একটি সিন্ডিকেটচক্র শ্রমিক ও মালিকদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব লাগিয়ে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে, ফলে প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়াসহ অন্য দেশগুলো সুযোগ নিচ্ছে
শ্রমিক অসন্তোষ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজবের কারণে তৈরি পোশাক খাত ক্রেতা হারানোর শঙ্কায় রয়েছে। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের সুবিধাভোগীরা পরিকল্পিতভাবে গুজব রটিয়ে শিল্প এলাকাগুলোতে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। তবে এসব গুজব রটনাকারীদের বিরুদ্ধে সাবেক সরকারের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যতটা সক্রীয় ছিল এখন তার উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তায় গুজব ছড়িয়ে পার পেয়ে যাচ্ছেন ওইসব সুবিধাবাদীরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রায় ১৬ বছর ধরে আওয়ামী লীগের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা পোশাক খাত নিয়ন্ত্রণ করত। এ খাতের নানা প্রণোদনাসহ এলসিতে ওভার ইনভয়েজিংয়ের মাধ্যমে বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করে কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় পাচার করেছে এসব চক্রান্তকারীরা। ব্যাংক থেকে বিপুল সুযোগ সুবিধা নিয়ে বিদেশে গিয়ে তারা এই খাতকে ধ্বংসের পাঁয়তারা করছে। একটি সিন্ডিকেট শ্রমিক ও মালিকদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব লাগিয়ে রাখছে। ফলে ২৫০টির বেশি কারখানা এখনো বন্ধ রয়েছে। ফলে বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়াসহ অন্যদেশগুলো এই সুযোগটা নিচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে সামনে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আরও অর্ডার কমে যাবে।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সহ-সভাপতি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পোশাক খাত দেশের বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের পাশাপাশি অর্থনীতিতে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখছে। জিডিপিতে পোশাক খাতের অবদান প্রায় ৮৪ শতাংশ। পাশাপাশি অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের দুর্বল সিদ্ধান্তের কারণে আরও নাজুক পরিস্থিতিতে পড়েছে পোশাক খাত। গ্যাস-বিদ্যুৎসহ নানা প্রতিকূলতায় ব্যবসা চালাতে এমনই হিমশিম খাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। শ্রমিক অসন্তোষ, ব্যাংক ঋণ পেতে জটিলতা, সব মিলিয়ে চরম উৎকণ্ঠায় পোশাকশিল্প সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা এখন খাদের কিনারায় গিয়ে ঠেকবে। যা স্পষ্ট হয়েছে বেশকিছু আন্তর্জাতিক জরিপে।
পাশাপাশি ঋণে সুদহার বাড়ানোসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের সংকোচনমূলক মুদ্রানীতিতে দেশে সংকুচিত হচ্ছে ব্যবসার পরিধি। মূল্যস্ফীতি কমাতে দফায় দফায় নীতি সুদহার বাড়ানোর পর এমন অভিজ্ঞতাই তুলে ধরছেন ব্যবসায়ীরা। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, আকাশচুম্বী সুদের চাপে পড়েছে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, নীতি সুদহার বাড়িয়ে আপদকালীন সংকট সামাল দেয়া সম্ভব হলেও দীর্ঘমেয়াদে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে অর্থনীতিতে। মূল্যস্ফীতি কমাতে এক মাসের ব্যবধানে দুই দফায় নীতি সুদহার বাড়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রথমে ৯ শতাংশ এবং পরে আরও ৫০ ভিত্তি পয়েন্ট বাড়িয়ে সাড়ে ৯ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, গ্রাহকপর্যায়ে ব্যাংক ঋণের সুদ বেড়ে হয়েছে ১৫ শতাংশের বেশি। এতে করে একদিকে যেমন ঋণের কিস্তি পরিশোধের চাপ বেড়েছে, অন্যদিকে সংকুচিত হচ্ছে ব্যবসার পরিধি। সুদহার বাড়িয়ে, মুদ্রা সরবরাহ কমিয়ে, মূল্যস্ফীতি সামালের যে পদক্ষেপ বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়েছে, তা আপাতত কার্যকরী হলেও দীর্ঘমেয়াদে আত্মঘাতী বলে মত সংশ্লিষ্টদের। সামনে সুদহার আরও বাড়ানো হলে বিনিয়োগ কমার পাশাপাশি কর্মসংস্থানেও সংকট দেখা দেয়ার শঙ্কা ব্যবসায়ীদের।
বিজিএমইএর পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল আমার সংবাদকে বলেন, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাসের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানি ধারাবাহিকভাবে কমেছে। বিশেষ করে জানুয়ারিতে ৩৬ দশমিক ৭২ শতাংশ পোশাক রপ্তানি কমে গেছে। জাতীয় নির্বাচনসহ নানা কারণে এমনটা হয়েছে। প্রথম প্রান্তিকে কমলেও দ্বিতীয় প্রান্তিকে আবার কিছুটা ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক ক্ষমতার পালাবদলের ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে চীন এবং ভিয়েতনাম তুলনামূলকভাবে ওই সময় ভালো করেছে। তবে আমাদের পোশাকের গুণগতমান ও দামের কারণে বরাবরই ক্রেতাদের পছন্দের শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশের পোশাক খাত। বিজিএমইর আরেক পরিচালক বলেন, সুদহার বৃদ্ধির বিষয়টি বেশিদিন চললে বিনিয়োগ কমে আসবে। কিছু কিছু ব্যবসার বিষয়ে অন্য কিছু ভাবতে হবে। কারণ, দেখা যাবে ওই ব্যবসা চালানোর মতো মূলধন নেই। এতে কর্মসংস্থানের ওপরও প্রভাব পড়বে। ব্যবসার পরিসর ছোট করে আনতে হয়।
এদিকে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মূল্যস্ফীতি সামাল দেয়ার একমাত্র অস্ত্র হিসেবে সুদহার বাড়ানোর দীর্ঘমেয়াদি নীতি আগামী দিনে বুমেরাং হয়ে আঘাত হানতে পারে দেশের ব্যবসা খাতে। এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘সুদহার অনেক বেড়ে গেলে ব্যবসা-বাণিজ্যের খরচ বেড়ে যাবে। কারণ সুদহারের প্রভাবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে উৎপাদনের খরচ বাড়িয়ে দেবে, আমদানির খরচ বাড়িয়ে দেবে। সুদহার বেড়ে গেলে দ্রব্যমূল্যও বেড়ে যায়। অনেকটা বাসভাড়ার মতো। ডিজেলের দাম বাড়লে বাসভাড়া বাড়ে। এ রকম এখানেও বিষয়টি একই রকম দাঁড়াবে। সুদহার একটু বাড়লেই জিনিসপত্রের দাম বাড়া শুরু করবে। ভোক্তাপর্যায়ে মানুষের সহনশীলতা থাকবে না। এতে বিনিয়োগও কমে যাবে।’
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি অভাবনীয়ভাবে কমছে। চলতি ২০২৪ সালের প্রথম আট মাস জানুয়ারি-জুলাইয়ে বাজারটিতে বাংলাদেশসহ শীর্ষ পাঁচ রপ্তানিকারক দেশেরই রপ্তানি কমেছে। তবে অন্যদের তুলনায় বাংলাদেশের রপ্তানি অনেক বেশি কমেছে। ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব কমার্সের আওতাধীন অফিস অব টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেলের (অটেক্সা) হালনাগাদ পরিসংখ্যানে এমন তথ্যই উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীরা চলতি বছরের প্রথম আট মাসে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে সব মিলিয়ে পাঁচ হাজার ১৩০ কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের তৈরি পোশাক আমদানি করেছেন। এই আমদানি গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪ দশমিক ১১ শতাংশ কম।
অটেক্সার তথ্যানুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে গত জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত আট মাসে মোট ৪৭১ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছেন বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা। এই রপ্তানি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৯ দশমিক ১৬ শতাংশ কম। গত বছর একই সময়ে দেশটিতে ৭২৯ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছিল বাংলাদেশ। বর্তমানে এই বাজারে বাংলাদেশ তৃতীয় সর্বোচ্চ পোশাক রপ্তানিকারক। তৈরি পোশাকে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের বাজার হিস্যা এখন ৯ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে চীন। তাদের দখলে রয়েছে পোশাকের ২১ দশমিক ১৮ শতাংশ বাজার হিস্যা। চলতি বছরের প্রথম আট মাসে এক হাজার ৬৯ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে দেশটি, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২ দশমিক ৯৮ শতাংশ কম।
মার্কিন বাজারে দ্বিতীয় শীর্ষ রপ্তানিকারক ভিয়েতনাম। যুক্তরাষ্ট্রে শীর্ষ পাঁচ তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশের মধ্যে ভিয়েতনামই দ্রুত ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। তারা আলোচ্য জানুয়ারি-আগস্ট আট মাসে ৯৫৬ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে, যা গত বছরের একই সময়ের ৯৬৬ কোটি ডলারের রপ্তানির চেয়ে ১ শতাংশ কম। অটেক্সার তথ্যানুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে চতুর্থ ও পঞ্চম শীর্ষ পোশাক রপ্তানিকারক যথাক্রমে ভারত ও ইন্দোনেশিয়ার রপ্তানিও কমেছে। গত জানুয়ারি-আগস্ট সময়ে ভারত রপ্তানি করেছে ৩২১ কোটি ডলারের পোশাক। তাদের রপ্তানি কমেছে ১ দশমিক ৪৭ শতাংশ। অন্যদিকে ইন্দোনেশিয়ার রপ্তানি কমেছে ৭ দশমিক ১৬ শতাংশ। তাদের রপ্তানির পরিমাণ ২৬৮ কোটি ডলার।