পরিবার পরিকল্পনার কাজে গতি কম

জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারে অনীহা

নিজস্ব প্রতিবেদক প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৮, ২০২৫, ১১:৫৬ পিএম
জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারে অনীহা

দেশে পরিবার পরিকল্পনা ও জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের হার কমে যাচ্ছে। বিভিন্ন সূত্রের তথ্য অনুসারে, পরিবার পরিকল্পনা উদ্যোগগুলো যথেষ্ট পরিমাণে সফল হচ্ছে না। পৃথিবীর সর্বাধিক জনবহুল দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ, যেখানে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ব্যবহার অনেকাংশেই কমে গেছে। 

সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশে পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতির ব্যবহার বর্তমানে প্রায় ৪৫ শতাংশ। এটি প্রায় পাঁচ বছর আগের তুলনায় ১০ শতাংশ কম। এসবের প্রধান কারণ হিসেবে রয়েছে, কম শিক্ষিত এবং গ্রামীণ অঞ্চলের মানুষরা আধুনিক জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সম্পর্কে অবগত নয়। 

দ্বিতীয়ত, স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের অভাব এবং পর্যাপ্ত সরঞ্জামের কমতি। তৃতীয়ত, সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কার জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ব্যবহার বাধাগ্রস্ত করে। 

পরিবার পরিকল্পনা দপ্তর সূত্রে জানা যায়, এক বছর ধরে জন্মনিয়ন্ত্রণের অস্থায়ী উপকরণ সামগ্রীর সরবরাহ আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে এসব উপকরণের মজুত খুব সীমিত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। বিশেষ করে দীর্ঘমেয়াদি পদ্ধতি ইনজেকশন ও চলমান পদ্ধতির উপকরণ কনডম ও মুখে খাবার বড়ি এবং কিটের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। এই সুযোগে বাজারে বেসরকারি কোম্পানির বিভিন্ন উপকরণের দাম বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। ফলে নিম্নবিত্ত দম্পতিদের মধ্যে পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণে অনীহা সৃষ্টি হয়েছে। 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এসভিআরএস প্রকাশিত সর্বশেষ এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, বর্তমানে জনসংখ্যা বৃদ্ধির বার্ষিক হার ১ দশমিক ৩৩ শতাংশ। বিবিএসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ব্যবহার কমে দাঁড়িয়েছে ৬১ দশমিক ১ শতাংশে যা ২০২২ সালে ছিল ৬৩ দশমিক ৩ শতাংশ। এছাড়া ২০২১ সালে ছিল ৬৫ দশমিক ৬ শতাংশ। অবশ্য এর আগে ২০২০ সালে ৬৩ দশমিক ৯ এবং ২০১৯ সালে এ হার ছিল ৬৩ দশমিক ৪ শতাংশ। 

প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২৩ সালে গ্রামে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ব্যবহার ছিল ৬১ দশমিক ৬ শতাংশ যা ২০২২ সালে ছিল ৬২ দশমিক ৯ শতাংশ। এছাড়া ২০২১ সালে ছিল ৬৫ দশমিক ৭ শতাংশ। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালে শহরে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ব্যবহার ছিল ৬৩ দশমিক ৯ শতাংশ যা ২০২২ সালে ছিল ৬৪ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০২১ সালে ছিল ৬৫ শতাংশ। 

এদিকে, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের সূত্রে জানা যায়, জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি এবং উপকরণ বিতরণের জন্য দেশের প্রতিটি ইউনিয়ন ও পৌর এলাকায় একজন পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শক ও তিনজন পরিবারকল্যাণ সহকারী দায়িত্ব পালন করেন। এই কর্মীদের সপ্তাহে চার দিন বাড়ি বাড়ি গিয়ে দম্পতিদের সঙ্গে আলোচনা ও সামগ্রী বিতরণ করার কথা। উপকরণ ঘাটতির কারণে পরিবার পরিকল্পনা কর্মীদের অনেকেই নিয়মিত বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন না। আবার যারা যাচ্ছেন তারাও দম্পতিদের বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ কিংবা ঘাটতি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত বাজার থেকে উপকরণ সংগ্রহের পরামর্শ দিচ্ছেন। 

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের সাবেক এক কর্মকর্তা জানান, শীর্ষ কর্মকর্তাদের উদাসীনতা, কেনাকাটায় স্বেচ্ছাচারিতা এবং পরিকল্পনার অভাবে এই ঘাটতির সৃষ্টি হয়েছে। ঘাটতি এতই বেশি যে, গত ১৫ বছরে অধিদপ্তর এমন সংকটে পড়েনি। এর প্রভাবে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারকারী দম্পতির মধ্যে অনীহা সৃষ্টি হয়েছে। দ্রুত এই উপকরণের সরবরাহ স্বাভাবিক না হলে ব্যবহারকারীর সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পাবে। এতে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হতে পারে। 

তিনি আরও জানান, দেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরকে বড় নিয়ামক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পাঁচ দশক আগে একজন মা গড়ে ৬ থেকে ৭ জন সন্তান জন্ম দিতেন। সেই সংখ্যা কমিয়ে আনার নেপথ্যের কারিগর অধিদপ্তরের কর্মীরা। তাদের প্রচেষ্টায় পাঁচ দশকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। তবে দীর্ঘদিনে অর্জিত সেই সাফল্য এখন হুমকির মুখে। চাহিদা অনুযায়ী উপকরণ না থাকায় পরিবার পরিকল্পনার সরকারি সেবা কার্যক্রম প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে। বেশ কিছুদিন ধরেই সারা দেশে কনডম, মুখে খাওয়া বড়ি ও কিটের মারাত্মক সংকট চলছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের জনবল সংকট। প্রতিষ্ঠানটির মোট পদের প্রায় চার ভাগের এক ভাগই বর্তমানে শূন্য হয়ে আছে। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একসময় ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা থাকায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমেছিল। এখন জন্মনিয়ন্ত্রণ নিয়ে সরকারের প্রচার কার্যক্রম সেভাবে চোখে পড়ছে না। ফলে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারকারীর সংখ্যা দিন দিন কমছে। জাতীয় পর্যায়ে গ্রাম এবং শহর সর্বত্রই দেশবাসীর মধ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারে দেখা দিয়েছে অনীহা। ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারও বাড়ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকার ও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে জনগণকে সচেতন করতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিচ্ছে। 

তবে, কার্যকরী ফলাফল পেতে হলে এই উদ্যোগগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন এবং সমর্থন প্রয়োজন। সরকারকে পরিবার পরিকল্পনা উদ্যোগগুলো আরও জোরদার করতে হবে এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।