পলিসি তামাদি বিমা খাতের বিষফোঁড়া

মো. ইমরান খান প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৯, ২০২৫, ১১:৪৪ পিএম
পলিসি তামাদি বিমা খাতের বিষফোঁড়া

পলিসি হোল্ডারদের প্রতি কোম্পানিগুলোর আন্তরিকতার অভাব রয়েছে। এছাড়া গ্রাহকদের সাথে প্রতারণা ও সময়মতো ক্লেইম না দেয়ার কারণেও অনাস্থা দেখা যায়— ড. হাসিনা শেখ চেয়ারম্যান, ইন্স্যুরেন্স ও ব্যাংকিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

পলিসি তামাদি বিমা খাতের জন্য ক্যান্সারের মতো। গ্রাহকের বিমা দাবি পরিশোধ করে কোম্পানিগুলোকে আস্থাহীনতা দূর করতে হবে— ড. এস এম নুরুজ্জামান মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা, জেনিথ ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স

বিমা খাতের বিষফোঁড়ায় পরিণত হয়েছে পলিসি তামাদি। বিমা বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমান সময়ে পলিসি তামাদির অন্যতম কারণ হলো সময়মতো বিমা দাবি পরিশোধ না করা। যথাসময়ে ক্লেইম না পাওয়ার ফলে আস্থার সংকট বেড়েছে খাতটিতে। যার ফলে অনেকে না বুঝে বিমা পলিসি করলেও পরবর্তীতে তা আর পরিচালনা করেন না। কয়েক লাখ গ্রাহকের হাজার কোটি টাকারও বেশি বিমা দাবি অনিশ্চিত। গ্রাহক বিমা দাবি নিয়ে বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। 

এদিকে কোম্পানিগুলোতে সুশাসন ফেরাতেও ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। বিমা কর্মীরা অতিরিক্ত কমিশনের লোভে নিজের পকেট ভারী করার জন্য সাধারণ মানুষকে সঠিকভাবে না বুঝিয়ে পলিসি বিক্রি করেন। সঠিক ধারণা না থাকার কারণে পরবর্তীতে অনেক পলিসি হোল্ডার প্রিমিয়াম জমা দেন না, যার ফলে পলিসি তামাদি হয়ে যায়। 

বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) সর্বশেষ প্রতিবেদনের তথ্য মতে, গত ৯ মাসে পলিসি বন্ধ করেছেন তিন লাখ ৪৭ হাজার গ্রাহক। দেশের বিমা শিল্পে ব্যবসা পরিচালনা করা ৩৬টি জীবন বীমা কোম্পানির সর্বশেষ তথ্য এটি। নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে প্রাপ্ত সর্বশেষ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে জীবন বীমা কোম্পানিগুলোর পলিসি তামাদি হয়েছে তিন লাখ ৪৭ হাজার ৮৭৮টি। এ সময় সবচেয়ে বেশি পলিসি তামাদি হয়ে শীর্ষ স্থানে রয়েছে ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড। ৯ মাসে কোম্পানিটির ৫৬ হাজার ৩৩৮ জন গ্রাহক তাদের পলিসি বন্ধ করেছেন।

এছাড়া আলোচ্য ৯ মাসে ৫৬ হাজার ৯৯টি তামাদি পলিসি নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি, ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি পিএলসি। পলিসি তামাদিতে তৃতীয় স্থানে রয়েছে পপুলার লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড। এই কোম্পানিটির পলিসি বন্ধ হয়েছে ৩৩ হাজার ৩৭৮টি।

২৩ হাজার ২৩টি পলিসি বন্ধ নিয়ে তামাদিতে চতুর্থ অবস্থানে আছে প্রগতি লাইফ ইন্স্যুরেন্স পিএলসি। পঞ্চম স্থানে রয়েছে আলফা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স। এই কোম্পানির পলিসি বন্ধ হয়েছে ২১ হাজার ৯১৭টি।

বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ সংস্থার (আইডআরএ) পরিসংখ্যান মতে, ২০০৯ সালে বিমা পলিসি ছিল প্রায় এক কোটি ১২ লাখ। ২০২৩ সালে তা কমে হয়েছে ৮৫ লাখ ৮৮ হাজারে। আর গেল বছরের ৯ মাসেই কোম্পানিগুলো হারিয়েছে তিন লাখ ৪৭ হাজার গ্রাহক। সব মিলিয়ে আস্থা হারিয়ে ১৫ বছরে বিমা কোম্পানি ছেড়েছেন প্রায় ৩০ লাখ গ্রাহক।

তামাদি পলিসি কী 

বিমা ব্যবসার সঙ্গে তামাদি শব্দটি বহুল পরিচিত। তামাদি শব্দটি আরবি, এর আভিধানিক অর্থ কোনো কিছু বিলুপ্ত হওয়া কিংবা বাধাপ্রাপ্ত হওয়া। বিমার পলিসি হোল্ডার যদি সময়মতো প্রিমিয়াম জমা না দেয় তাহলে নির্দিষ্ট সময় পরে পলিসিটি তামাদি বা বন্ধ হয়ে যায়। আর পলিসি বন্ধ হলে গ্রাহক বিমা কাভারেজ থেকে বঞ্চিত হন। অনেক ক্ষেত্রে জমা দেয়া টাকাও পান না।

তামাদি পলিসির কারণ

বিমা বিশেষজ্ঞ ও বিমা সংশ্লিষ্টদের মতে, পলিসি তামাদি হয়ে যাওয়ার জন্য বেশ কিছু কারণ রয়েছে। তাদের মতে, জীবন বীমা কোম্পানির প্রতিনিধিরা (এফএ) পলিসি খোলার জন্য যতটা আগ্রহী ও মনোযোগী থাকেন, পরে আর সেই আগ্রহ আর মনোযোগ ধরে রাখতে পারেন না। কারণ পরবর্তীতে কমিশনের পরিমাণ কমে যায়। এ জন্য এজেন্টরা পরবর্তীতে পলিসি হোল্ডারদের সাথে যোগাযোগ কমিয়ে দেন। প্রিমিয়াম জমা দেয়ার ব্যাপারে পলিসি গ্রাহকদেরও সচেতনতার অভাব রয়েছে।

এছাড়া কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধেও রয়েছে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের অভিযোগ। সময়মতো বিমা দাবি পরিশোধ না করার ফলে অনেক গ্রাহক বিমার প্রতি আস্থা হারিয়েছেন। তাছাড়া অসাধু শ্রেণির বিমা প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে গ্রাহকের কাছ থেকে প্রিমিয়াম নিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে তা আত্মসাতের মতো ঘটনাও রয়েছে।

তামাদি পলিসির বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে জেনিথ ইসলামী লাইফের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা ও বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স ফোরামের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ড. এস এম নুরুজ্জামান আমার সংবাদকে বলেন, পলিসি তামাদি বিমা খাতের জন্য ক্যান্সারের মতো। সময়মতো কোম্পানিগুলোর ক্লেইম পরিশোধ না করার কারণে সাধারণ মানুষের বিমার প্রতি অনাস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে তামাদি পলিসির হার দিন দিন বাড়ছে। এর থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসেবে তিনি বলেন, যত দ্রুত সম্ভব গ্রাহকের বিমা দাবি পরিশোধ করে আস্থাহীনতা দূর করতে হবে এবং এর জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে বিভিন্ন সভা-সেমিনার করে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ইন্স্যুরেন্স ও ব্যাংকিং বিভাগের’ চেয়ারম্যান বিমা বিশেষজ্ঞ ড. হাসিনা শেখ দৈনিক আমার সংবাদকে বলেন, আমি মনে করি, পলিসি হোল্ডারদের প্রতি কোম্পানিগুলোর যথেষ্ট আন্তরিকতার অভাব রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে প্রথম প্রথম যতটা আন্তরিকতার সাথে বিমা প্রতিনিধিরা একজন গ্রাহককে পলিসি করান, পরবর্তীতে তার প্রতি আর আগ্রহ রাখেন না। এর ফলে গ্রাহকও হারিয়ে যায়। এছাড়া গ্রাহকদের সাথে প্রতারণা ও সময়মতো ক্লেইম না দেয়ার কারণেও বেশ অনাস্থা দেখা যায়। 

তামাদি পলিসির হার হ্রাস করার জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ ( আইডিআরএ) কি পদক্ষেপ নিয়েছে তা জানতে, কর্তৃপক্ষের মুখপাত্র মো. জাহাঙ্গির আলমকে বারবার ফোন দেয়া হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।