ে এখনই সিদ্ধান্ত না নেয়া হলে সংকট আরও গভীর হবে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, ব্যাংক বন্ধ করে দেয়াই সমাধান নয়। শেষ চেষ্টা হিসেবে আপাতত কেন্দ্রীয় ব্যাংক সবল ব্যাংকগুলো থেকে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে মানি সাপোর্ট দিচ্ছে। সেই দুর্বল ব্যাংকগুলোর মেরুদণ্ড সোজা করার ব্যবস্থা নিয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় ব্যাংকগুলোর দুর্বলতা কেটে যাবে বলেও মনে করছে সেন্ট্রাল ব্যাংক। যদি তাতেও কাজ না হয় তখন মার্জ করা যেতে পারে।    

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন মাস শেষে ব্যাংক খাতের মোট ঋণস্থিতি ১৬ লাখ ৮৩ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ দুই লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ। গত মার্চ শেষে ঋণস্থিতি ছিল ১৬ লাখ ৪০ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা। তখন খেলাপি ঋণ ছিল এক লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা। সে হিসাবে তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৯ হাজার ৯৬ কোটি টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, সামনে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বাড়বে। কারণ অনেক ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে, আদালতের স্থগিতাদেশের মধ্যে খেলাপি ঋণের বড় একটা অংশ আছে। এগুলোকে যখন খেলাপি দেখানো হবে, তখন এর পরিমাণ আরও বড় হবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রকাশ করা সবশেষ প্রতিবেদন বলছে, রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ আট হাজার ২৫৬ কোটি টাকা, যা ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের ৬৪ শতাংশ। গত জুন পর্যন্ত বেসিক ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের স্থিতি ছিল ১২ হাজার ৮০৯ কোটি টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪৮ হাজার কোটি টাকা। জুন পর্যন্ত ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের স্থিতি ছিল ৯১ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা। সে হিসাবে ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ৫২ শতাংশ।

বেসরকারি খাতের বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক হাজার ৩৩১ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ৫৬ শতাংশ, আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৬৭৭ কোটি টাকা (৮৮ শতাংশ), পদ্মা ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ চার হাজার ৮৮১ কোটি টাকা (৮৫ শতাংশ)। ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক হাজার ৩২১ কোটি টাকা (৯৬ শতাংশ)। এ ছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২১ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ৩০ শতাংশের বেশি, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (বিডিবিএল) খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৯৪৩ কোটি (৪২ শতাংশ), বেসরকারি খাতের এবি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৯ হাজার ৭৯৫ কোটি টাকা (৩১ শতাংশ এবং ন্যাশনাল ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ২০ হাজার ৯২৯ কোটি (৪৯ শতাংশ)।

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ দুই হাজার ৪৮৩ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৩২ দশমিক ৭৭ শতাংশ। গত মার্চে রাষ্ট্রায়ত্ত  ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৮৫ হাজার ৮৭০ কোটি টাকা। সে হিসাবে তিন মাসে তাদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ১৬ হাজার ৬১৩ কোটি টাকা। ওই সময় সরকারি ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের হার ছিল প্রায় ২৭ শতাংশ। তারও আগে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ছিল ৬৫ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২১ শতাংশ।

তিন মাসের ব্যবধানে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৯৯ হাজার ৯২১ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৭ দশমিক ৯৪ শতাংশ। গত মার্চের শেষে এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৮৮ হাজার ৮৯৭ কোটি টাকা বা ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ। তিন মাসে তাদের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১১ হাজার কোটি টাকা। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে তাদের খেলাপি ঋণ ছিল ৭০ হাজার ৯৮১ কোটি টাকা।

চলতি বছরের জুন মাসের শেষে বিশেষায়িত তিন ব্যাংকে খেলাপি ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় পাঁচ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ১৩ দশমিক ১১ শতাংশ। বিদেশি ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ২২৯ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ৪ দশমিক ৭৪ শতাংশ। ব্যাংক খাত সংস্কারে গঠিত টাস্কফোর্সের সদস্য ও বিশ্ব ব্যাংকের বাংলাদেশ মিশনের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘আমরা ২০১৫-১৬ সালের পর থেকে একটা উদার পথে চলেছি, যারা ঋণখেলাপি করেছে তাদের অনেক সুযোগ দেয়া হয়েছে। পুনঃতফসিলিকরণ, অবলোপন, পুনর্গঠন করা হয়েছে। আশা করা হয়েছিল, তারা টাকা ফেরত দেবে। কিন্তু এসব মডেল সুফল দেয়নি। বরং অনেকে সেটার সুযোগ নিয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘ব্যাংক খাতের সংস্কারে টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। অনেকগুলো ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়েছে। দুর্বল প্রতিষ্ঠানগুলোর একটা ব্যবস্থা হবে। টাস্কফোর্স এসব প্রতিষ্ঠানে আগে নিরীক্ষা করবে। দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সবল করার চেষ্টা করতে হবে, যদি সেটা সম্ভব হয়। একীভূত করাও যেতে পারে, না হলে বিলুপ্ত করতে হবে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা বলেন, ‘কোনো ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাক, আমরা তা চাই না। ব্যাংক খাত সংস্কারে ইতোমধ্যে টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সবল ব্যাংকগুলো থেকে মানি সাপোর্ট দেয়া হয়েছে। যাতে করে ব্যাংকগুলো তাদের দুর্বলতা কাটাতে পারে।’