মাফিয়ামুক্ত সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক

আনোয়ার হোসাইন সোহেল প্রকাশিত: জানুয়ারি ১, ২০২৫, ০৬:২৮ পিএম
মাফিয়ামুক্ত সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক

ইসলামী ব্যাংক থেকে এস আলম একাই ঋণ নিয়েছেন প্রায় ৭৫ হাজার কোটি টাকার বেশি

বেক্সিমকো গ্রুপের ৭৮টি প্রতিষ্ঠানের দায়ের পরিমাণ প্রায় ৫০ হাজার  ৯৮ দশমিক ৩ কোটি টাকা

বিদায়ী বছরটি ছিল দেশের ব্যাংক খাতের জন্য ১৬ বছরের দুর্নীতি, অনিয়ম আর জঞ্জাল ঝেড়ে ফেলে হাফ ছেড়ে বাঁচার বছর। নতুন বাংলাদেশ বির্নিমাণের প্রত্যয়ে পরিবর্তন করা হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক, বিশেষায়িত ব্যাংক এবং বেসরকারি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও এমডি পদে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্ব হলো গ্রাহকের স্বার্থ রক্ষা করা। কিন্তু দেশি-বিদেশি ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর স্বার্থে দেশের একের পর এক ব্যাংক তুলে দেয় মাফিয়া ও লুটেরাদের হাতে। পতিত সরকার একের পর এক মেগা প্রজেক্টের নামে জনগণকে উন্নয়নের রূপালী জগৎ দেখিয়ে টাকা লুটপাটের হলিখেলায় মেতে উঠে। যার অন্যতম সহযোগী ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফজলে কবির ও পলাতক তালুকদার গংরা। সেই সঙ্গে দেশের আর্থিক খাতের মেরুদণ্ড ভেঙে দিতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান তুলে দেয়া হয় লুটেরাদের হাতে।

 এক্ষেত্রে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্তারা নীরব ভূমিকা পালন করেন। অনেক ক্ষেত্রে আইন পরিবর্তন করেও লুটেরাদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করেছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পলাতক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার ও বর্তমান ডেপুটি গভর্নর-১ নুরুন নাহার। যার ফলস্বরূপ, চট্টগ্রামভিত্তিক শিল্পগোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের হাতে দেয়া হয় দেশের শরিয়াহভিত্তিক ছয়টি ব্যাংকের মালিকানা। বিতর্কিত এই গ্রুপের হাতে থাকা ব্যাংকগুলোর মধ্যে ছিল দেশের বেসরকারি খাতের সবচেয়ে বড় ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক। ২০১৭ সালে এস আলম মালিকানা নেয়ার পর ইসলামী ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। একইভাবে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক। সরকার পতনের পর এই ব্যাংকগুলো থেকে লাগামহীনভাবে টাকা তুলে নেয়ার চিত্র উঠে আসে। 

তখন দেখা যায়, জুন থেকে সেপ্টেম্বর এই তিন মাসে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। এই সময়ে সরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৩ হাজার ৬২৮ কোটি টাকা। আর বেসরকারি ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির পরিমাণ ছিল ৪৯ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা। 

ব্যাংক কোম্পানি আইন ভেঙে এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম ও তার পরিবারের সদস্যরা নজিরবিহীনভাবে সাতটি ব্যাংক ও দুটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বড় অঙ্কের শেয়ার দখলে নেয়। আর এই অসাধ্য কাজটি সম্ভব হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কারণে। মূলত বিশেষ অনুমতি দিয়ে এই পরিবারকে সহায়তা করেছে ব্যাংকিং নিয়ন্ত্রক সংস্থা। এখানে প্রথম উদাহরণ হিসেবে ইসলামী ব্যাংকের কথা বলা যায়। বেসরকারি ব্যাংকটিতে তাদের ৩০ শতাংশ শেয়ার ছিল। অথচ আইন বলছে, একটি ব্যাংকে একটি পরিবারের শেয়ারের সীমা হবে ১০ শতাংশ। কিন্তু সেই আইন না মেনেই এই পরিবার ইসলামী ব্যাংকের বড় অঙ্কের শেয়ার দখল করে। এতে সাইফুল আলমের স্বজনরা ব্যাংকটি থেকে অনেক কম বিনিয়োগ করেও ২৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন বলে নথিতে দেখা গেছে। যদিও এই ঋণের প্রকৃত পরিমাণ নথির তথ্যের তিনগুণের বেশি। সাইফুল আলমের পরিবার বাংলাদেশের একমাত্র পরিবার, যে পরিবারের সব সদস্য ছাড়াও কিছু আত্মীয় একাধিক ব্যাংকের বোর্ডে বসে ছিলেন। মূলত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুনজরে এই পরিবারের জন্য নিয়ম শিথিল করা হয়। ফলে তারা বেশ চতুর কৌশলে ব্যাংকগুলোর শেয়ার দখল করে নেয়। সাধারণত একটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো একটি পরিবারকে এভাবে সুযোগ দিলে সেই দেশের ব্যাংকসহ পুরো আর্থিক খাত ঝুঁকিতে পড়ে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। 

এদিকে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যাংক খাত সংস্কারের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে গত সপ্তাহে ইসলামী ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দেয়। এর আগ পর্যন্ত সাইফুল আলমের পরিবারের সবাই বিভিন্ন ব্যাংকের পরিচালক ছিলেন। সাইফুল আলম ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ও তার স্ত্রী ফারজানা পারভীন একজন পরিচালক ছিলেন। তাদের ছেলে আহসানুল আলম, মেয়ে মাইমুনা খানম ও জামাতা বেলাল আহমেদ যথাক্রমে ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের বোর্ড নিয়ন্ত্রণ করতেন। সাইফুল আলমের ভাই-বোনসহ অন্যান্য আত্মীয়রাও বেশ কয়েকটি ব্যাংকের বোর্ডে ছিলেন। যদিও ব্যাংক আইন বলছে, একটি ব্যাংকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শেয়ারের মালিকানা থাকা কোনো ব্যক্তি অন্য ব্যাংকের উল্লেখযোগ্য শেয়ার কিনতে পারবেন না। একই নিয়ম ওই ব্যক্তির পরিবারের সদস্য ও কোম্পানির জন্য প্রযোজ্য হবে। 

অথচ ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংকের উল্লেখযোগ্য শেয়ারের মালিকানা থাকা সত্ত্বেও ২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক দখল করে নেন সাইফুল আলম। আইনে বলা হয়েছে, একটি পরিবারের তিনজনের বেশি সদস্য ব্যাংকের পরিচালক পদে থাকতে পারবেন না। এছাড়া একটি পরিবার ও তাদের প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে ১০ শতাংশের বেশি শেয়ারের মালিক হতে পারবে না। কিন্তু ইসলামী ব্যাংকের ৩০ শতাংশ শেয়ার ছাড়াও সাইফুল আলমের পরিবারের সদস্য ও প্রতিষ্ঠানগুলো সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ২২ শতাংশ, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ২৮ শতাংশ ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ৩০ শতাংশ শেয়ারের মালিক ছিল। এছাড়া আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক ও নর্দার্ন ইনস্যুরেন্সে পাঁচ শতাংশ করে এবং আভিভা ফাইন্যান্স ও ইউনিয়ন ব্যাংকে ৭০ শতাংশের বেশি শেয়ার রয়েছে তাদের। তবে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডিং তথ্য পাওয়া যায়নি। যদিও এস আলম গ্রুপের ওয়েবসাইটে ব্যাংকটির মালিকানা দাবি করা হয়েছে।

ইসলামী ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকটি এস আলমের স্বজনদের প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। অন্যদিকে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক তাদের আর্থিক প্রতিবেদনে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার ঋণ দেখিয়েছে। অন্যান্য ব্যাংকগুলোও এ দুই ব্যাংকের দেখানো পথেই পা ফেলেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এসব ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, এস আলমের আত্মীয়দের দেয়া ঋণ নথিতে উল্লেখ করা তথ্যের চেয়ে অনেক বেশি হবে। ইসলামী ব্যাংকের সাবেক একজন কর্মকর্তা বলেন, শুধুমাত্র ইসলামী ব্যাংক থেকেই ঋণের প্রকৃত পরিমাণ ৭৫ হাজার কোটি টাকার বেশি হতে পারে।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপ ১৬টি ব্যাংক ও সাতটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে বেক্সিমকো গ্রুপের ৭৮টি প্রতিষ্ঠানের দায়ের পরিমাণ ৫০ হাজার ৯৮ দশমিক ৩ কোটি টাকা। এসব প্রতিষ্ঠানের শ্রেণিকৃত ঋণ হচ্ছে ৩১ হাজার ৭৫ দশমিক ৬৭ কোটি টাকা। জনতা, আইএফআইসি, সোনালী ও রূপালীসহ অন্যান্য ব্যাংক আইন ও প্রচলিত ব্যাংকিং রীতিনীতি ভঙ্গ করে বেক্সিমকো গ্রুপের ৭৮টি প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক সুবিধা দিয়েছে। এর মধ্যে ঋণ, পুনঃতফসিলিকরণ, ঋণের মেয়াদ বাড়ানো, অতিরিক্ত ঋণদান, এলসি সুবিধাসহ অন্যান্য আর্থিক সুবিধা রয়েছে। জনতা ব্যাংক একক ঋণ গ্রাহক হিসেবে বেক্সিমকো গ্রুপকে তার প্রাপ্যের চেয়ে প্রায় ২০ গুণ বেশি আর্থিক সুবিধা দিয়েছে। উল্লেখ্য যে, বেক্সিমকো গ্রুপের কোম্পানিগুলোকে দেয়া ঋণের প্রায় ৫০ শতাংশ দিয়েছে জনতা ব্যাংক।

আলোচ্য বছরটিতে ফাঁস হয়েছে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুল ইসলাম জাভেদের পরিবারের জন্য আলাদিনের চেরাগ হয়ে উঠা বেসরকারি খাতের ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকে (ইউসিবি) অনিয়মের চিত্র। যা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রচার হওয়ার পর দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠে। তথ্য মতে, সাইফুজ্জামান চৌধুরী যুক্তরাজ্যে প্রায় ২০০ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের ৩৫০টিরও বেশি রিয়েল এস্টেট সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন। তিনবারের এই এমপির সম্পত্তির মধ্যে রয়েছে সেন্ট্রাল লন্ডনের বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট থেকে শুরু করে টাওয়ার হ্যামলেটসে আবাসন, যেখানে ইংল্যান্ডের বৃহত্তম বাংলাদেশি কমিউনিটির আবাসস্থল এবং লিভারপুলে শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসিক ভবন। বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) তথ্য অনুযায়ী সাইফুজ্জামান ও রুখমিলা যুক্তরাষ্ট্র ও দুবাইতেও বিপুল সম্পদ গড়ে তুলেছেন। 

ব্লুমবার্গের প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ডিসেম্বরে প্রাক-নির্বাচনি ঘোষণায় সাইফুজ্জামান তার মোট সম্পদের পরিমাণ ২৫৮ দশমিক তিন মিলিয়ন টাকা এবং তার স্ত্রী রুখমিলা জামানের মোট সম্পদের পরিমাণ ৯ লাখ ৯৩ হাজার ডলার। তিনি বাংলাদেশে সম্পদের ঘোষণাপত্রে তার যুক্তরাজ্যের সম্পদের পরিমাণ দেখাননি। মন্ত্রী হিসেবে ২০২২-২৩ সালে তার বেতন প্রায় ১০ হাজার পাউন্ড হিসাবে দেখানো হয়। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। তিন মাসেই ব্যাংক ব্যবস্থায় খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৩ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে যে পরিমাণ টাকা বের করে নেয়া হয়েছে, তা এখন খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হতে শুরু করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জুন শেষে খেলাপি ঋণ ছিল দুই লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। তখন দেশের ব্যাংকগুলো থেকে বিতরণ করা ঋণের ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ ছিল খেলাপি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে, তখন মোট খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা।