কালোবাজারে বিনামূল্যের পাঠ্যবই

নিজস্ব প্রতিবেদক প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৪, ২০২৫, ১১:৪৯ পিএম
কালোবাজারে বিনামূল্যের পাঠ্যবই

শিক্ষার্থীরা এখনো বিনামূল্যের পাঠ্যবই হাতে না মিললেও মোটা দামে তা কালোবাজারে পাওয়া যাচ্ছে। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির একসেট বই পাঁচ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর নবম শ্রেণির বই সেটপ্রতি (গ্রুপভেদে দু-একটি বই কম থাকছে) ছয় থেকে সাড়ে ছয় হাজার টাকা। 

রাজধানীর নীলক্ষেত, বাংলাবাজারসহ দেশের অনেক স্থানে বিনামূল্যের পাঠ্যবই বিক্রি হচ্ছে। যদিও বিনামূল্যের বই কেনাবেচার সুযোগ নেই। তবে সন্দেহ করা হচ্ছে, ছোট বা মাঝারি লাইব্রেরি থেকে চাহিদা অনুযায়ী কাজ নেয়া বিভিন্ন প্রেস অবৈধভাবে ওসব বই ছাপাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে জেলা এবং উপজেলা শিক্ষা অফিসগুলোও বই বিক্রিতে জড়িয়ে পড়ছে। কারণ দেশের অনেক জেলা ও উপজেলা শিক্ষা অফিস থেকে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি বই চাওয়া হয়েছে। সেখান থেকেই কালোবাজারে চলে যাচ্ছে বই। তা ছাড়া অনেক স্কুলও বেশি বইয়ের চাহিদা দিয়েছে। সেসব স্কুল কর্তৃপক্ষ সরকার থেকে বই পেয়ে তা কালোবাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে। কিছু মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান সরকারের কার্যাদেশের বেশি বই ছাপিয়ে বিক্রি করছে। পাশাপাশি বাংলাবাজার, সূত্রাপুর, আরামবাগ ও নয়াপল্টনের মুদ্রণ, ছাপা ও বাঁধাই প্রতিষ্ঠানগুলো থেকেও বই কালোবাজারে যাচ্ছে। বই বিক্রেতা এবং জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। 

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, কালোবাজারে বিনামূল্যের পাঠ্যবই বিক্রেতাদের ধরতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় অভিযান চালানো হচ্ছে। কয়েক দিন আগে রাজধানীর বাংলাবাজারে বিপুলসংখ্যক বিনামূল্যের বই জব্দ করে। তারপর থেকেই বিক্রেতারা সতর্ক হয়ে পড়েছে। তারা দোকান থেকে বই সরিয়ে বিভিন্ন গোপন স্থানে রেখেছে। আর বিক্রিও থামেনি। মূলত স্কুলগুলোতে ক্লাস শুরু হয়ে যাওয়ায় এবং পাঠ্যবই মুদ্রণ ও বিতরণে এ বছর কিছুটা দেরি হওয়ায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। কারণ গ্রামাঞ্চলের বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর অনলাইন ভার্সন থেকে বই ডাউনলোড করার সুযোগ নেই। আর সেজন্যই চলতি শিক্ষাবর্ষের বিনামূল্যের পাঠ্যবই ‘মূল্য’ দিলে কালোবাজারে কেনা যায়।

সূত্র জানায়, সারা দেশে এখনো বিপুলসংখ্যক স্কুলে সব বই পৌঁছেনি। যে কারণে অভিভাবকরা মার্কেটে বই খুঁজছে। সেজন্য ঢাকার বাইরে থেকেও অভিভাবকরা আসছেন। বিশেষ করে প্রাথমিকের বই, মাধ্যমিকের ইংরেজি ভার্সনের বই এবং নবম শ্রেণির বই বেশি বিক্রি হচ্ছে। তবে গোয়েন্দাদের ভয়ে গোপনীয়তা অবলম্বন করে বই বিক্রি করা হচ্ছে। ধরা পড়লে পুলিশি ঝামেলা হয়। বাংলাবাজার, পল্টন ও মতিঝিলের বিভিন্ন প্রেসে ওসব অবৈধ বই ছাপা হচ্ছে। আর মাধ্যমিকের বই ডিসেম্বর থেকেই কালোবাজারে বিক্রি হচ্ছে। 

কালোবাজারে পাঠ্যবই বিক্রিতে ঝুঁকি থাকলেও লাভ বেশি। কোনো কোনো কালোবাজারি ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনার মতো বড় শহরেও ওসব বই নিয়ে যাচ্ছে। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে বইয়ের দোকানে অবাধে বিক্রি হচ্ছে বিনামূল্যের পাঠ্যবই।

সূত্র আরও জানায়, বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপাখানা থেকে সরাসরি ট্রাকে করে জেলা পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়ার কথা। কিন্তু ট্রাকে করে নিয়ে যাওয়া বইগুলোর একটা অংশ জেলায় বইয়ের গুদামে পৌঁছার আগেই অন্য জায়গায় চলে যায়। সম্প্রতি বগুড়া থেকে এ ধরনের একটি ট্রাক আটক করা হয়। বিনামূল্যের পাঠ্যবই কালোবাজারে চলে যাচ্ছে এমন তথ্যের ভিত্তিতে সম্প্রতি অভিযান চালায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের বই খোলাবাজারে বিক্রি ও মজুতকারী চক্রের দুই সদস্যকে আটক করেছে ডিবি। তাদের কাছে রক্ষিত দুই ট্রাক বই জব্দও করা হয়েছে। 

এর আগে রাজধানীর বাংলাবাজারে অভিযান চালান ভ্রাম্যমাণ আদালত। সেখানে পাঁচ হাজার বই জব্দ করা হয়। অতিসম্প্রতি গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বগুড়ার শেরপুর উপজেলার ধাতিয়াপাড়া এলাকা থেকে বিনামূল্যে বিতরণের প্রায় ১০ হাজার বই জব্দ করে পুলিশ। এর মধ্যে অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণির ৯ হাজার বই ছিল। কুড়িগ্রামের রৌমারী থেকে একটি ট্রাকে করে ঢাকায় পাচারকালে বই জব্দ করেছে শেরপুর সদর থানা পুলিশ। ওই সময় একজনকে আটক করা হয়। কুড়িগ্রামের রৌমারী সি জি জামান উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বইগুলো ট্রাকে করে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল।

 এর আগে ২০ জানুয়ারি রাজধানীর বাংলাবাজারে অভিযান চালিয়ে পাঁচ হাজার বই জব্দ করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। অভিযানে দুটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হয়। ওইদিন অভিযানে বাংলাবাজার বই মার্কেটের দুটি দোকান ও একটি গোডাউনে সরকারি বই পাওয়া যায়।

এদিকে ঢাকার সাভার উপজেলা, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ ও পার্বত্য তিন জেলার বিভিন্ন উপজেলার শিক্ষা কর্মকর্তারা অতিরিক্ত চাহিদা এনসিটিবিতে জানিয়ে বই নেন। তারা অতিরিক্ত বই কালোবাজারে সরবরাহ করে। ওসব বইয়ের চাহিদা মূলত কিন্ডারগার্টেনগুলোতে থাকে। কারণ সরকারের বিনামূল্যের বই কিন্ডারগার্টেনগুলো সহজে পায় না। সরকারি-বেসরকারি স্কুলে দেয়ার পর তাদের বই দেয়া হয়। কিন্তু বছরের শুরুতেই বই না পাওয়ায় তাদের শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় ব্যাঘাত ঘটছে। সেজন্য স্কুল কর্তৃপক্ষ ও অভিভাবকরা বিনামূল্যের পাঠ্যবই খোলাবাজার থেকে কিনতে চায়। 

এদিকে কালোবাজারে বিনামূল্যের পাঠ্যবই বিক্রি প্রসঙ্গে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান জানান, খোলাবাজারে বই বিক্রি করা আইনত দণ্ডনীয়। যারা এসব করছে তাদের চিহ্নিত করতে কাজ করছে এনসিটিবি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ওসব বই কীভাবে খোলাবাজারে যাচ্ছে তা তদন্ত করা হচ্ছে। একশ্রেণির প্রিন্টার্স প্রতিষ্ঠান ও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মিলে বই বাজারে বিক্রি করছেন। তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পেলে নিশ্চিত হওয়া যাবে কোথা থেকে বিনামূল্যের বই কালোবাজারে গেলো।