জানুয়ারিতে বাড়তে পারে সুদহার

অর্থনৈতিক প্রতিবেদক প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৪, ২০২৪, ১০:৩৪ পিএম
জানুয়ারিতে বাড়তে পারে সুদহার

পতিত সরকার থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে প্রাণান্তকর চেষ্টা করছে অন্তর্বর্তী সরকার। তবে এখনো সেই মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি। আগামী মাসের মধ্যে যদি না কমে তখন মুদ্রানীতি আরও কঠোর করা হবে বলে জানিয়েছেন গভর্নর। মুদ্রনীতি কঠোর করার অর্থই হচ্ছে নীতি সুদহার আরও বাড়বে। আর নীতি সুদহার বাড়লে এর প্রভাবে ব্যাংক ঋণের সুদের হারও বাড়বে। ইতোমধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল্যস্ফীতি কমাতে মুদ্রানীতি যথেষ্ট কঠোর করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারকে ছাপিয়ে একটি টাকাও দেয়নি। লাগলে সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে। সরকারও ব্যয় কমিয়েছে, বাজেটের অভ্যন্তরীণ ঋণকে যুক্তিসঙ্গত স্তরে রাখার চেষ্টা করছে। 

আগামী জুনের মধ্যে মূল্যস্ফীতি সাত শতাংশে নেমে আসবে বলে আশা করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেছেন, আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি পাঁচ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য রয়েছে সরকারের। এ জন্য কঠোর মুদ্রানীতি অনুসরণসহ অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যপণ্য আমদানিতে শুল্ক তুলে দেয়া হয়েছে। আগামী মাসে অর্থাৎ জানুয়ারির মধ্যে মূল্যস্ফীতি কিছুটা না কমলে মুদ্রানীতি আরও কঠোর করা হবে। গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর শেরাটন হোটেলে ব্রোকারেজ হাউস ব্র্যাক ইপিএল এবং পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এশিয়ান টাইগার ক্যাপিটাল পার্টনার্সের আয়োজনে বিনিয়োগকারী সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন গভর্নর। সরকার এখন যেসব সমস্যা মোকাবিলা করছে, তার সবই উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া বলে মন্তব্য করেন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, এখনকার বড় সমস্যা মূল্যস্ফীতি। একে বাগে আনতে সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে যা কিছু করার ছিল, তার সবটাই করা হয়েছে। তারপরও হতাশা আছে, মুদ্রাস্ফীতি এখনও নামছে না। মূল্যস্ফীতি কমাতে মুদ্রানীতি যথেষ্ট কঠোর করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারকে ছাপিয়ে একটি টাকাও দেয়নি। লাগলে সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে। সরকারও ব্যয় কমিয়েছে, বাজেটের অভ্যন্তরীণ ঋণকে যুক্তিসঙ্গত স্তরে রাখার চেষ্টা করছে।

গভর্নর বলেন, পণ্য সরবরাহে ঘাটতি একটা বড় সমস্যা হয়ে আছে। গত আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে বন্যা হয়েছিল, বর্ষাকালও দীর্ঘ ছিল। এ কারণে, পেঁয়াজ, আলুর মতো ফসল এবং শীতকালীন শাকসবজি স্বাভাবিক সময়ের মধ্যে বাজারে আসতে পারেনি। এক থেকে দুই মাস বিলম্বিত হয়েছে। পেঁয়াজ ও আলুর ভালো ফলন হবে এবং দুই মাস বাদে ৩০ টাকা, ৪০ টাকায় নেমে আসবে বলে আশা করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘সরবরাহ ঠিক করতে সরকার অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যপণ্যের সব ধরনের আমদানি শুল্ক তুলে দিয়েছে। পেঁয়াজ, তেল, চিনি, মৌলিক খাদ্য পণ্যের দাম ভোক্তাদের জন্য একটু সহনীয় করতে যা করতে পারি, তার কিছুই বাকি রাখিনি। আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে কিছু ফলাফল আশা করছি। এখন নীতি সুদহার ১০ শতাংশ এবং ঋণের সুদহার প্রায় ১৪ শতাংশ বা তার কাছাকাছি। সম্ভবত  এটা সর্বোচ্চ। জানুয়ারির মধ্যে যদি মুদ্রাস্ফীতি না কমে, তাহলে আমাকে আরও কঠোর আর্থিক নীতি নিতে হবে।’ 

প্রসঙ্গত মুদ্রনীতি কঠোর করার অর্থই হচ্ছে নীতি সুদহার আরও বাড়বে। আর নীতি সুদহার বাড়ার প্রভাবে ব্যাংক ঋণের সুদের হারও বাড়ে। আহসান এইচ মনসুর বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লক্ষ্য আগামী জুনের শেষ নাগাদ মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশে নামিয়ে আনা এবং আগামী অর্থবছরে পাঁচ শতাংশের কমে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা থাইল্যান্ড এবং অন্যান্য দেশ থেকে যে শিক্ষাটি আমরা পেয়েছি তা হলো, এটি ঠিক করতে কমপক্ষে এক বছর সময় লাগবে। সে সময় দিতে হবে। এজন্য যেসব ওষুধ প্রয়োগ করা যেতে পারে, তা প্রয়োগ করা হয়েছে। আমরা এখন ফলের জন্য অপেক্ষা করছি। তিনি বলেন, অর্থনীতির ক্ষেত্রে বড় তিনটি চ্যালেঞ্জ হলো বহিস্থ খাতের দুর্বলতা, মূল্যস্ফীতি এবং দুর্বল ব্যাংক খাত। অন্তর্বর্তী সরকার উত্তরাধিকার সূত্রে বিদেশি অর্থ পরিশোধে ঘাটতি পেয়েছে আড়াই বিলিয়ন ডলার। রিজার্ভও ক্রমাগত কমছিল। বিদেশি ব্যাংকগুলো এলসি খুলতে রাজি না হওয়ায় আমদানিতে সমস্যা হচ্ছিল। বর্তমান সরকারের বয়স চার মাস। এই অল্প সময়ের মধ্যে এলসি খোলা-সংক্রান্ত সমস্যা কেটেছে। যেখানে এলসি বিল পরিশোধ ২৫০ কোটি ডলারের বেশি বকেয়া ছিল, এখন তা ৩০ কোটি ডলারে নেমেছে। ব্যাংকগুলোর সঙ্গে কথা বলে সমস্যা দূর করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এটাকে শূন্যে নামিয়ে আনাই লক্ষ্য। গভর্নর বলেন, একটাও এলসি বিল অপরিশোধিত রাখা সহ্য করব না। 

ব্যাংকগুলোকে স্পষ্ট করে বলেছি, এলসি খোলা হলে সে এস আলম বা অন্য যেই খুলুক না কেন, এটা ব্যাংকের দায়। ব্যাংককেই তা নিষ্পত্তি করতে হবে। যেসব বিল এখনও বকেয়া আছে, আমি আশাবাদী, এক মাসের মধ্যে এটি শূন্য হয়ে যাবে। অতীতে রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যাংক খাত লুট হওয়ায় এ খাতের সমস্যা সমাধান সহজ নয় বলে মনে করেন গভর্নর। তিনি বলেন, সবাই জানে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যাংক খাত লুট হয়েছে। একটি ব্যাংক থেকে ৮৭ শতাংশ ঋণ একটি পরিবার বা তাদের সন্তানদের দেয়া হয়েছে। বেশ কয়েকটি ব্যাংকে এমন ঘটনা ঘটেছে। টাকাগুলো বিদেশে পাচার হয়েছে। সমস্যা সমাধানে এরই মধ্যে ব্যাংক পুনরুদ্ধার আইনের খসড়া তৈরি হয়েছে, যার অধীনে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে প্রয়োজন অনুযায়ী কঠোর ও বাস্তবভিত্তিক ব্যবস্থা যেমন অবসায়ন, একীভূতকরণ, নতুন মূলধন নিতে বাধ্য করার ক্ষমতা দেয়ার কথা বলা হয়েছে। বিদেশে পাচার করা টাকা উদ্ধারে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে জানিয়ে গভর্নর বলেন, ‘আমরা ইউরোপীয় সম্পদ পুনরুদ্ধার প্রোগ্রাম, বিশ্বব্যাংক গ্রুপের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। এসব সংস্থাগুলোর দুর্দান্ত সমর্থন পাচ্ছি। মার্কিন ট্রেজারি ইতোমধ্যে দুইবার পরিদর্শন করেছে এবং তারা জানুয়ারিতে আবারও বাংলাদেশে আসবেন। আশা করি, অর্থ উদ্ধারের জন্য আমরা আন্তর্জাতিক ও রাজনৈতিক সমর্থন পাব।’ পদ্ধতিগতভাবে বিভিন্ন সমস্যা সমাধান করে পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের জন্য একটি ভালো সামগ্রিক সামষ্টিক অর্থনৈতিক অবস্থা রেখে যেতে চান বলেও জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর। 

বিশ্বব্যাংকের ঢাকাস্থ কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, নতুন সরকার অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা স্বাভাবিক ধারায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে। বর্তমানে ডলারের দাম অতিমূল্যায়িত। এটা কমলে তা পণ্যমূল্য ও মূল্যস্ফীতি কমতে সাহায্য করবে। তবে শুধু মুদ্রানীতি দিয়ে মূল্যস্ফীতি বাগে আনা যাবে না। এ জন্য ‘মার্কেট পুলিশিং’-এর সুপারিশ করেন তিনি। অধ্যাপক মোস্তাক হোসেন খান বলেন, দুর্নীতির প্রধান কারণ সুশাসনের অভাব। বিগত সরকারের সময় দুর্নীতি মাত্রা ছাড়িয়েছিল। ব্যবসায়িক ফোরামগুলোও রাজনীতিকীকরণ হয়েছিল। তাদের আলোচনা শুরুই হতো সরকারপ্রধান ও দলের বন্দনা দিয়ে। 

রাজনৈতিক সংযোগ না থাকলে কেউ প্রতিযোগিতায় ব্যবসা পাওয়ার আশা করত। ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, গত ৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের পর অনেকের মনে শঙ্কা ছিল, এই বুঝি দেশ অর্থনৈতিক মন্দায় পড়ে। আশার কথা, তেমনটি হয়নি। এখন প্রতি মাসে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ বেশি রেমিট্যান্স আসছে। কিছু ব্যাংক সমস্যায় থাকলেও অনেক ব্যাংক আছে, যাদের কোনো তারল্য সংকট নেই। অনুষ্ঠানে আলোচনায় অংশ নেন অর্থনীতিবিদ ড. মাসরুর রিয়াজ, অধ্যাপক মোস্তাক হোসেন খান, ব্র্যাক ব্যাংকের এমডি সেলিম আর এফ হোসেন, ডিএসইর ব্রোকারদের সংগঠন ডিবিএ সভাপতি সাইফুল ইসলাম। সঞ্চালনা করেন এশিয়ান টাইগার ক্যাপিটালের চেয়ারম্যান ইফতি ইসলাম। এতে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের বিনিয়োগকারীরা অংশগ্রহণ করেন।