- যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস দেখার অপেক্ষায় সারা দুনিয়া
- ভোট যুক্তরাষ্ট্রে বহু সমীকরণ বাংলাদেশে
- এবার নির্বাচনের ফলাফলে দীর্ঘ অপেক্ষার ইঙ্গিত
- কেউ বিজয়ী হলেও পুনরায় ফলাফল গণনার সম্ভাবনা
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ভোটগ্রহণ চলছে। এ নির্বাচনে রিপাবলিকান দলের হয়ে লড়ছেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। অন্যদিকে ডেমোক্রেটিকের হয়ে লড়ছেন বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস। এ নির্বাচনে কে বিজয়ী হবেন তা নিয়ে পুরো বিশ্ব চিন্তায় মগ্ন। ভোটাররা এমন একজন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করবেন যিনি দেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় মেয়াদে হোয়াইট হাউসে ফিরবেন অথবা এমন একজনকে যিনি দেশের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হবেন।
বিগত সময়ের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ভোটগ্রহণ শেষ হলেই কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ফলাফল ঘোষণা করা হতো। কিন্তু এ বছর কমলা হ্যারিস ও ট্রাম্পের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হচ্ছে। এর ফলে এবার নির্বাচনের ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ডেমোক্রেটিক প্রার্থী ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস এবং রিপাবলিকান প্রার্থী ও সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনি প্রচারণায় কেউ কাউকে ছাড় দেয়নি। হাড্ডাহাড্ডিভাবে লড়াই চালিয়েছেন। অবস্থা এমন দাঁড়িয়ে যে কাউকে বিজয়ী ঘোষণার পর হয়তো আবার ফলাফল গণনা করতে হতে পারে।
এক্ষেত্রে সুইং স্টেট পেনসিলভানিয়ার কথা উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে। এ রাজ্যে যদি বিজয়ী এবং হেরে যাওয়া প্রার্থীর মধ্যে পয়েন্টের ক্ষেত্রে ভোটের ব্যবধান হাফ পার্সেন্টও হয় তাহলে ফলাফল আবার গণনা করতে হবে। এছাড়া আইনি লড়াইও হতে পারে। কারণ নির্বাচনের আগেই রিপাবলিকান দলের আইনজীবী ১০০টির বেশি মামলা করে রেখেছেন। এক্ষেত্রে ভোট গণনা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে আইনি লড়াই হতে পারে। আর যদি নির্বাচনি কেন্দ্র নিয়ে কোনো ঝামেলা হয় তাহলে ফলাফল পেতে দেরি হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের ভোটাররা গতকাল দেশের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করার জন্য ভোট দিচ্ছেন। আমেরিকার পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে স্থানীয় সময় ভোর ৬টায় (গ্রিনিচ মান সময় ১১:০০) ভোট গ্রহণ শুরু হয় । ভোট গ্রহণ চলবে ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা সময় ধরে। পঞ্চাশটি রাজ্যে এবং ডিসট্রিক্ট অফ কলাম্বিয়ায় ১৮ কোটি ৬০ লাখ ভোটার ভোট দিতে পারবেন। তবে বেশির ভাগ রাজ্যে ডাকযোগে ভোট এবং আগাম ভোট দেয়ার ব্যবস্থা থাকায় আট কোটির বেশি মানুষ ইতোমধ্যেই ভোট দিয়ে ফেলেছেন।
কমলা-ট্রাম্পের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই : ঐতিহ্য মেনে যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ছোট্ট শহর নিউ হ্যাম্পশায়ারের ডিক্সভিল নচ কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ শেষ হয়েছে। সংবাদমাধ্যম এবিসি নিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশটির অন্যান্য অংশে সকাল থেকে ভোট শুরু হলেও ডিক্সভিল নচ নামের ছোট গ্রামের একমাত্র ভোটকেন্দ্রটিতে গতকাল মধ্যরাত ১২টার (৫ নভেম্বর) পরপরই প্রথম প্রহরে ভোটগ্রহণ শুরু হয়। ‘ভাগ্য নির্ধারণী’ হিসেবে পরিচিত ভোটকেন্দ্রটিতে মাত্র ছয়জন নিবন্ধিত ভোটার। ১০ মিনিটের মধ্যেই তাদের ভোটগ্রহণ পর্ব শেষ হয়। প্রত্যেকে ভোট দিয়ে কেন্দ্র থেকে বের হয়ে যান এবং সঙ্গে সঙ্গে ফলাফলও প্রকাশ করা হয়। সেখানে মূল দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী কমলা হ্যারিস এবং ডোনাল্ড ট্রাম্প সমান তিনটি করে ভোট পেয়েছেন। এর আগে, সংবাদকর্মীদের উপস্থিতিতে অ্যাকর্ডিয়নের সুরে মার্কিন জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনার মাধ্যমে ভোটগ্রহণ শুরু হয় ডিক্সভিল নচে। নিউ হ্যাম্পশায়ারের নির্বাচনি আইন অনুযায়ী, কোনো আসনে ভোটারের সংখ্যা ১০০ জনের কম হলে তারা মধ্যরাত থেকে ভোটকেন্দ্র চালু রাখতে পারে। সব নিবন্ধিত ভোটার তাদের নাগরিক অধিকারের চর্চা বা ভোটাধিকার প্রয়োগ শেষ করতে পারা মাত্রই ভোটগ্রহণ বন্ধ হয়। তাৎক্ষণিকভাবে গণনাও শেষ করে ফেলা হয়। ২০২০ সালে ডিক্সভিল নচ কেন্দ্রের পাঁচ ভোটারের সবাই জো বাইডেনকে ভোট দিয়েছিলেন। তিনিই এই গ্রামের ইতিহাসে দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে সবার রায় পেয়েছিলেন। ২০১৬ সালে সাত ভোটের মধ্যে হিলারি ক্লিনটন পেয়েছিলেন ৪টি। ১৯৬০ থেকে সেখানে এই মধ্যরাতেই ভোট শুরু হয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ছোট এই গ্রামেও কমলা-ট্রাম্পের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই এবারের মার্কিন নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ মনোভাবকে ফুটিয়ে তুলেছে। ৬০তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনি তথ্য : কমালা হ্যারিস। ডেমোক্র্যাটিক পার্টির মনোনীত প্রার্থী ভাইস প্রেসিডেন্ট। ৬০ বছর বয়সি হ্যারিস বিজয়ী হলে তিনি প্রথম নারী, প্রথম অশ্বেতাঙ্গ নারী ও প্রথম এশীয় নারী হিসেবে প্রেসিডেন্ট হবেন।
ডোনাল্ড ট্রাম্প : রিপাবলিকান পার্টির মনোনীত প্রার্থী সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ট্রাম্প ২০১৭ থেকে ২০২১ পর্যন্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেছেন। ট্রাম্পের বয়স এখন ৭৮। তিনিই যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বয়সি প্রেসিডেন্ট প্রার্থী। বিজয়ী হলে তিনিই হবেন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সর্বজ্যেষ্ঠ প্রেসিডেন্ট।
তৃতীয় দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থী : বেশিরভাগ অঙ্গরাজ্যে চারটি ছোট দল বা স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ভোট দেয়ার সুযোগ পাবেন ভোটাররা। তারা হলেন— জিল স্টেইন (গ্রিন পার্টি) চেইস অলিভার (লিবারটারিয়ান পার্টি)রবার্ট এফ. কেনেডি জুনিয়র (স্বতন্ত্র, নির্বাচন থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিলেও এখনো বেশিরভাগ অঙ্গরাজ্যের ব্যালটে তার নাম রয়েছে)।
চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ১৮ কোটি ৬০ লাখ আমেরিকান ভোট দেয়ার জন্য নিবন্ধন করেছেন। অর্থাৎ, ভোট দেয়ার বয়স হয়েছে এমন প্রতি ১০ আমেরিকানের মধ্যে আটজনই নিবন্ধন করেছেন। ২০টি রাজ্য ও ওয়াশিংটন ডিসিতে ভোটের দিনও নিবন্ধন করা যায়। ৫০টি অঙ্গরাজ্য ও ওয়াশিংটন ডিসিতে নির্বাচনের দিন সশরীরে ভোট দেয়ার ব্যবস্থা থাকে। এ বছরের ক্ষেত্রে দিনটি ৫ নভেম্বর। পাশাপাশি, বেশিরভাগ অঙ্গরাজ্যে ডাকযোগেও ভোটের ব্যবস্থা থাকে। ভোটাররা চিঠির মাধ্যমে পূরণকৃত ব্যালট পেপার পাঠাতে পারেন অথবা কোনো সুনির্দিষ্ট ড্রপ-অফ স্থানে তা জমা দিয়ে যেতে পারেন। বেশিরভাগ অঙ্গরাজ্যে আগাম ভোটেরও ব্যবস্থা থাকে। আগাম ভোটদানের সুযোগ কাজে লাগিয়ে ব্যক্তিগতভাবে ভোট কেন্দ্রে গিয়ে বা ডাকযোগে এরই মধ্যে ৮০ মিলিয়নেরও বেশি আমেরিকান ভোট দিয়েছেন।
আমেরিকার ভোটাররা যখন ভোট দেন, তখন তারা সরাসরি তাদের পছন্দের প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকে তা দেন না। কারিগরি দিক দিয়ে চিন্তা করলে, তারা তাদের পছন্দের ইলেক্টর বেছে নেন, যারা ইলেক্টোরাল কলেজের অংশ। এরপর এই ইলেক্টররা প্রেসিডেন্ট বেছে নেন। ইলেক্টোরাল কলেজ হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে প্রতিটি অঙ্গরাজ্য থেকে প্রতিনিধি বা ইলেক্টর বেছে নেয়া হয়। প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের ইলেক্টরের সংখ্যা ভিন্ন। যারা আমেরিকার সংবিধানের বুনিয়াদ রচনা করেছিলেন, তাদের প্রত্যাশা ছিল প্রেসিডেন্ট পদের প্রার্থী একটি জাতীয় নির্বাচনের বদলে বেশ কয়েক দফা আঞ্চলিক নির্বাচন জিতে আসবেন, যাতে সেই প্রেসিডেন্ট আরও ভালো করে দেশের মানুষের নানামুখী স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন। দুইটি অঙ্গরাজ্য (মেইন ও নেব্রাস্কা) ছাড়া, বিজয়ী প্রার্থীর পক্ষেই অঙ্গরাজ্যের সব ইলেক্টর যোগ হয়। এ ক্ষেত্রে পপুলার ভোটে দুই প্রার্থীর মধ্যে ব্যবধান যত ছোট কিংবা বড় হোক না কেন, তাতে কিছু পরিবর্তিত হয় না। ইলেক্টরের সংখ্যা ৫৩৮, যা কখনো বদলায় না। এই সংখ্যাটি যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের মোট সদস্য সংখ্যার সমান ৪৩৫ জন প্রতিনিধি, ১০০ জন সেনেটর ও কলাম্বিয়া ডিসট্রিক্টের তিন ইলেক্টর। প্রেসিডেন্ট হিসেবে জয়ী হতে হলে একজন প্রার্থীকে সংখ্যাগরিষ্ঠ ইলেক্টোরাল ভোট জিততে হয়, যা হলো অন্তত ২৭০। যদি কোনো প্রার্থী ন্যূনতম ২৭০টি ইলেক্টোরাল ভোট না জেতেন, তাহলে হাউজ অফ রিপ্রেজেন্টেটিভ প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করে থাকে।
ভোট যুক্তরাষ্ট্রে বহু সমীকরণ বাংলাদেশে : মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ঘিরে আলোচনায় বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রাম্প-কমলা যেই ক্ষমতায় আসুক বদলাবে না বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের সমীকরণ। তবে বাধ সাধতে পারে দেশটির কঠোর অভিবাসন নীতি। শঙ্কা রয়েছে রোহিঙ্গাদের জন্য আর্থিক সহায়তা বন্ধেরও। বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক গেল এক দশক ধরেই নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সম্পর্কের বরফ গলতে শুরু করলেও ফের আগুনে ঘি ঢাললো বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক টুইটবার্তা। ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের সমীকরণটা কেমন হবে তা নিয়ে ফের সরগরম রাজনীতির মাঠ। তবে তা মাথায় না নিয়ে দেশে সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চালু রাখার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। এ বিষয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ূন কবির বলেন, বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের আড়ালে ভারতের সংযুক্তিও নতুন নয়। তিনি বলেন, আমাদের নির্বাচনের আগেও কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার জন্য বেশ উচ্চকণ্ঠ ছিল। কিন্তু ভারতের প্রভাবেই শেষের দিকে তারা চুপ হয়ে গেল। কাজেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে ভারতের সংযোগ নতুন না। আমরা অভ্যন্তরীণভাবে আমাদের শক্তির ওপর দাঁড়ানোটাই সবচেয়ে বড় কাজ।