পুঁজিবাজার সংস্কারে টাস্কফোর্স গঠন

ক্ষতিগ্রস্তরা পাবেন সরকারি সুবিধা

আনোয়ার হোসাইন সোহেল প্রকাশিত: অক্টোবর ২১, ২০২৪, ১২:০৫ এএম
ক্ষতিগ্রস্তরা পাবেন সরকারি সুবিধা

শেয়ার কেলেঙ্কারি

  • কারসাজি-দুর্নীতিতে ‘অনুসন্ধান ও তদন্ত কমিটি’ গঠন
  • অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাল বিসিএমআইইউএ

অনিয়ম, দুর্নীতি ও কারসাজির  কারণে পুঁজিবাজারের ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের বিশেষ সুবিধা দেয়ার কথা জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। তবে কী ধরনের সুবিধা দেয়া হবে সে বিষয়ে কিছুই জানানো হয়নি। অর্থ মন্ত্রণালয় বলছে, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১৫ বছর মেয়াদে অর্থনীতির অন্য খাতগুলোর মতো পুঁজিবাজারেও অবাধ লুটতরাজ হয়েছে। এ সময়ে অসংখ্য দুর্বল ও প্রায় অস্তিত্বহীন কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে। এ কোম্পানিগুলো পুঁজিবাজারের জন্য এখন বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্রমেই এসব কোম্পানির আসল চেহারা প্রকাশিত হচ্ছে। গতকাল রোববার অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সূত্রটি জানিয়েছে, বাজারে লাগামহীন কারসাজির মাধ্যমে দুর্বল মৌলভিত্তির, জাঙ্ক কোম্পানির শেয়ারের দাম ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। ফ্লোরপ্রাইস আরোপ, সার্কিট ব্রেকারের ঊর্ধ্বসীমা ও নিম্নসীমায় নানা কৃত্রিম ব্যবস্থায় বাজারের এ অবস্থা ঢেকে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু এখন ওই কৃত্রিম চেষ্টা না থাকায় ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকা অনিয়ম, দুর্নীতি, কারসাজির অনিবার্য পরিণতি আগের চেয়েও বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠছে। পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতা, বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সুরক্ষা ও আস্থা ফেরাতে বিগত সময়ের অনিয়ম, কারসাজি ও দুর্নীতির বিষয়ে অনুসন্ধান এবং তদন্তের জন্য একটি ‘অনুসন্ধান ও তদন্ত কমিটি’ গঠন করা হয়েছে বলে জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। 
অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, পুঁজিবাজার উন্নয়ন, বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধি ও আন্তর্জাতিক মানের সুশাসন নিশ্চিত করতে পুঁজিবাজার সংস্কারের সুপারিশের জন্য পাঁচ সদস্যের টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। বিএসইসি গঠিত এ টাস্কফোর্সের ১৭টি কার্যপরিধি নির্ধারণ করা হয়েছে।

জানা গেছে, রেগুলেটরি ফ্রেমওয়ার্কের সংস্কার, রেগুলেটরি কমপ্লায়েন্স ও প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন নিশ্চিতকরণ, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন, পুঁজিবাজারে পণ্য ও বাজার উন্নয়নে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ, বিনিয়োগ শিক্ষার প্রসার ও ব্যাপ্তি বৃদ্ধি, বিনিয়োগকারীদের সচেতনতা বৃদ্ধি, পুঁজিবাজারে কর্মরত পেশাজীবীদের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম জোরদার, বাজারে বৈচিত্র্য আনতে নতুন পণ্য আনা, সর্বোপরি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধি এবং পুঁজিবাজারের গঠনমূলক ও টেকসই সংস্কার ইত্যাদি সংস্কারমূলক কার্যক্রমে বিএসইসি কাজ করছে।

এতে বলা হয়েছে, টাস্কফোর্স কার্যক্রমের বাইরেও অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে পুঁজিবাজারের সার্বিক উন্নয়ন ও সংস্কারে পথনকশা তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনার মধ্য দিয়ে বাজারের বিভিন্ন সমস্যা ও করণীয় বিষয়ে নানা সুপারিশ উঠে এসেছে। বাজারের স্বার্থে যেসব সুপারিশ গ্রহণযোগ্য, যাচাই-বাছাইয়ের পর সেগুলো বাস্তবায়ন করা হলে তাতে দীর্ঘ মেয়াদে বাজারে সুফল মিলবে মর্মে আশাবাদী সরকার। পুঁজিবাজার তদারকি ও কারসাজি নিয়ন্ত্রণে সার্ভিলেন্স সিস্টেমের উন্নয়নে বিশ্বব্যাংকের কাছে সহযোগিতা চেয়েছে বিএসইসি।

অর্থ মন্ত্রণালয় বলছে, পুঁজিবাজারে ভালো মৌলভিত্তির শেয়ারের সরবরাহ বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে বিএসইসি। এর অংশ হিসেবে বড় বড় শিল্পগোষ্ঠীর সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করছে বিএসইসি। পুঁজিবাজারের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন, তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে কোম্পানির ভ্যালুয়েশন, আইপিও অনুমোদন ও তালিকাভুক্তির প্রক্রিয়া সহজীকরণ ও দ্রুত সম্পাদনসহ বিভিন্ন বিষয়ে কাজ করছে কমিশন।

বিভিন্ন খাতের গুরুত্বপূর্ণ শক্তিশালী মৌলভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানিগুলোর দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তি একদিকে যেমন দেশের পুঁজিবাজারকে আরও শক্তিশালী করবে, অন্যদিকে পুঁজিবাজারের মাধ্যমে অর্থায়নের ফলে এসব বিভিন্ন খাতের অধিকতর বিকাশের মাধ্যমে দেশের শিল্পায়ন ও উন্নয়নের গতিকে ত্বরান্বিত করার সুযোগ তৈরি হবে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, পুঁজিবাজারে ভালো মৌলভিত্তিক কোম্পানি তালিকাভুক্তির লক্ষ্যে পাবলিক ইস্যু রুলস ২০১৫-এর সংস্কারের মাধ্যমে কোম্পানিগুলো যেন যৌক্তিক মূল্য পায় সে বিষয়ে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। যা বহুজাতিক কোম্পানিসহ ভালো মৌলভিত্তিক কোম্পানির তালিকাভুক্তিতে সহায়ক হবে।

অর্থ মন্ত্রণালয় বলছে, দেশের পুঁজিবাজারের আকার বৃদ্ধি ও বিনিয়োগের নতুন সুযোগ তৈরির জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে তালিকাভুক্তির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হলে প্রতিষ্ঠানগুলোকে করপোরেট অনুশীলন করতে হবে। নিয়মিতভাবে ব্যবসায়িক কার্যক্রমের তথ্য প্রকাশ করতে হবে, যা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করবে। সরকার আশাবাদী যে সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানি তালিকাভুক্তির মাধ্যমে পুঁজিবাজারে গভীরতা বাড়বে ও সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানির মূলধন ভিত্তি শক্তিশালী হবে। এসব পদক্ষেপের ফলে বড়, মাঝারি ও ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা দ্রুত সুফল পাবেন বলে আশা করছে অর্থ মন্ত্রণালয়।  সম্প্রতি এক প্রেস ব্রিফিংয়ে পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, গত ১৫ বছর কারসাজির কারণে সৃষ্ট পতনে সর্বস্ব হারিয়ে যেসব বিনিয়োগকারী আত্মহত্যা ও হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন তাদের পরিবার থেকে একজনকে চাকরির ব্যবস্থা করে দেয়ার জন্য কর্তৃপক্ষকে উদ্যোগ নিতে হবে।

এছাড়া ২০১০ সালের ধসের পর থেকে আজ অবদি পুঁজিহারা বিনিয়োগকারীদের ৫০ শতাংশ পুঁজির জোগান দিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। চিহ্নিত কারসাজিকারীদের কারণে মহাধসের পর থেকে যেসব পুঁজি হারানো বিনিয়োগকারী তাদের পুঁজি রক্ষায় আন্দোলন করতে গিয়ে হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলার শিকার হয়েছেন, তাদের মামলা নিঃশর্ত প্রত্যাহার করতে হবে। মিথ্যা মামলা চালাতে গিয়ে যত টাকা খরচ হয়েছে তার ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে। 

এদিকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী সম্মিলিত পরিষদের (বিসিএমআইইউএ) সভাপতি আ ন ম আতাউল্লাহ নাঈম আমার সংবাদকে বলেন, ‘পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) যে উদ্যোগ নিয়েছে আমরা তাকে সাধুবাদ জানাই। পাশাপাশি বর্তমান বাজারের পতনরোধে কার্যকর ব্যবস্থা চাই। কারণ বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের অনাস্থার জায়গা যদি থাকে, তাহলে কোনো প্রণোদনাই কাজে আসবে না। এ ক্ষেত্রে অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বিএসইসিকে সমন্বিত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।’