নিজ দেশে ফিরতে চান রোহিঙ্গারা

কক্সবাজার প্রতিনিধি প্রকাশিত: অক্টোবর ২৬, ২০২৪, ১২:০৪ এএম
নিজ দেশে ফিরতে চান রোহিঙ্গারা

ক্যাম্পের ২-৩ হাজার রোহিঙ্গা যুবক এখন অবস্থান করছেন মিয়ানমারে

‘মাতৃভূমির টানে’ লড়ে যাবেন বলছেন ফেরত আসা যুবকরা

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য ও আশেপাশের বিভিন্ন রাজ্যে চলমান সংঘাতে ‘মাতৃভূমির টানে’ লড়াই করছেন কক্সবাজারের উখিয়া শরণার্থী শিবির থেকে পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গা যুবকরা। তারা সেখানে গিয়ে কয়েক দিন যুদ্ধ করে আবার ফিরে আসছেন শরণার্থী শিবিরে। মিয়ানমারের জান্তা সরকার ও বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন আরকান আর্মির সঙ্গে চলা এই যুদ্ধে ভারত, কাশ্মীর ও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অনেক যোদ্ধাও অংশ নিচ্ছেন বলে খবর মিলেছে। মিয়ানমার যুদ্ধে অংশ নিয়ে বাংলাদেশে ফিরে আসা একাধিক রোহিঙ্গা যুবক এমন তথ্যই দিয়েছেন। 

সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য ও তার আশেপাশের বিভিন্ন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আরাকান আর্মিসহ সশস্ত্র দলগুলোর সংঘাত তীব্র হয়ে উঠেছে। নিজ ভূমি রক্ষা করার তাগিদে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শিবিরে অবস্থানরত যুবকরা দলে দলে এই যুদ্ধে অংশ নিতে রাতের আঁধারে সেখানে পাড়ি জমাচ্ছেন। যুদ্ধ করে ফিরে আসা রোহিঙ্গাদের মতে, যারা যুদ্ধ করতে মিয়ানমারে যাচ্ছেন, তারা সবাই নিজ দায়িত্বে লুকিয়ে ক্যাম্প ছেড়ে ওই যুদ্ধে অংশ নিচ্ছেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, টানা তিন দিন ধরে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু শহরে যুদ্ধের তীব্রতা বেড়েছে বহুগুণ। যার রেশ পড়েছে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতেও। কদিন ধরে টেকনাফের স্থানীয় বাসিন্দাদের চোখেও ঘুম নেই বিকট বিস্ফোরণের শব্দে। অনেকের বাড়িঘরেও ফাটল দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তজুড়ে এক ধরনের চাপা আতঙ্ক বিরাজ করছে। 

এদিকে মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে নিজেদের ‘জন্মভূমি রক্ষা’ করতে যুদ্ধে যাওয়া রোহিঙ্গা যুবকরা ফিরে এসে যুদ্ধের ভয়াবহতার বর্ণনা দিয়েছেন। রোহিঙ্গাদের লক্ষ করে কীভাবে সেখানে হামলা চালানো হচ্ছে, সে কথাও জানিয়েছেন বেশ কজন যুবক। এমন কয়েকজন রোহিঙ্গা যুবকের সঙ্গে কথা বলেছেন উখিয়ার সংবাদকর্মীরা। সাংবাদিকদের সংগ্রহ করা তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি করা হলো এই প্রতিবেদন।  

রোহিঙ্গারা লড়ে যাবেন : উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন শরণার্থী শিবির থেকে নিজ মাতৃভূমি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য রক্ষা করতে যুদ্ধে গিয়েছিলেন বেশ কজন যুবক। তাদেরই একজন আবুল মনসুর (ছদ্মনাম)। তিনি গত মাসে মিয়ানমারে যুদ্ধ করে বাংলাদেশে ফিরে এসেছেন। নিরাপত্তার স্বার্থে ছদ্মনাম ব্যবহার করছেন ২২ বছর বয়সি এই যুবক। তিনি জানান, যুদ্ধে কেবল তিনি একাই নন। তার মতো অন্তত তিন হাজার রোহিঙ্গা যুবক এখন সেখানে অস্ত্র হাতে লড়াই করছেন। এই যুদ্ধে মিয়ানমার জান্তা সরকার খানিকটা পিছু হটার পর এখন সেখানে আরাকান আর্মির সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সংঘাত আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। মিয়ানমার জান্তা সরকার যদিও এই যুদ্ধে রোহিঙ্গাদের অস্ত্র ও গোলাবারুদ দিয়ে সহযোগিতা করছে বলে অনেকের কাছে তিনি শুনেছেন। 

রাখাইনের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা যুবক আবু নাইম (ছদ্মনাম) জানান, সেখানকার রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন করা হচ্ছে। নিজের চোখে যা দেখেছেন, তা বলার ভাষা তার নেই। আরাকানে অবস্থানরত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীরা অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন। এমনকি তারা নিজেদের জীবন বাঁচাতে সীমান্ত পাড়ি দিতে প্রস্তুত। আবার অনেকে এখনো লড়ে যাচ্ছেন। তিনি জানান, আগস্ট মাসে উখিয়ার ১৫ নম্বর শরণার্থী শিবির থেকে আরাকান আর্মি অনেককে জোর করে দেশটির জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে ধরে নিয়ে যায়। রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি যদিও জন্মভূমি আরাকানের স্বাধীনতার দাবিতে আরাকান আর্মি, আরসা, আরএসও নামের কয়েকটি সশস্ত্র গোষ্ঠী বিছিন্নভাবে রাজ্যটি দখল করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তার মতে, রোহিঙ্গারা এখনো নিজেদের অধিকার ফিরে পাওয়ার বিষয়ে অনিশ্চয়তায় রয়েছেন। তাই একটি পক্ষ জান্তা সরকারের সহযোগিতায় অধিকার ফিরে পেতে নিজেরাই যুদ্ধ করছেন নানা কৌশলে। তাদের একটাই কথা, রোহিঙ্গারা যদি নিজ দেশে আগে ঢুকতে না পারে, তাহলে কোনো সরকারই তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসবে না। আবু নাইমের দেয়া তথ্যমতে, মিয়ানমার জান্তা সরকারের সঙ্গে অনেক রোহিঙ্গা সমঝোতা করে টিকে থাকতে জিনিসপত্র আনা-নেয়া করা, বাংকার খনন, সেনাবাহিনীর জন্য পানি ও ওষুধপত্র সরবরাহ করার কাজ করছেন। রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে এসব সংগ্রহ করে সেখানে সরবরাহ করছেন।  আবু নাইম বলেন, ‘জান্তা সরকারের সেনারা পুলিশ স্টেশনের ভেতরে অবস্থান করেন। বাইরে বের হন না। 

এক পর্যায়ে মংডু শহরের পাশের একটি মুসলিমপ্রধান গ্রামের পাহারার দায়িত্ব দেয়া হয় আমাকে। আমি চাই, রাখাইন স্বাধীন হোক। স্বাধীন হলে নিজ দেশে ফিরে যাব।’ আবু নাইমের মতো আরও কয়েকজন রোহিঙ্গা যুবক জানান, মিয়ানমারে অবস্থানরত পুরো রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী এখন আরও বেশি ঝুঁকিতে পড়েছে। কারণ সেনাবাহিনীর পক্ষে যুদ্ধে করতে যাওয়ায় বিদ্রোহীরা তাদের ওপর প্রতিশোধমূলক হামলা চালাচ্ছে। যার ফলে নতুন করে হাজার হাজার রোহিঙ্গা দেশ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে। তারা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা করছে। 

নিজ দেশে ঢুকতে চায় রোহিঙ্গারা : আগস্ট মাসের শুরুর দিকে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসেছেন ২৪ বছর বয়সি মোহাম্মদ জুনায়েদ। তার এক নিকটাত্মীয়সহ সীমান্ত পাড়ি দেয়ার সময় হামলায় নিহত হন। জুনায়েদ দাবি করেন, আরাকান আর্মি ও সেনাবাহিনীর সংঘর্ষের মাঝেই ওই নিকটাত্মীয় নিহত হয়েছেন। তখন আরাকান আর্মি ড্রোন হামলাও করে। এ হামলায় অনেক রোহিঙ্গা মারা যান। তার ভাষ্যমতে, ‘অনেক মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখেছি। নদীর পাড়ে বহু রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে।’ জোনায়েদ বলেন, মংডু শহর ও তার আশেপাশে আরাকান আর্মির সঙ্গে থেমে থেমে যুদ্ধ হচ্ছে। কখনও এই যুদ্ধ মিয়ানমার সেনাদের সঙ্গে আরাকান আর্মির যুদ্ধেও রূপ নিচ্ছে। তারা একে অপরের ওপর বোমা হামলা করছে। ভারী ভারী অস্ত্র ব্যবহার করছে। হামলায় বেশিরভাগ যারা মারা যাচ্ছেন, তারা সবাই মুসলিম রোহিঙ্গা। 

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, বাংলাদেশের বিভিন্ন রোহিঙ্গা শিবির থেকে অন্তত ২-৩ হাজার রোহিঙ্গা এখন রাখাইনে অবস্থান করছেন। অন্যদিকে জান্তার পক্ষে যুদ্ধে যোগ দিলে তাদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়া হবে বলেও কথা দেয়া হয়েছে। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার তথ্যমতে, সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে নতুন করে বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর তীব্র সংঘাত শুরু হওয়ার পর থেকে কয়েক মাসে অন্তত ৪০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। অনুপ্রবেশের সময় অনেক রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠিয়েছে বিজিবি। রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করা একটি আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার (এনজিও) কর্মী, ১৫ নম্বর আশ্রয় শিবিরের বাসিন্দা আনোয়ার সাদেক বলেন, ‘আমরা নিজ জন্মভূমি আরাকানে ফিরে যেতে চাই। কিন্তু এখন সেখানে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সেনাবাহিনীর তীব্র সংঘর্ষ চলছে। কীভাবে ফিরে যাব! শান্তি ফিরে এলে রোহিঙ্গারা ফিরে যেতে আগ্রহী। তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘের সহযোগিতায় রোহিঙ্গাদের টেকসই প্রত্যাবাসন করতে পারলে আমরা ফিরে যাব। অনেকবার প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া নিয়ে বাংলাদেশ সরকার কাজ করেছে। যখনই প্রত্যাবাসনের কথা শুরু হয়, তখনই আরাকানে নতুন করে সংঘর্ষ ও সংঘাত চলে। তারমতে, রোহিঙ্গাদের আত্মীয়-স্বজন যারা এখনো আরাকানে রয়েছেন, তাদের অবস্থা খুবই খারাপ। তারা বাংলাদেশে পালিয়ে আসার জন্য সীমান্তে জড়ো হয়ে আছেন। 

কক্সবাজারে দায়িত্বরত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) ড. মোহাম্মদ মিজানুর রহমান জানান, সাম্প্রতিক সময়ে রাখাইন থেকে নির্যাতনের শিকার হয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ৩০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আর কাউকে জায়গা দেয়া আমাদের সামর্থ্যের বাইরে। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর নতুন করে আসা রোহিঙ্গাদের রেজিস্ট্রেশন নিয়ে কাজ করছে। তবে রোহিঙ্গা যুবকদের মিয়ানমারে গিয়ে যুদ্ধ করার বিষয়টি জানা নেই বলে জানিয়েছেন শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার ড. মোহাম্মদ মিজানুর রহমান।

প্রসঙ্গত, মিয়ানমার জান্তা সরকারের নির্যাতনের অভিযোগ তুলে প্রাণ রক্ষায় ২০১৭ সালে লাখো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে এরই মধ্যে অর্থনীতি ও নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন বাংলাদেশ সরকার। এমন পরিস্থিতিতে নতুন করে রোহিঙ্গাদের আগমনকে নেতিবাচকভাবেই দেখছে স্থানীয় বাংলাদেশিরা।