খেলাপি ঋণ আদায়ে কচ্ছপ গতি

আনোয়ার হোসাইন সোহেল প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২৬, ২০২৪, ১১:৪২ পিএম
খেলাপি ঋণ আদায়ে কচ্ছপ গতি

ছয় মাসে মাত্র ৩ শতাংশ ঋণ আদায়

খেলাপি গ্রাহকের ক্যাটাগরি করা দরকার —আইনুল ইসলাম

চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ছয় মাসে শীর্ষ ২০ খেলাপি গ্রাহকের কাছ থেকে মাত্র ২৮ কোটি টাকা আদায় করতে পেরেছে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংক। যা  খেলাপি ঋণ স্থিতির মাত্র ৩ শতাংশ। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত অগ্রণী ব্যাংকে খেলাপি ঋণের স্থিতি ছিল আট হাজার ৮৯৯ কোটি টাকা। যার আগের বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ছিল আট হাজার ৯২৭ কোটি টাকা। 

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অগ্রণী ব্যাংক থেকে নজিরবিহীন অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি ও লুণ্ঠন হয়েছে। ঋণের নামে অনেক ব্যাংক থেকে আমানতকারীদের অর্থ লুটেছেন চেয়ারম্যান-পরিচালকরা। সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট ব্যবসায়ী তথা অলিগার্করাও ব্যাংক থেকে বাছবিচার ছাড়াই ঋণের নামে অর্থ হাতিয়েছেন। এক্ষেত্রে লুটেরাদের সহযোগী ছিল আওয়ামী লীগ সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কতিপয় কর্মকর্তা। ছাত্র-জনতার বিপ্লবের পর ব্যাংক খাত লুটের ক্ষতগুলো ফুটে উঠতে শুরু করেছে। এ কারণেই খেলাপি ঋণ এতটা নাজুক পরিস্থিতিতে ঠেকেছে। তবে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার প্রভাবে খেলাপি হয়েছেন কিছু ভালো গ্রাহকও।

চলতি বছরের শেষ ছয় মাসে অগ্রণী ব্যাংকের ঋণের স্থিতি রয়েছে- জাকিয়া গ্রুপের ঋণ এক হাজার ২১০ কোটি টাকা, জজ ভূঞা গ্রুপ এক হাজার ৯০ কোটি টাকা, তাকানা গ্রুপ ৯২৬ কোটি টাকা, সাত্তার গ্রুপ ৫৫০ কোটি টাকা, মুন গ্রুপ ৫২৪ কোটি টাকা, সোনালী গ্রুপ ৫২১ কোটি টাকা, এ্যারোস্টকেট গ্রুপ ৪৬২ কোটি টাকা, ঢাকা হাইড অ্যান্ড স্ক্রিন লিমিটেড ৪৫৭ কোটি টাকা, প্যাসিফিক গ্রুপ ৪৪৩ কোটি টাকা, সাদ মুসা ফেব্রিক্স লিমিটেড ৪১০ কোটি টাকা, শাহাবা ইয়ার্ম লিমিটেড ৩৭৪ কোটি টাকা, বেক্সিমকো কমিউনিকেশন ৩০৫ কোটি টাকা। তারা গত ছয় মাসে একটি টাকাও ঋণ পরিশোধ করেনি। এছাড়া নাভানা ফার্নিচার লিমিটেড ২৭২ কোটি টাকা, অ্যাডভান্স কমপোজিট মিলস লিমিটেড ৩১৭ কোটি টাকা, প্রাইম কম্পোজিট লিমিটেড ৩১১ কোটি টাকা, লিউ ফ্যাশন লিমিটেড ২২৯ কোটি টাকা, আর্থ এগ্রো ফার্মস লিমিটেড ২২৩ কোটি টাকা, জুলিয়া সুয়েটার কম্পোজিট লিমিটেড এবং এমআর সুয়েটার কম্পোজিট লিমিটেড ২১৯ কোটি টাকা, জয়নব ট্রেডিং কোং. লিমিটেড ১৮৪ কোটি টাকা, সামিটেক্স গ্রুপ ১৬৯ কোটি টাকা ঋণ বকেয়া রয়েছে।  খেলাপি ঋণ আদায়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ধীর গতি প্রসঙ্গে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আইনুল ইসলাম আমার সংবাদকে বলেন, ঋণখেলাপিদের একটা ক্যাটাগরি করা উচিত। 

এদের মধ্যে যাদের কাছ থেকে ঋণ আদায় করা সম্ভব এবং যাদের কাছ থেকে একেবারেই আদায় করা যাবে না এমন গ্রাহকের তালিকা করা যেতে পারে। ব্যাংক কর্মকর্তাদের মধ্যে যারা খেলাপি ঋণ ও বেনামি ঋণ বিতরণের সঙ্গে জড়িত তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। গ্রাহক ও ঋণ বিতরণকারী উভয়ের ওপর আইনের সঠিক প্রয়োগ হলে খেলাপি কমে আসবে। 

তিনি আরও বলেন, আইন শক্তভাবে প্রয়োগ করা হলে মানসম্মানের ভয়েই অনেকে খেলাপি ঋণ পরিশোধ করবে। তাছাড়া আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের ব্যাংকের ওপর আস্থা না থাকলে বিনিয়োগ বাড়বে না। ব্যাংকের খেলাপি ঋণ গ্রহণকারী রাঘববোয়ালদের ধরতে না পারলেও দেশের মধ্যে যেসব খেলাপি গ্রাহক আছে তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। 

অগ্রণী ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি ছিল ৭৫ হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা। এ ঋণের মধ্যে ২৬ হাজার ৮৯১ কোটি টাকাই ছিল খেলাপি, যা বিতরণকৃত ঋণের ৩৫ দশমিক ৫৩ শতাংশ। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটি পাঁচ হাজার ৬০৯ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ অবলোপনও করেছে। ওই সময় পর্যন্ত অগ্রণী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতির পরিমাণও ছিল চার হাজার ৬০৬ কোটি টাকার বেশি। আর নভেম্বরে এসে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩০ হাজার কোটি টাকা পৌঁছেছে। সে হিসাবে ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ৪০ শতাংশই এখন খেলাপি। আর নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন ও মূলধন ঘাটতির পরিমাণ আরো নাজুক। একসময় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটি থেকে অন্য ব্যাংকগুলো কোটি কোটি টাকা ধার নিত। কিন্তু ঋণের বোঝা নিয়ে ব্যাংকটি এখন এতটাই নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে যে তাদেরই এখন ধার করে চলতে হয়।