রাষ্ট্রপতির বিদায় তিন পথে

আবদুর রহিম প্রকাশিত: অক্টোবর ২৫, ২০২৪, ১২:৪২ এএম
রাষ্ট্রপতির বিদায় তিন পথে

আলোচনায় ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’

রাষ্ট্রপতিকে অপসারণে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত আমলে নেবে সরকার

কেউ কেউ দেশপ্রেমিক ব্যক্তির পক্ষে, গণভোটের পক্ষেও অনেকে

রাষ্ট্রপতিকে পদত্যাগে আল্টিমেটাম বিপ্লবীদের

বঙ্গভবনে এখন সারা ুনিয়ার চোখ। রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন প েথাকবেন নাকি বিদায় নিচ্ছেন এটি এখন সর্বত্র আলোচনায়। অন্তর্বর্তী সরকারের সমর্থক বিপ্লবী শিক্ষার্থীরা রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের দাবি তুলেছেন। তারা রাষ্ট্রপতিকে প ছাড়তে আল্টিমেটাম দিয়েছেন। পদত্যাগ না করলে বঙ্গভবন ঘেরাওসহ বড় আন্দোলন গড়ে তুলবেন বলেও ঘোষণা দিয়েছেন। একই সঙ্গে যে সব রাজনৈতিক দল ফ্যাসিবাদের পক্ষ নেবে তাদের বিরুদ্ধেও অবস্থান নেয়া হবে বলে হুমকি দিয়েছেন। শেখ হাসিনা সরকারের অবস্থান বিলুপ্ত করতে কেন্দ্রীয় শহী মিনার থেকে নতুন করে দেয়া হয়েছে পাঁচ দফা কর্মসূচি। বিশেষ করে সংবিধান বাতিল ও রাষ্ট্রপতিকে বিদায়ের জন্য তারা নতুন কর্মসূচি দিয়েছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির পাশাপাশি ইনকিলাব মঞ্চ, রক্তিম জুলাই, ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র-জনতার মঞ্চসহ তাদের সমমনা বেশ কয়েকটি সংগঠনের দাবির প্রেক্ষিতে ড. ইউনূস সরকারকে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। সমাধানের পথ খুঁজতে রাজনৈতিক দলগুলোরও মতামত নেয়া হচ্ছে। তবে সাংবিধানিক কিছু জটিলতা থাকলেও রাষ্ট্রপতির বিদায়ের জন্য ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’ (বিশেষ পরিস্থিতির নীতি) এখন প্রধান আলোচনায়। এ ছাড়া গ্রহণযোগ্য ব্যক্তির পক্ষে গণভোট এবং রাজনৈতিক সিদ্ধান্তেও ‘বিতর্কিত’ রাষ্ট্রপতিকে বিদায় দেয়া যেতে পারে বলে অনেকে মনে করছেন। 

সংশ্লিষ্ট অনেকেই বলছেন, ড. ইউনূস রাষ্ট্রপতি হলে সমস্যা কী বা দেশপ্রেমিক কর্নেল (অব.) অলি আহমদের মতো কাউকে নিয়ে আসলে সমস্যা কোথায়? প্রয়োজনে গণভোটও দেয়া যেতে পারে। জিয়াউর রহমানের মতো সামরিক শাসক যদি গণভোট দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসতে পারেন তাহলে গণঅভ্যুত্থানের সরকারপ্রধান কেন রাষ্ট্রপতি হতে পারবেন না? কিংবা বিপ্লবীদের াবিতে কাউকে গ্রহণ করতে পারবেন না। সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে গণভোটে অংশ নেবে বলেও দেশের বড় অংশ থেকে দাবি উঠেছে। তবে এই মুহূর্তে অপসারণে চাপ বাড়লেও সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো সতর্ক অবস্থায় এগুচ্ছে। রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন নিজে পদত্যাগ করবেন, নাকি সরকার এ বিষয়ে উদ্যোগ নেবে, রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করলে সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি হবে কি না- এসব বিষয় নিয়েই সর্বত্র চলছে জোর আলোচনা। শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতিকে যদি অপসারণের পক্ষেই অবস্থান নেয়া হয়, তবে অপসারণের পদ্ধতি কী হবে, তা শীঘ্রই স্কষ্ট হচ্ছে। 

নাজমুল ইসলাম নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, জুলাই-আগষ্টের স্বাধীনতার লালন এবং মুজিববাদী বাকশালকে প্রতিনিধিত্বকারী সংবিধানের আনুগত্য পালন পরস্কর সাংঘর্ষিক। রাজনৈতিক স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে ২৪ পরবর্তী স্বাধীনতার চেতনাকে লালন করতে না পারলে জনগণ সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে। সুতরাং রাজনৈতিক দলগুলোকেই আন্দোলনকারীদের যৌক্তিক দাবি বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দেয়া উচিত।

এ নিয়ে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, শেখ হাসিনার পদত্যাগ করা না করা এখন আর কোনো ইস্যু না। আর রাষ্ট্রপতি একজন সম্কাদককে যা বলেছেন তা নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল। কিন্তু ওনার প্তর থেকে বিবৃতি দিয়ে তা আবার পরিষ্কার করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি য িতার বক্তব্যে অটল থাকতেন তাহলে শপথ ভঙ্গ হতো। তবে সবাই যদি মনে করেন, একমত হন তাহলে ডকট্রিন অব নেসেসিটির জায়গা থেকে রাষ্ট্রপতিকে সরিয়ে দেয়া যেতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রধান উপদেষ্টা  ও রাষ্ট্রপতি একই ব্যক্তি হতে পারেন। যেভাবে ওয়ান ইলেভেনের আগে অধ্যাপক ইয়াজ উদ্দিন আহমেদ একই সঙ্গে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্বে ছিলেন।

রাষ্ট্রপতিকে অপসারণে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত আমলে নেবে সরকার : রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিনকে পদত্যাগে বাধ্য করা বা অপসারণের বিষয়ে রাজনৈতিক লগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে অন্তর্বর্তী সরকার। গতকাল বৃহস্কতিবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্ম ইউনূসের সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ বিষয়ে বন, পরিবেশ ও জলবায়ুবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের প্রশ্নে সরকার রাজনৈতিক লগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে। দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সমঝোতার ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নেবে সরকার। আলোচনায় একাধিক উপদেষ্টা জানিয়েছেন, রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের ব্যাপারে ছাত্রদের দাবি রয়েছে। অন্যদিকে কোনো কোনো রাজনৈতিক দল বলছে, রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করলে সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি হবে এবং সেটা তারা চায় না। এ পরিস্থিতি আলোচনা করেছে উপদেষ্টা পরিষ। এর ফলে দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করেই এ ব্যাপারে সমাধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।

এ ব্যাপারে বুধবার ুপুরে সচিবালয়ের নিজ দপ্তরে তথ্য উপদেষ্টা নাহি ইসলাম বলেছেন, ‘রাষ্ট্রপতি থাকবেন কি থাকবেন না- প্রশ্নটি এ মুহূর্তে বাংলাদেশে কোনো আইনি বা সাংবিধানিক প্রশ্ন নয়। এটি একেবারেই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।’ তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক সমঝোতা ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতির বিষয়ে একটি সিদ্ধান্তে আসা যেতে পারে। বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা চলছে এবং এর মাধ্যমে একটি সিদ্ধান্ত আসবে। তবে রাষ্ট্রপতি ইস্যুতে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে সরকার রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা, নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।’

আইনজীবীদের ভাষ্য : সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার মাধ্যমেই পদত্যাগ করেছেন। তিনি তার কাজের মাধ্যমেই প্রমাণ করেছেন যে, তিনি আর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নন। ফলে তিনি পদত্যাগ করেছেন কি করেন নাই সে বিতর্ক খুবই অপ্রাসঙ্গিক।’

‘তবে সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগে জটিলতা আছে। কারণ, সংবিধান অনুযায়ী সংসদ সদস্যরা তাকে নিয়োগ দিয়েছেন। এখন তার নিয়োগকারী সংসদই তো নাই। এখন তিনি তার পদত্যাগপত্র কোথায় পাঠাবেন? তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করার কোনো কর্তৃপক্ষ নাই। আবার অন্তর্বর্তী সরকার, যাদের তিনি নিয়োগ দিয়েছেন, তারা কীভাবে তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করবেন,’ বলেন তিনি। তার কথা, ‘তবে এখন তিনি পদত্যাগ করবেন কি করবেন না এটা রাজনৈতিক প্রশ্ন। যেহেতু সংবিধানে সুযোগ নেই, তাই রাজনৈকি লসহ সবার ঐকমত্যের ভিত্তিতে এটা হতে পারে। পরের সংস এসে এর বৈধতা দেবে।’

সুপ্রিম কোর্টের আরেকজন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, ‘এখন স্কিকার নেই, ডেপুটি স্কিকার নোই। ফলে রাষ্ট্রপতি কার কাছে পদত্যাগ করবেন। এখানে একটা শূন্যতা আছে। এক্ষেত্রে একমাত্র পথ হলো ডকট্রিন অব নেসেসিটি। নেসেটিটি এটাকে লিগ্যাল করে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মামলার যে রায় আছে সেখানে এই কথাই বলা হয়েছে। আর তাকে অভিসংশনের কোনো সুযোগ নেই। যেহেতু পার্লামেন্ট নেই, পার্লামেন্ট ছাড়া তো আর অভিসংশন হবে না।’

বঙ্গভবনের সামনে টানা তিন দিন বিক্ষোভ : রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগের দাবিতে বঙ্গভবনের সামনে টানা তৃতীয় দিনের মতো বিক্ষোভ করেছেন কয়েকজন আন্দোলনকারী। এ অবস্থায় বঙ্গভবনের সামনে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। গতকাল বৃহস্কতিবার সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত বঙ্গভবনের সামনে এমন চিত্র দেখা যায়। সরেজমিন দেখা গেছে, বঙ্গভবনের সামনের রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে রেখেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। ব্যারিকেডের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন পুলিশ ও বিজিবির সদস্যরা। এছাড়া আর্মড পুলিশের সদস্যদেরও দেখা গেছে। ব্যারিকেডের ওপর কাঁটাতার দিয়ে বেড়া দেয়া হয়েছে। ব্যারিকেডের পেছনে রয়েছে সেনাবাহিনীর সদস্যরা। সরেজমিন আরও দেখা যায়, বিপুলসংখ্যক সেনা সদস্যের পাশাপাশি, পুলিশ, র?্যাব, এপিবিএন ও বিজিবি সদস্য বঙ্গভবনের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সতর্ক অবস্থানে আছেন। 

আগে থেকেই বঙ্গভবনে প্রবেশের সড়কে কাঁটাতার ও লোহার ব্যারিকেড থাকলেও গতকাল কাঁটাতারের বেড়া আরও বাড়ানো হয়। পাশাপাশি কংক্রিটের ডিভাইডার দেয়া হয় পুরো সড়কজুড়ে। এতে বঙ্গভবনের সামনের সড়ক দিয়ে প্রবেশের রাস্তা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। তবে নিরাপত্তা রক্ষীদের প্রবেশের জন্য পাশেই একটি অস্থায়ী গেট দেখা গেছে। এছাড়া কর্মকর্তাদের প্রবেশের জন্য বঙ্গভবনের পেছনের দিকে একটি পকেট গেট আছে বলে জানা গেছে। বিক্ষোভকারীদের একজন  ইব্রাহিম সাব্বির বলেন, আমরা সাত-আটজন মঙ্গলবার সন্ধ্যা থেকে এখানে আছি। আমরা াবি করেছিলাম রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ। কিন্তু সংবিধানে নিয়ম না থাকার কারণে তাকে বা দেয়া যাচ্ছে না। যে সংবিধান হাসিনা-চুপ্পুর বিচার করতে পারে না, সেই সংবিধান মানি না।