নেপথ্যে ডিজিদের নিষ্ক্রিয়তা

থমকে আছে বাংলাদেশ ব্যাংক সংস্কার

অর্থনৈতিক প্রতিবেদক প্রকাশিত: জানুয়ারি ২২, ২০২৫, ১২:০৫ এএম
থমকে আছে বাংলাদেশ ব্যাংক সংস্কার

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভেতরে শুরু হয়েছিল সংস্কারের উদ্যোগ। তবে ডেপুটি গভর্নরদের অসহযোগিতায় সেই উদ্যোগ ভেস্তে যেতে বসেছে। জানা গেছে, পতিত সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তা ও নতুন পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তাদের মধ্যে বড় ধরনের মতপার্থক্য নেই। তবে অজ্ঞাত কারণে বর্তমান গভর্নর ও অন্তর্বর্তী সরকারের নেয়া সংস্কারের উদ্যোগে তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছেন না ডেপুটি গভর্নর, নির্বাহী পরিচালকদের কেউ কেউ। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, আগে ও পরে রাজনৈতিক দলের আশীর্বাদ নিয়েছেন বা নিচ্ছেন এমন কর্মকর্তারা সংস্কারের পক্ষ নেয়া কর্মকর্তাদের নানাভাবে ভয়ভীতি দেখিয়ে আসছেন। ইতোমধ্যে সাবেক সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট কয়েকজন কর্মকর্তা সংস্কার কাজের গতি কমিয়ে দিয়েছেন। পাশাপাশি ভবিষ্যতে জেল-জরিমানা থেকে নিজেদের রক্ষায় সুবিধাজনক অবস্থায় থাকা রাজনৈতিক দলের ঋণখেলাপি ও দুর্নীতিবাজ শীর্ষ ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়েছেন ওইসব কর্মকর্তারা। তাতে সফলও হয়েছেন তারা। 

ডেপুটি গভর্নরের পদ টিকে যায়, সাবেক রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের সুপারিশে ডেপুটি গভর্নর হওয়া নুরুন নাহার বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ডেপুটি গভর্নর-১ ও দেশের ব্যাংক লুটপাটের অন্যতম কারিগর এস আলম পরিবারের অত্যন্ত আস্থাভজন হাবিবুর রহমান কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ডেপুটি গভর্নর-২ পদে দায়িত্ব পালন করছেন।  

এর আগে গত বছরের ১৪ আগস্ট সরকারের পরামর্শে বাংলাদেশ ব্যাংকের দুই ডেপুটি গভর্নর সাইদুর রহমান ও মো. খুরশীদ আলম, আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান মাসুদ বিশ্বাস পদত্যাগ করেন। এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উপদেষ্টা আবু ফারাহ মো. নাসের গভর্নর বরাবর পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। তবে ডেপুটি গভর্নর পদে নূরুন নাহার ও হাবিবুর রহমানকে বহাল রাখার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। চুনোপুঁটি মাসুদ বিশ্বাস গ্রেপ্তার হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন কাজী ছাইদুর রহমান, আবদুর রউফ তালুকদার, আবু ফারাহ মো. নাসেরসহ সাবেক শীর্ষ ব্যাংক কর্মকর্তারা। 

ড. মো. মহান উদ্দিন বলেছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুশাসনের একটি বড় উপাদান হলো স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা এবং প্রয়োজনীয় জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ। প্রথমটি, তথা বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি প্রায়ই আলোচনায় আসে। দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশ ব্যাংকের জন্য এ স্বায়ত্তশাসন বাস্তবায়নে আজ পর্যন্ত যা হয়েছে, তা দুই কদম এগিয়ে তিন কদম পেছানোর মতো। বাংলাদেশ ব্যাংক আদেশ ১৯৭২-এর ১০, ১৫, ৭৭ ও ৮২ ধারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা নির্ধারণ করে। এ আদেশ অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা গভর্নরের ওপর ন্যস্ত হলেও গভর্নরের নিয়োগ, পুনর্নিয়োগ, এমনকি অপসারণের ক্ষমতা সরকারের হাতেই। আবার বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ সদস্যদের নিয়োগ এবং পর্ষদ বাতিলের ক্ষমতাও সরকারের। সরকারের অনুমোদনেই এর কর্মীদের বাজেট, বেতন, ক্ষতিপূরণ, ইত্যাদি নির্ধারিত হয়।  আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেয়ার সীমাবদ্ধতা দূর করার জন্য এর কার্যপদ্ধতি উন্নয়নের সুপারিশ করে। 

২০২৩ সালের আগস্টের পরিদর্শনের ভিত্তিতে ২০২৪-এর জুনে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণে আইনি সীমাবদ্ধতা তুলে ধরে প্রয়োজনীয় আইনি সংশোধনের সুপারিশ করে। সেখানে ২০১৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের এ দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে না পারার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নরদের অসহযোগিতা থমকে আছে সেই উদ্যোগ। রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলেও  ব্যাংকিং সুশাসন ও নীতি বাস্তবায়নে করা কমিটিগুলো অকার্যর। যার পেছনে রয়েছে, সাবেক সরকারের সুবিধাভোগী ব্যাংক কর্মকর্তা ও বড় রাজনৈতিক দলের লেজুরভিত্তি করা ব্যবসায়ীরা।  

বর্তমান গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর দায়িত্ব নেয়ার পর পরই দ্রুততম সময়ে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে এস আলমের নিয়ন্ত্রণ থেকে উদ্ধার করেন। এছাড়াও সরকারি বেসরকারি কয়েকটি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে ব্যাপক পরিবর্তন আনেন। তবে এস আলমের দোষর ইসলামী ব্যাংকের এমডি মনিরুল মওলাসহ কয়েকটি ব্যাংকের এমডি রয়েছেন স্বপদে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকে গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, এস আলমসহ ব্যাংক লুটপাটকারীদের বিরুদ্ধে ব্যক্তি হিসেবে ব্যবস্থা নিবেন। তবে কোনো প্রতিষ্ঠান যেন বন্ধ না হয় সেদিকেও খেলায় রাখা হবে। এছাড়া ব্যাংকের টাকা আদায়ে প্রয়োজনে খেলাপিদের সম্পদ বিক্রি করে টাকা আদায় করা হবে। তারই অংশ হিসেবে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক উদ্যোগও নিয়েছে। কিন্তু সেটিও স্লো করে দেয় গভর্নরের ডেপুটিরা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ৩০ সেপ্টেম্বর দেশে খেলাপি ঋণ ছিল ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। তখন দেশের ব্যাংকগুলো থেকে বিতরণ করা ঋণের ১৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ ছিল খেলাপি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে, তখন মোট খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। এর পর থেকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েই চলছে। তৎকালীন সরকারের ছত্রচ্ছায়ায় ব্যাংক থেকে বিপুল অর্থ লুটপাট হয়েছে, যার একটা বড় অংশই পাচার হয়েছে বিদেশে এমনটা জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।