ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মনিরুল মওলার পদত্যাগের গুঞ্জন উঠেছে। কর্মকর্তাদের রোষানলে পড়ার আশঙ্কায় গত রোববার থেকে অফিসের কাজ বাসায় বসে করছেন বলে জানা গেছে। সম্প্রতি চট্টগ্রামের দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) দায়ের করা মামলায় তাকে আসামি করা হয়েছে। মামলার ১৪ নম্বর আসামি তিনি। মামলার তদন্তে তার বিরুদ্ধে জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংকের অর্থ আত্মসাতের প্রমাণ মিলেছে বলেও দুদকের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
মামলায় আসামি করা হয়েছে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগী বাংলাদেশের আলোচিত শিল্পগোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের মালিক ও ইসলামী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান মো. সাইফুল আলম, তার ছেলে ইসলামী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আহসানুল আলম, ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমডি ও সিইও মনিরুল মওলাসহ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তা ও গ্রুপটির বিভিন্ন পদে থাকা ব্যবসায়ীদের। মনিরুল মওলার বিরুদ্ধে মামলা প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, গত ২০২৩ সালের ২৬ জুন ব্যাংক কোম্পানি আইন পাস হয়। ব্যাংক আইনের সংশোধনীতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক যদি সন্তুষ্ট হয় যে কোনো ব্যাংকের চেয়ারম্যান, পরিচালক বা এমডি নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট লেনদেন বা ক্ষতিকর কার্যকলাপের মাধ্যমে ব্যাংকের তহবিলের অপব্যবহার কিংবা মানি লন্ডারিং তথা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন-সংক্রান্ত অপরাধ করেছেন, তাহলে জনস্বার্থে তাদের পদ থেকে অপসারণ করা যাবে।
এতে আরও বলা হয়েছে, কোনো ব্যাংকের অপসারিত চেয়ারম্যান, পরিচালক বা এমডির ক্ষতিকর কার্যকলাপের কারণে কোনো ব্যাংকের আর্থিক ক্ষতি হলে তাদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রাপ্য টাকা আদায়ের জন্য ওই প্রতিষ্ঠান যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারবে। আর এই তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংককে অবহিত করবে। সে ক্ষেত্রে আদালত আইনের ৮৫ ধারা অনুযায়ী ব্যাংকের দাবি করা অর্থ ফেরত দেয়ার জন্য আদেশ দিতে পারবেন। অর্থ ফেরত দিতে না পারলে তাদের সম্পত্তি ক্রোকের আদেশ দিতে পারবেন আদালত। সংশোধিত আইনে বলা হয়েছে, কোনো পরিচালককে অপসারণের আগে বাংলাদেশ ব্যাংক নোটিশ দেবে। তবে কোনো পরিচালকের বিরুদ্ধে নোটিশের কার্যক্রম চলমান থাকা অবস্থায় তিনি পদত্যাগ করলে তা কার্যকর হবে না। নোটিশপ্রাপ্তদের পদত্যাগের সুযোগ রহিত করার ফলে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনা সহজ হবে। এদিকে ব্যাংক কোম্পানি আইনে ১৯৯১-এর ৪৬ ধারায় আইন লঙ্ঘন, আমানতকারীর স্বার্থ বিঘ্নিত করা এবং জনস্বার্থে বিঘ্নিত করে এমন কাজে জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া যাবে।
গত মঙ্গলবার ইসলামী ব্যাংকের এমডি গণমাধ্যমকে জানান, বৃহস্পতিবার সশরীরে অফিস করব। কয়েকদিন ধরে অসুস্থতার কারণে তিনি বাসা থেকেই অফিসের কাজ করছেন বলেও জানান। গত রবি-সোমবারও তিনি অফিসের কাজ করেছেন। এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কেন্দ্রীয় একজন নির্বাহী পরিচালক আমার সংবাদকে বলেন, মানি লন্ডারিং ও অর্থপাচারের মামলায় দুদকের তদন্তে নাম এসেছে এমন একজন ব্যক্তি ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদে থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন। প্রশ্নবিদ্ধ একজন ব্যক্তিকে দিয়ে কীভাবে শরিয়াহভিত্তিক দেশের একটি বড় প্রতিষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্বে থাকতে পারেন এমন নৈতিকতার প্রশ্নও উঠছে।
চট্টগ্রামে দুদকের দায়ের করা মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ২০২১ সালের নভেম্বরে এস আলম সংশ্লিষ্ট মেসার্স মুরাদ এন্টারপ্রাইজের মালিক গোলাম সরওয়ার চৌধুরী চট্টগ্রামের ইসলামী ব্যাংকের চাক্তাই শাখায় ঋণের জন্য আবেদন করেন। আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে জালিয়াতির মাধ্যমে মুরাদ এন্টারপ্রাইজের নামে ইসলামী ব্যাংক থেকে এক হাজার ৯২ কোটি ৪৬ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করেন। পরের মাসে শাখার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা তা অনুমোদন করেন। মিথ্যা তথ্যের ওপর জাল কাগজে এ ঋণের জন্য আবেদন করে মুরাদ এন্টারপ্রাইজ। পরে এ ঋণ অনুমোদন করা হয়। কোনো প্রকার যাচাই না করেই পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী ব্যাংকের কর্মকর্তারা পরস্পর যোগসাজশে এ ঋণ অনুমোদন করেন। প্রথমে ৮৯০ কোটি টাকা ঋণের জন্য আবেদন করা হলেও পরে সেটা এক হাজার ১০০ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়।
মামলার আসামিরা হলেন- ইসলামী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান এস আলম, ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সিইও ও এমডি মনিরুল মওলা, ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আহসানুল আলম, সাবেক পরিচালক ও ইসি কমিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সেলিম উদ্দিন, সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান তানভীর আহমদ, সাবেক পরিচালক মো. ফসিউল আলম, কাজী শহীদুল আলম, মো. সিরাজুল করিম, জামাল মোস্তফা চৌধুরী, মো. জয়নাল আবেদীন, খুরশীদ উল আলম, সাবেক স্বতন্ত্র পরিচালক মোহাম্মদ সালেহ জহুর ও মোহাম্মদ সোলায়মান, পরিচালক মো. কামরুল হাসান ও সাবেক নমিনি পরিচালক সৈয়দ আবু আসাদ। সাবেক অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ কায়সার আলী ও কে কিউ এম হাবিবুল্লাহ, সাবেক ডিএমডি ও চিফ হিউম্যান রিসোর্স অফিসার মো. মোস্তাফিজুর রহমান সিদ্দিকী, মিফতাহ উদ্দিন, মোহাম্মদ আলী ও মোহাম্মদ সাব্বির, সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী মো. রেজাউল করিম, বর্তমান উপব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল ইসলাম, সাবেক এসইভিপি ও এএমডি মো. আলতাফ হোসেন, এসইভিপি জি এম মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন কাদের, আবু ছাঈদ মুহাম্মদ ইদ্রিস ও সাবেক এসইভিপি মোহাম্মদ উল্লাহ, বিনিয়োগ প্রশাসন বিভাগের প্রধান ও এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. ফরিদ উদ্দিন, ব্যাংকের কক্সবাজার শাখার ম্যানেজার আমান উল্লাহ, চট্টগ্রামের চাক্তাই শাখার সাবেক ম্যানেজার ও বর্তমানের এফএভিপি মোহাম্মদ আলী আজগর, চাক্তাই শাখার সাবেক বিনিয়োগ ইনচার্জ খাজা মোহাম্মদ খালেদ, চাক্তাই শাখার প্রধান ও অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. মনজুর হাসান, ইসলামী ব্যাংকের চট্টগ্রাম দক্ষিণ জোনের প্রধান মোহাম্মদ ইয়াকুব আলী ও দক্ষিণের অপর জোনপ্রধান ও এসইভিপি মিয়া মোহাম্মদ বরকত উল্লাহ।
ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানের মালিক হিসেবে আসামিরা হলেন- মেসার্স মুরাদ এন্টারপ্রাইজের মোহাম্মদ গোলাম সরওয়ার চৌধুরী, চৌধুরী অ্যান্ড হোসাইন ট্রেড লিংকের মোহাম্মদ এরশাদ হোসাইন চৌধুরী, বিসমিল্লাহ ট্রেডিং কর্পোরেশনের মোরশেদুল আলম, মেসার্স ইউনাইটেড সুপার ট্রেডার্সের মোহাম্মদ গোলাম কিবরিয়া চৌধুরী, রেইনবো কর্পোরেশনের রায়হান মাহমুদ চৌধুরী, আনছার এন্টারপ্রাইজের আনছারুল আলম চৌধুরী, সোনালী ট্রেডার্সের সহিদুল আলম, ফেমাস ট্রেডিং কর্পোরেশনের আরশাদুর রহমান চৌধুরী, গ্রিন এক্সপোজ ট্রেডার্সের এম এ মোনায়েম, কোস্টলাইন ট্রেডিং হাউসের এরশাদ উদ্দিন, জাস্ট রাইট ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের মো. গিয়াস উদ্দিন, এক্সক্লুসিভ বিজনেস হাউসের ফেরদৌস আহম্মদ বাপ্পি, এনেক্স বিজনেস কর্নারের আনোয়ারুল আজম, সেন্ট্রাল পার্ক ট্রেডিং হাউসের মোহাম্মদ মঞ্জুর আলম, জুপিটার ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের মোহাম্মদ মামুন, চৌধুরী বিজনেস হাউসের মোহাম্মদ রাসেল চৌধুরী, ডিলাক্সিয়াম ট্রেডিং কর্পোরেশনের কাজী মেজবাহ উদ্দিন, চেমন ইস্পাত লিমিটেডের পরিচালক মুহা. নজরুল ইসলাম, এমডি মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম, সেঞ্চুরি ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেডের এমডি মো. আরিফুল ইসলাম চৌধুরী, পরিচালক মোহাম্মদ হাসানুজ্জামান, গ্লোবাল ট্রেডিং কর্পোরেশনের এমডি মো. রাশেদুল আলম ও পরিচালক মোহাম্মদ আবদুস সবুর, স্যোসাল ট্রেড সেন্টারের আলী জহুর ও শাহ আমানত ট্রেডার্সের মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী চৌধুরী। মামলার তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, মুরাদ এন্টারপ্রাইজ যে বিনিয়োগের কথা বলে ঋণ নিয়েছিল, তা না করে এস আলম তার বিভিন্ন ব্যবসার ঋণ পরিশোধে এ টাকা ব্যবহার করেছেন। এর মাধ্যমে তারা মানি লন্ডারিং আইনে অপরাধ করেছেন।