বিরোধীদল সংস্কারে জামায়াতের প্রস্তাব

বিরোধীদলের কৌশলে জামায়াত

আবদুর রহিম প্রকাশিত: অক্টোবর ১৩, ২০২৪, ১২:৪৪ এএম
বিরোধীদলের কৌশলে জামায়াত
  • সংসদের প্রধান বিরোধীদল থেকে একজন ডেপুটি স্পিকার মনোনীত করতে হবে
  • বিরোধী দলীয় নেতার নেতৃত্বে ছায়া মন্ত্রিসভা গঠনের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে
  • সংসদে বিরোধী দলীয় সদস্যদের পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে

সব মতানৈক্য দূর করে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে
—মোসাদ্দেক বিল্লাহ মাদানী প্রেসিডিয়াম সদস্য, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ

ইসলামি দলগুলোতে ঐক্যের বিষয়ে মাঠপর্যায়ের প্রত্যাশা আছে
—আব্দুল হালিম, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল, জামায়াতে ইসলামী

আপসের ভিত্তিতে ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে
—আবু জাফর কাশেমী, প্রধান আমির, খেলাফত আন্দোলন (একাংশ)

ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে বিরোধীদলের ভূমিকায় থাকতে কৌশলে এগুচ্ছে জামায়াতে ইসলামী। একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর থেকেই পর্দার আড়ালে ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক চালিয়ে যাচ্ছে দলটি। ধর্মীয় দলগুলোর আদর্শে কিছু মতানৈক্য থাকায় এতদিন ঐক্যের অগ্রগতি বেশিদূর এগোয়নি। গেলো ৩৬ জুলাইয়ে ছাত্র আন্দোলনে হাসিনা সরকারের পতনের পর আবারও বৃহৎ ইসলামি ঐক্য ও জোট গঠন নিয়ে তৎপরতা শুরু হয়। এরই মধ্যে সাড়া মিলে ইসলামপন্থি দলগুলো থেকে। ইতোমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। ঐক্যের সাফল্যও অনেক দূর এগিয়ে গেছে। বিএনপি ক্ষমতাসীন দলের ভূমিকায় থাকলে আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইসলামি জোট নিয়ে বিরোধী দলের ভূমিকায় থাকবে জামায়াতে ইসলামী। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জামায়াতে ইসলামী আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল সব ইসলামি ব্যক্তিদের সঙ্গে সিরিজ বৈঠক করে যাচ্ছে। ইসলামি দলগুলোকে নিয়েই ভোটের মাঠে থাকতে বৃহৎ রূপরেখাও তৈরি করেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, বিএনপি ক্ষমতাকেন্দ্রিক থাকতে চাইলে জামায়াতে ইসলামী দলগুলোকে নিয়ে বিরোধী দলের ভূমিকায় থাকবে। ইতোমধ্যে সেই বার্তা ইসলামি দলগুলোকে দিয়েছে জামায়াত। ঐক্যের আহ্বানে ইতোমধ্যে অনেকের আদর্শের মতানৈক্য থাকলেও একমত পোষণ করা হয়েছে, ভোটের মাঠে জোটে থাকতে। 

গত ৯ অক্টোবর রাষ্ট্র সংস্কার প্রস্তাবনায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী সংসদবিষয়ক সংস্কার প্রস্তাবে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি প্রস্তাব তুলে ধরেছে। তা হলো— ১. সংসদের প্রধান বিরোধীদল থেকে একজন ডেপুটি স্পিকার মনোনীত করতে হবে। ২. সংসদীয় বিরোধী দলীয় নেতার নেতৃত্বে ছায়া মন্ত্রিসভা গঠনের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ৩. সংসদে বিরোধী দলীয় সদস্যদের পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে। 

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের বনিবনা হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ এমনটা বিবেচনায় নিয়ে জামায়াতের নীতিনির্ধারকরা আগে থেকেই একটা বিকল্প শক্তি দাঁড় করিয়েছেন। চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ কয়েকটি দলের নেতারা জানান, জামায়াতের সঙ্গে তাদের আদর্শগত কিছু মতানৈক্য রয়েছে। তবে বৃহৎ স্বার্থে তারাও আর দূরে থাকবে না। আর জামায়াতে ইসলামীকে বাদ দিয়ে অন্য ইসলামি দলগুলোর নির্বাচনি ঐক্য শক্তিশালী দাঁড় করালে সেটাও টিকবে না বলে অনেকেই মত দিয়েছেন।

সবশেষ গত ২১ সেপ্টেম্বর জামায়াতে ইসলামী ছাড়া সমমনা দলগুলোর একটি বৈঠক হয়েছে। তবে সেখানে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। গেলো সপ্তাহের শনিবার লাখো জনতার অংশগ্রহণে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত হয়েছে জাতীয় সিরাতুন্নবী (সা.) মাহফিল। সেখানে বিভিন্ন আকিদার বক্তারা দেশে ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠায় ইসলামি দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। ইসলাম ও দেশের স্বার্থে সব বিভেদ ভুলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এক হয়ে কাজ করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন। 

গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের প্রায় সাড়ে ১৫ বছর পর স্বাভাবিক রাজনৈতিক কার্যক্রমে ফিরেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। এই মুহূর্তে দলটি সারা দেশে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত। দলটির শীর্ষ নেতারা সেনাপ্রধান, রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে পৃথক বৈঠকে অংশ নিয়ে আলোচনায় আসে। তারই ধারাবাহিকতায় অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নেয়ার ২৩ দিনের মাথায় দল নিষিদ্ধের আদেশও প্রত্যাহার হয়। এখন বিভিন্ন ইসলামি দলের সমন্বয়ে একটি ‘নতুন প্ল্যাটফর্ম’ গড়ে ঐক্যবদ্ধভাবে আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে চায়। জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান সমপ্রতি বলেছেন, আমরা বিভক্তিতে বিশ্বাসী নই। দেশের সব জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি সুন্দর জাতি গঠন করতে চাই। এ জন্য প্রতীক্ষায় আছি।

জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের বাইরে ‘সমমনা ইসলামি দলসমূহ’ নামে ছয়টি দলের একটি জোট আছে। এই জোটের শরিক দলগুলো হলো— জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস (মামুনুল হক), মুসলীম লীগ (আবুল খায়ের), খেলাফত মজলিস (আহমদ আবদুল কাদের), বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন ও ইসলামী ঐক্য আন্দোলন। খেলাফত আন্দোলন জোটের অবস্থানের বাইরে গিয়ে শেখ হাসিনার সরকারের অধীন ২০২৪ সালের সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়। সমমনা ইসলামি দলের একজন নেতা জানান, ইসলামী ঐক্য আন্দোলন ও খেলাফত আন্দোলন ছাড়া বর্তমানে তাদের জোটে চারটি দল সক্রিয়। তারা জামায়াতসহ ইসলামী দলগুলোর সমন্বয়ে একটি নির্বাচনি ঐক্য গড়ার চেষ্টা করছে।
একাধিক ইসলামি দলের কয়েকজন নেতা জানান, ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের এখনো কোনো সুস্পষ্ট রূপরেখা নেই। যে কোনো সময় রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তন হতে পারে। সুতরাং জামায়াতসহ ইসলামপন্থিদের যে নির্বাচনি ঐক্যের তৎপরতা চলছে, তা শেষ পর্যন্ত কত দূর যায়, সে বিষয়ে অনেকের মধ্যে প্রশ্ন আছে। এরই মধ্যে ইসলামী আন্দোলনের নেতা মুফতি ফয়জুল করীম ও খেলাফত মজলিসের নেতা মাওলানা মামুনুল হক বলেছেন, ঐক্য গড়তে তাদের কোনো সমস্যা নেই।

৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতন ও নতুন প্রেক্ষাপটে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এখন জামায়াতে ইসলামী। দলটি ১৫ আগস্ট থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের সঙ্গে বৈঠক শুরু করে। এর মধ্যে চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, ১২ দলীয় জোট, জাকের পার্টি, লেবার পার্টি, খেলাফত মজলিস ও ফরায়েজী আন্দোলন উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক, হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব আজিজুল হক ইসলামাবাদী, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির সিনিয়র নায়েবে আমির আব্দুল মাজেদ আতাহারী, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের (একাংশ) আমির আবু জাফর কাসেমী, জামিয়া মাদানিয়ার মুহতামিম মনিরুজ্জামান কাসেমী, জনসেবা আন্দোলনের আমির ফখরুল ইসলামসহ ব্যক্তি পর্যায়ে বিভিন্ন মাদ্রাসার শিক্ষক ও আলেমদের সঙ্গে জামায়াতের আমির পৃথক মতবিনিময় করেন।

এসব মতবিনিময়ে অংশ নেয়া একাধিক দলের নেতারা জানান, জামায়াতে ইসলামী দেশে ইসলামপন্থিদের মধ্যে একটি ঐক্য চায়। বিশেষ করে নির্বাচনি ঐক্য। এ লক্ষ্যে জামায়াত এরই মধ্যে ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে একটা যোগাযোগের সম্পর্ক তৈরি করেছে। এর মধ্য দিয়ে কার্যত কওমি ধারার আলেমদের সঙ্গে তাদের দীর্ঘদিনের যে বিরোধ বা বিতর্ক, সেটি কমেছে। এখন নির্বাচনি ঐক্য হলে ভালো, না হলেও জামায়াত তাতে খুব সমস্যা দেখছে না। অবশ্য জামায়াত নেতাদের মতে, ইসলামি দলগুলোর মধ্যে নির্বাচনি ঐক্য হবে কি না, সেটি নির্ভর করছে চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলনের ওপর। জামায়াতের পর ইসলামপন্থিদের সমর্থনের দিক থেকে এই দলটিকে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হয়। এ নিয়ে বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন (একাংশ) প্রধান আমিরে শরীয়ত মাওলানা আবু জাফর কাশেমী বলেছেন, এখন আমাদের একটা সিদ্ধান্তে আসতে হবে। সেটা হচ্ছে ঐক্যের সিদ্ধান্ত। ঐক্যের মাধ্যমে রাসূলের আদর্শ বাস্তবায়ন করতে হবে। আওয়ামী লীগের মতো স্বৈরশাসন যেন আবারো মাথার ওপর ছায়া করতে না পারে। সে জন্য আপসের ভিত্তিতে আমাদের ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আমরা আপসের ভিত্তিতে ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আল্লাহ বলেছেন, ‘ওয়া তাছিমু বিহাব লিল্লাহি ওয়া জামিয়াও তাফারাকু।’ শক্তভাবে আল্লাহর রজ্জুকে ঐক্যবদ্ধভাবে ধরতে হবে। হাফেজ্জি হুজুরের আহ্বান ছিল, এক হও এক হও। আমাদের এক হয়ে আল্লাহর আইন ও রাসূলের আদর্শ বাস্তবায়নে কাজ করে যেতে হবে।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম বলেন, স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতনের পর নতুন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে। এখন ইসলামি দলগুলোর মধ্যে ঐক্যের বিষয়ে মাঠপর্যায়ের প্রত্যাশা আছে। সেজন্য বিভিন্ন ইসলামি দল একটি সমন্বিত প্ল্যাটফর্ম গড়তে চায়। এ বিষয়ে সমমনা অন্যান্য দলের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়ামের সদস্য প্রিন্সিপাল মাওলানা সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ মাদানী বলেন, আমাদের ইসলামিক দলগুলোর মধ্যে এখনো মতানৈক্য চলছে। এগুলোকে দূর করে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আমাদের ছোট ছোট ভুলভ্রান্তি ঐকমত্য থাকবে,  কিন্তু ইসলামের স্বার্থে আমাদের এখন সবাইকে একমত হয়ে যেতে হবে। সিরাতুল মুস্তাকিমের স্বার্থে, আল্লাহ রাসূলের স্বার্থে, কোরআনের স্বার্থে, এক আল্লাহর স্বার্থে— এক হয়ে যেতে হবে। আল্লাহর জন্য, আল্লাহকে রাজি খুশি করার জন্য এক হয়ে যেতে হবে। আমাদের ভেতরের সমস্ত অহংকার আমি বড়, আমি ছোট এগুলো ভুলে যেতে হবে। আমরা এখনো যদি বিভক্ত থাকি ইসলামের অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে।