প্রতিবছর পাচার হয় ৮০ হাজার কোটি টাকা
—জেএফআই
ফেরত আনার প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ
—বাংলাদেশ ব্যাংক
অর্থপাচার রোধে প্রয়োজন টেকসই উদ্যোগ
—বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি
পাচার হওয়া টাকা উদ্ধারে টাস্কফোর্স গঠন করা হলেও কেউ জানে না কতদিন লাগবে সেই টাকা উদ্ধারে। তবে আইনি জটিলতা পেরিয়ে কীভাবে পাচার করা টাকা ফেরত আনা যাবে, তা এখনও অনিশ্চিত। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিএফআইইউ, এনবিআর, দুদক, সিআইডিসহ বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা এ কাজে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করবে। তবে এই প্রক্রিয়ায় সময় বেশি লাগবে।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক আর্থিক খাতের গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেগ্রিটির (জিএফআই) তথ্য বলছে, প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে গড়ে ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার বা ৮০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। এই টাকার সিংহভাগই যাচ্ছে বৈশ্বিক বাণিজ্যভিত্তিক কারসাজি, হুণ্ডি, চোরাচালানসহ নানাবিধ পন্থায়। এই টাকার সিংহভাগ গেছে এশিয়া, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে। বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি পাচার হওয়া টাকার গন্তব্য পাওয়া যায় সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই, অস্ট্রেলিয়া, হংকং ও থাইল্যান্ডে।
দেশে থেকে কী কৌশলে টাকা পাচার হয়— সম্প্রতি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সেই তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের ভূমি প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর পাচারের কৌশল তুলে ধরা হয়।
জানা গেছে, প্রথমে ক্ষুদ্রব্যবসা দেখিয়ে টাকাগুলো মধ্যপ্রাচ্য, পূর্ব এশিয়া বা আফ্রিকার কোনো দেশে পাঠানো হয়। পরে সেখান থেকে পর্যায়ক্রমে চলে যায় তৃতীয় কোনো দেশে। অধিকাংশ পাচারকৃত টাকা জমি ক্রয় কিংবা ব্যবসায় লগ্নিকাজে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়।
পাচার করা টাকা কীভাবে টাস্কফোর্সের মাধ্যমে ফেরত আনা হবে— এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা আমার সংবাদকে বলেন, টাস্কফোর্সের মাধ্যমে অর্থ ফেরত আসতে কেমন সময় লাগতে পারে, সে বিষয়ে কেউ আমাদের তেমন ধারণা দিতে পারেনি। বিষয়টিতে বিভিন্ন দেশের আইনি প্রক্রিয়া জড়িত থাকবে। মামলা করার প্রয়োজন হবে। এতে ধারণা করা যায় সময়ক্ষেপণের ফলে সময় বেশি লাগতে পারে। আমরা আশা করছি উন্নত দেশগুলো যেমন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এ ক্ষেত্রে আমাদের সহায়তা করবে। তিনি আরও জানান, গভর্নরের নেতৃত্বে ইতোমধ্যে টাস্কফোর্সের সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। টাস্কফোর্স সক্রিয় হলে বিভিন্ন দেশে গিয়ে আদায় করা সম্ভব হবে।
এ বিষয়ে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে একটি টাস্কর্ফোস গঠন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে তারা কাজ শুরু করেছেন। এরইমধ্যে অনেক বিষয়ই দৃশ্যমান হয়েছে। যেমন খেলাপি ঋণের বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। যেসব ব্যাংকের সমস্যা ছিল, সেসব ব্যাংক রিঅর্গানাইজ করা হচ্ছে। লিকুইডিটি সমস্যার সমাধান করেছেন গভর্নর।’ বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) সূত্র জানিয়েছে, পতিত সাবেক সরকারের বিভিন্ন ক্ষমতাসীন ব্যক্তির পাচার করা টাকা দ্রুত দেশে ফেরত আনা সম্ভব। এজন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের চুক্তি রয়েছে। মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২-এর আওতায় বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া টাকা সহসাই দেশে ফেরত আনা সম্ভব হবে। এজন্য আইনের সংস্কারের খুব বেশি প্রয়োজন হবে না।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির হিসাবে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশে অর্থ পাচারের পরিমাণ হবে কমপক্ষে ৭৫ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা, যা একই অর্থবছরের সৃষ্ট মোট কালোটাকার (৮ লাখ ৪১ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা) ৯ শতাংশের সমপরিমাণ এবং একই অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের ১৬.৩ শতাংশের সমপরিমাণ। এ হিসাবে ৪৬ বছরে (১৯৭২-৭৩ থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে) দেশের মোট অর্থপাচারের পরিমাণ হবে কমপক্ষে ৭ লাখ ৯৮ হাজার ৩২৭ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. মো. আইনুল ইসলাম বলেন, দেশের অর্থনীতিতে ক্যানসার ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়েছে কালোটাকা, অর্থপাচার ও দুর্নীতির মতো মৌলিক সমস্যাগুলো। প্রতিবছর দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অন্তত তিন শতাংশের সমপরিমাণ অর্থ পাচার হয়ে যায়, যা দেশে বহুমাত্রিক বৈষম্য ও দারিদ্র্যের বিস্তার ঘটাচ্ছে এবং দুর্নীতিকে উৎসাহী করছে। যেখানে প্রতিবছর বাজেট সংকুলানের জন্য সরকারকে দেশি-বিদেশি বিপুল ঋণ নিতে হচ্ছে, সেখানে মোট বাজেটের প্রায় এক-পঞ্চমাংশই পাচার হয়ে যাওয়া জাতির জন্য অত্যন্ত উদ্বেগের। তাই অর্থপাচার রোধে প্রয়োজন টেকসই উদ্যোগ।