পাচারের অর্থ সন্ধানে বিদেশি নিরীক্ষক নিয়োগ

অর্থনৈতিক প্রতিবেদক প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৭, ২০২৫, ১২:০৬ এএম
পাচারের অর্থ সন্ধানে বিদেশি নিরীক্ষক নিয়োগ

শেখ হাসিনার আমলে বাংলাদেশের ব্যাংক খাত থেকে ১৭ বিলিয়ন বা এক হাজার ৭০০ কোটি ডলার পাচার হওয়ার ঘটনা তদন্ত করতে বিশ্বের বৃহৎ তিনটি নিরীক্ষা সংস্থাকে নিয়োগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। লোপাট হওয়া অর্থ দিয়ে কেনা সম্পদের হদিস ও পুনরুদ্ধারে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট মোট ১১টি যৌথ তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনতে চায় বাংলাদেশ। যারা ব্যাংক থেকে পাচারকৃত তহবিল দিয়ে কেনা সম্পদ খুঁজে বের করবে এবং দোষীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণে সাহায্য করবে। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আহসান মনসুর ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে দেয়া এক সাক্ষাতে এসব তথ্য জানিয়েছে। 

ফিন্যান্সিয়াল টাইমস প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক তিনটি ‘বিগ ফোর’ হিসাবরক্ষণ প্রতিষ্ঠান- ওয়াই, ডেলয়েট এবং কেপিএমজি নিয়োগ করেছে। এই সংস্থাগুলো ব্যাংক খাত থেকে ১৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পাচার হওয়ার ঘটনা তদন্ত করবে। এ বিষয়ে ইওয়াই এবং ডেলয়েটের মন্তব্য জানতে যোগাযোগ করেছিল পত্রিকাটি। তবে তারা নিয়মিত কাজের সময়ের বাইরে মন্তব্যের অনুরোধে সাড়া দেয়নি। কেপিএমজির ওয়েবসাইটের মাধ্যমে তাদের মন্তব্য নেয়ার চেষ্টা করলেও সফল হয়নি ফিন্যান্সিয়াল টাইমস।

ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর জানান, এই তদন্তে ১০টি শীর্ষস্থানীয় বাংলাদেশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার পরিবারের সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করা হবে। আহসান এইচ মনসুর এক সময় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে (আইএমএফ) অর্থনীতিবিদ হিসেবে কাজ করেছেন। গত বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে দেশের ভেঙে পড়া অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করার দায়িত্ব পেয়েছেন।

বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর আরও জানান, গত ১৫ বছরে হাসিনা ও তার আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংক থেকে প্রায় দুই ট্রিলিয়ন টাকা (১৬ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার) লোপাট করা হয়েছে বলে তার ধারণা। তিনি এই অর্থ উদ্ধার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্ব অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব পান আহসান এইচ মনসুর। তিনি আরও বলেন, দেশের ১০টি  বৃহৎ কোম্পানি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে তদন্ত করা হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সাবেক অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুরের হাতে এখন অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার ভার। শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে বাংলাদেশের ব্যাংক থেকে যে দুই লাখ কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে বলে অভিযোগ, সেই টাকা ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন তিনি।

এদিকে সুইজারল্যান্ডের দাভোসে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামে পাচার হওয়া হাজার হাজার কোটি টাকা ফিরিয়ে আনতে বিদেশি বন্ধুদের সমর্থন চেয়েছে বাংলাদেশ। সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস ফোরামের ফাঁকে বিভিন্ন নেতার সঙ্গে সাক্ষাতে এই সহযোগিতা কামনা করেন। প্রধান উপদেষ্টা জার্মানির ফেডারেল চ্যান্সেলারির প্রধান ও ফেডারেল মিনিস্টার ফর স্পেশাল টাস্কস ওল্ফগ্যাং স্মিড, বেলজিয়ামের রাজা কিং ফিলিপ, থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী পেতংতার্ন সিনাওয়াত্রা, সুইজারল্যান্ডের ফেডারেল ডিপার্টমেন্ট ফর ফরেন অ্যাফেয়ার্স ফেডারেল কাউন্সিলর ইগনাজিও ক্যাসিস, দুবাই কালচার অ্যান্ড আর্টস অথরিটির চেয়ারপারসন শেখ লতিফা বিনতে মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এছাড়া জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস, কঙ্গোর প্রেসিডেন্ট ফেলিক্স শিসেকেদি, জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সাবেক মার্কিন বিশেষ দূত জন কেরি এবং সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের সঙ্গে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামে দ্বিতীয় দিনে সাক্ষাৎ করেছেন।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১৬ বছরের দুর্নীতির শাসনামলে বাংলাদেশে কীভাবে দিবালোকে ডাকাতি হয়েছে, তা খতিয়ে দেখতে শীর্ষ বিশেষজ্ঞ, থিংক ট্যাংক, সাংবাদিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে বাংলাদেশে পাঠানোর জন্য বিশ্বনেতাদের প্রতি আহ্বান জানান প্রধান উপদেষ্টা। পাচারের টাকা উদ্ধারে সরকার একটি পুনরুদ্ধার কমিটি এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের নেতৃত্বে একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছে। চুরি হওয়া অর্থ উদ্ধারে সরকার প্রাথমিকভাবে শীর্ষ ২০ অর্থপাচারকারীকে টার্গেট করেছিল।

দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রচেষ্টার কথা তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ইউনূস জার্মান মন্ত্রীকে বলেন, ‘আমরা যখন নতুন বাংলাদেশের কথা বলি, তখন পরিচ্ছন্ন বাংলাদেশের কথাও বলি।’ প্রধান উপদেষ্টা এ বিষয়ে জার্মানির সরকারের সমর্থন কামনা করেন এবং জার্মান মন্ত্রীর সঙ্গে অর্থনৈতিক সহযোগিতার সম্ভাব্য ক্ষেত্র নিয়েও আলোচনা করেন। ড. ইউনূসের সফরে কঙ্গোর সংঘাতপ্রবণ এলাকায় ক্ষুদ্রঋণ প্রবর্তনকারী প্রিন্স ইমানুয়েল ডি মেরোড বলেন, ‘সংঘাতের পর ক্ষুদ্রঋণ সেখানে ২১ হাজার কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার পর কঙ্গোর বনাঞ্চলের আয়তন এখন ব্রিটেনের দ্বিগুণ।’ তিনি বলেন, ‘ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি এ অঞ্চলে শান্তি ফিরিয়ে আনতে বড় ভূমিকা পালন করেছে।’

প্রধান উপদেষ্টা থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী পেতংতার্ন সিনাওয়াত্রার সঙ্গে রোহিঙ্গা সংকট এবং জাহাজ চলাচলসহ অর্থনৈতিক সহযোগিতার বিভিন্ন ক্ষেত্র নিয়েও আলোচনা করেন।