দীর্ঘদিন ধরে নতজানু পররাষ্ট্রনীতির কারণে প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত সম্পর্ক সমতায় ফেরেনি। অনেক সময় ভারত নিয়ম লঙ্ঘন করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেছে, যা একটি স্বাধীন দেশের নাগরিকদের জন্য মোটেই মর্যাদাপূর্ণ নয়। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার বিদায় নেয়ার পূর্ব পর্যন্ত দুই দেশের সম্পর্ক সরকার ও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ছিল, কিন্তু প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সম্পর্ক কোনো রাজনৈতিক দলের বা সরকারের সঙ্গে নয়, সম্পর্ক হতে হবে দুই দেশ ও দেশের জনগণের সঙ্গে। যেখানে বিশেষ কোনো দল বা মতাদর্শের সঙ্গে নয়, দুই দেশই স্বার্থরক্ষায় নিজস্ব পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করবে। যাতে নতজানুু নয়, সমতার ভিত্তিতে সম্পর্কের আরও উন্নতি হবে। উন্নয়ন-অগ্রগতির ক্ষেত্রে প্রয়োজনে সমঝোতার ভিত্তিতে যৌথ প্রয়াশ চালাতে হবে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ও ভারতের কিছু বিষয় নিয়ে তৈরি হওয়া তর্ক-বিতর্কের মধ্যে দেশের রাজনীতিক ও বিশ্লেষকরা এমন মনোভাব প্রকাশ করেছেন।
বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে নিয়ে ভারতীয় মিডিয়ার ভুয়া সংবাদ পরিবেশন নিয়েও বেশ বিতর্ক চলছে। শুধু বাংলাদেশেই বিতর্ক হচ্ছে তা কিন্তু নয়, খোদ ভারতেই ভুয়া সংবাদু পরিবেশন নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে এবং বাংলাদেশে জনপ্রত্যাখ্যাত একটি দলের নেত্রীকে ভারতে আশ্রয় দেয়া নিয়েও সে দেশের নাগরিকের মধ্যে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। এ বিষয়ে নরেন্দ্র মোদি সরকারকে নিয়ে বিতর্ক করতে ছাড়ছেন না অনেক নাগরিক। এরই মধ্যে গতকাল সশস্ত্রবাহিনীর সাবেক সদস্যরা ঢাকায় একটি সমাবেশ করেছেন। ওই সমাবেশ থেকেও ভারতের সঙ্গে পররাষ্ট্রনীতি সমতার ভিত্তিতে হতে হবে বলে জোর দাবি তোলা হয়েছে।
শনিবার (৭ ডিসেম্বর) সকালে রাজধানীর মহাখালীতে রাওয়া ক্লাবের সামনে ‘জাতীয় ঐক্য ও সংহতি পরিষদ’-এর ব্যানারে আয়োজিত সমাবেশে এ কথা বলেন সশস্ত্রবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তারা। কর্নেল (অব.) মোহাম্মদ ষ এরপর পৃষ্ঠা ১১ কলাম ১
আহসানুল্লাহ ছিলেন ওই সমাবেশের আহ্বায়ক। সমাবেশে কয়েকশ নারী-পুরুষ অংশ নেন। তারা সমাবেশ শেষে রাওয়া ক্লাব থেকে মিছিল নিয়ে মূল সড়ক ধরে বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর গেট পেরিয়ে বিমানবাহিনী স্টাফ কোয়ার্টার পর্যন্ত যান। সেখান থেকে আবার মিছিল নিয়ে রাওয়া ক্লাবের সামনে ফিরে কর্মসূচি শেষ করেন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) লুৎফুল হক।
মোহাম্মদ আহসানুল্লাহ সমাবেশে বলেন, নতজানু পররাষ্ট্রনীতিকেকোনো অবস্থাতেই আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়া হবে না। আর কোনো নতজানু পররাষ্ট্রনীতি নয়, সাম্যতার ভিত্তিতে পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করতে হবে। ভারতের জনগণের সঙ্গে এ দেশের মানুষের কোনো শত্রুতা নেই, তারা (ভারতের জনগণ) এ দেশের মানুষের বন্ধু। কিন্তু ভারতের গেরুয়া পোশাকধারী হিন্দু আধিপত্যবাদকে কোনোভাবেই এ দেশে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়া হবে না। এ দেশের মানুষ যুগ যুগ ধরে সম্প্রীতির সঙ্গে বসবাস করছে উল্লেখ করে আহসানুল্লাহ বলেন, “হজরত শাহজালাল (রা.), হজরত শাহ মখদুম (রা.), অতীশ দীপঙ্কর, শ্রীচৈতন্য, অনুকূল ঠাকুর, লোকনাথ ব্রহ্মচারী প্রমুখের আবাসভূমি এই বাংলাদেশ। আমরা যুগ যুগ ধরে এই শ্যামলভূমিতে সম্প্রীতির সঙ্গে বসবাস করে আসছি। কিন্তু অতিউদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি, সম্প্রতি বাংলাদেশের ‘লেডি ফেরাউন’ পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে ভারতের হিন্দু নেতৃত্বের শ্যেনদৃষ্টি পড়েছে আমাদের দিকে। তাদের ইদানীংকালের কর্মকাণ্ড এটাই সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করে।” তিনি বলেন, ‘তাদের (হিন্দু নেতৃত্বের) সর্বশেষ উদ্যোগ ছিল আগরতলা ও কলকাতার বাংলাদেশি মিশনে আক্রমণ চালানো এবং আমাদের বাংলাদেশের পতাকাকে অবমাননা করা। আমরা এই ঘটনাগুলোকে আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি হিসেবে মনে করছি।’
ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী কোনো দূতাবাসে হামলার অর্থ হলো সেই দেশের সার্বভৌমত্বের ওপর হামলা উল্লেখ করে আহসানুল্লাহ বলেন, এই সংকটময় পরিস্থিতিতে যখন সার্বভৌমত্বের ওপর হামলা হয়, দেশের পতাকা পদদলিত হয়, তখন সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যরা চুপ থাকতে পারেন না। দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে জাতিকে ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করতে হবে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শক্তি সম্পর্কে বলতে সমাবেশে লে. কর্নেল (অব.) মনীষ দেওয়ান বলেন, ‘মোদিজি (নরেন্দ্র মোদি), অমিতজি (অমিত শাহ) এবং রাজনাথজি (রাজনাথ সিং)— আপনারা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর যেটা দেখেছেন, সেটি বাহাত্তর সালের। সেই সেনাবাহিনী এখন আর নেই। আমরা এখন যে কোনো শত্রুর মোকাবিলায় প্রস্তুত। আপনারা আর আস্ফাালন তুলবেন না, ভয় দেখাবেন না। আপনাদের সীমান্তেই রুখে দিতে আমাদের সশস্ত্রবাহিনীর সঙ্গে ১৭ কোটি জনতা আছে।’
শনিবারেরএই সমাবেশে বক্তারা আরও বলেন, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলার ঘটনা এ দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি। এমন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক বিভাজন, ধর্ম, দল ও মতের ঊর্ধ্বে উঠে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে হবে। দেশের তরুণ প্রজন্ম এবং ছাত্র-জনতাকেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। পাশাপাশি ভারত প্রশ্নে নতজানু পররাষ্ট্রনীতির বদলে সমতার ভিত্তিতে পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ করতে হবে।