জনপ্রশাসন ও বিচার বিভাগ ঢেলে সাজানোর সুপারিশ

নিজস্ব প্রতিবেদক প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৬, ২০২৫, ১২:১৩ এএম
জনপ্রশাসন ও বিচার বিভাগ ঢেলে সাজানোর সুপারিশ
  • সিভিল সার্ভিস পুনর্গঠন করার পরামর্শ

  • কমাতে হবে সাজাপ্রাপ্তকে ক্ষমায় রাষ্ট্রপতির একক ক্ষমতা

  • প্রশাসনে শূন্য পদ ছাড়া পদোন্নতি নয়

  • ১৫ বছর চাকরি করলে পেনশনসহ অবসর দেওয়ার প্রস্তাব

  • ‘রাজধানী মহানগর সরকার’ গঠনের সুপারিশ

জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন ও বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন সুপারিশমালা জমা দিয়েছে। গতকাল প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন আকারে এসব সুপারিশমালা জমা দেন কমিশনের দায়িত্বপ্রাপ্তরা। সুপারিশে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) পুনর্গঠনের প্রস্তাব করেছে। অন্যদিকে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন আদালতের রায়ে চূড়ান্তভাবে অপরাধীকে রাষ্ট্রপতি বা নির্বাহী বিভাগের ক্ষমা প্রদর্শনের একচ্ছত্র ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের সুপারিশ করেছে। 

গতকাল প্রধান উপদেষ্টার কাছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন জমা দেন কমিশন প্রধান আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী। আর প্রধান উপদেষ্টার কাছে বিচার বিভাগ সংস্কারের প্রতিবেদন জমা দেন কমিশনের প্রধান আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমানের নেতৃত্বাধীন অন্য সদস্যরা।  

সিভিল সার্ভিস পুনর্গঠনের সুপারিশ

বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) পুনর্গঠনের প্রস্তাব করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। এ ছাড়া সরকারি চাকরিতে নিয়োগের জন্য তিনটি পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি) গঠনের সুপারিশ করেছে তারা। গতকাল প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন জমা দেন জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী। এরপর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং প্রতিবেদনের নির্বাহী সারসংক্ষেপ প্রকাশ করেছে। 

সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) আওতায় একীভূত ‘ক্যাডার’ সার্ভিস বাতিল করে তার পরিবর্তে সংশ্লিষ্ট সার্ভিসের কাজের ধরন ও বিশেষায়িত দক্ষতার বিষয়টি সামনে রেখে আলাদা আলাদা নামকরণ করা যেতে পারে। বিদ্যমান বিসিএসের বিভিন্ন ক্যাডারগুলোকে ১২টি প্রধান সার্ভিসে বিভক্ত করার সুপারিশ করা হলো।

এগুলো হলো- বাংলাদেশ প্রশাসনিক সার্ভিস, বাংলাদেশ বিচারিক সার্ভিস, বাংলাদেশ জননিরাপত্তা সার্ভিস, বাংলাদেশ পররাষ্ট্র সার্ভিস, বাংলাদেশ হিসাব সার্ভিস, বাংলাদেশ নিরীক্ষা সার্ভিস, বাংলাদেশ রাজস্ব সার্ভিস, বাংলাদেশ প্রকৌশল সার্ভিস, বাংলাদেশ শিক্ষা সার্ভিস, বাংলাদেশ স্বাস্থ্য সার্ভিস, বাংলাদেশ কৃষি সার্ভিস, বাংলাদেশ তথ্য সার্ভিস এবং বাংলাদেশ তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি সার্ভিস।

প্রতিবেদন বলা হয়েছে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে দুটি পাবলিক সার্ভিস কমিশন গঠন করা হয়েছিল। একটি ক্যাডার সার্ভিসের জন্য এবং অপরটি নন-ক্যাডার সার্ভিসের জন্য। পরবর্তীতে দুটিকে একীভূত করা হয়। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রজাতন্ত্রের কর্মে জনবল নিয়োগের জন্য এখন তিনটি পাবলিক সার্ভিস কমিশন গঠন করার সুপারিশ করা হলো। প্রতিটি কমিশনের সদস্য সংখ্যা হবে চেয়ারম্যানসহ ৮ জন।

কমিশনগুলো হবে- ১. পাবলিক সার্ভিস কমিশন (সাধারণ) : শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সার্ভিস ব্যতীত অন্য সকল সার্ভিসে নিয়োগ ও পদোন্নতি পরীক্ষা। ২. পাবলিক সার্ভিস কমিশন (শিক্ষা) : শুধু শিক্ষা সার্ভিসে নিয়োগ ও পদোন্নতি পরীক্ষা। ৩. পাবলিক সার্ভিস কমিশন (স্বাস্থ্য) : শুধু স্বাস্থ্য সার্ভিসে নিয়োগ ও পদোন্নতি পরীক্ষা। প্রতিবেদন বলা হয়েছে, শিক্ষা সার্ভিস ও স্বাস্থ্য সার্ভিসের কর্মকর্তারা অন্যান্য সার্ভিসের সাথে সুপিরিয়র এক্সিকিউটিভ সার্ভিসে অন্তর্ভুক্তির পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে।

সাজাপ্রাপ্তকে ক্ষমা, রাষ্ট্রপতির একক ক্ষমতা কমানোর সুপারিশ

আদালতের রায়ে চূড়ান্তভাবে দণ্ডিত অপরাধীকে রাষ্ট্রপতি বা নির্বাহী বিভাগের ক্ষমা প্রদর্শনের একচ্ছত্র ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের সুপারিশ করেছে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন। এ লক্ষ্যে একটি বোর্ড প্রতিষ্ঠা ও সেই বোর্ডের সুপারিশের ভিত্তিতে ক্ষমা প্রদর্শনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। গতকাল কমিশনের প্রধান আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমানের নেতৃত্বে বিচার বিভাগ সংস্কারের প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টাকে হস্তান্তর করা হয়। সংস্কার প্রতিবেদনে এ সুপারিশ করা হয়েছে।

কমিশনের অন্য সদস্যরা হলেন- হাইকোর্ট বিভাগের সাবেক বিচারপতি এমদাদুল হক, ফরিদ আহমেদ শিবলী, সাবেক জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ আমিনুল ইসলাম, মাসদার হোসেন, সিনিয়র অ্যাডভোকেট তানিম হোসেইন শাওন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মাহফুজুল হক সুপন ও শিক্ষার্থী প্রতিনিধি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী আরমান হোসাইন। বিচার বিভাগকে স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও কার্যকর করতে প্রয়োজনীয় সংস্কার প্রস্তাব করার লক্ষ্যে গত ৩ অক্টোবর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার অনুমোদনক্রমে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়।

প্রতিবেদনে ‘রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শন’ সংক্রান্ত ৬ নম্বর সুপারিশের সার সংক্ষেপে বলা হয়, ‘আদালত কর্তৃক চূড়ান্তভাবে দণ্ডিত অপরাধীকে রাষ্ট্রপতি বা নির্বাহী বিভাগ কর্তৃক ক্ষমা প্রদর্শনের একচ্ছত্র ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে বোর্ড প্রতিষ্ঠা, যার সুপারিশের ভিত্তিতে ক্ষমা প্রদর্শনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে।’ রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শনের অধিকার সংক্রান্ত সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘কোনো আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত যে কোনো দণ্ডের মার্জনা, বিলম্বন ও বিরাম মঞ্জুর করার এবং যে কোনো দণ্ড মওকুফ, স্থগিত বা হ্রাস করার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির থাকবে।’

আইনে নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা

দণ্ড স্থগিত বা মওকুফ করার ক্ষমতা সংক্রান্ত ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারায় বলা হয়েছে, এক. কোনো ব্যক্তি কোনো অপরাধের জন্য দণ্ডিত হলে সরকার যে কোনো সময় বিনা শর্তে বা শর্তে তার দণ্ডের কার্যকারিতা স্থগিত, অংশবিশেষ বা পুরোপুরি মওকুফ করতে পারবে। দুই. কোনো দণ্ড স্থগিত বা মওকুফ করতে সরকারের কাছে আবেদন করা হলে সরকার দণ্ড প্রদানকারী বিচারকের মতামত নিতে পারে এবং বিচারের সব নথি পাঠানোর নির্দেশ দিতে পারে। তিন. যেসব শর্তে দণ্ড স্থগিত বা মওকুফ করা হয়েছে, কোনোটি পালন করা হয়নি মনে করলে সরকার সাজা স্থগিত বা বাতিলের আদেশ বাতিল করতে পারবে। সেক্ষেত্রে পুলিশ তাকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করতে পারবে এবং বাকি দণ্ড ভোগ করার জন্য তাকে কারাগারে পাঠানো যাবে। চার. দণ্ড স্থগিত বা মওকুফ করার শর্ত এমন হবে যা পূরণে সে স্বাধীন থাকবে। কোনো ফৌজদারি আদালত কোনো আদেশ দিলে তা যদি সেই ব্যক্তির স্বাধীনতা খর্ব করতে পারে বা তার বা সম্পত্তির ওপর দায় আরোপ করে তাহলে এই ধারার বিধান এই আদেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। পাঁচ. রাষ্ট্রপতির অনুকম্পা প্রদর্শনে এই ধারার কোনো কিছু হস্তক্ষেপ করবে বলে মনে করা যাবে না। ছয়. সরকার সাধারণ বিধিমালা বা বিশেষ আদেশ দিয়ে দণ্ড স্থগিত রাখা এবং দরখাস্ত দাখিল ও বিবেচনার শর্তাবলির বিষয়ে নির্দেশ দিতে পারবে।

প্রশাসনে শূন্য পদ ছাড়া পদোন্নতি বন্ধের সুপারিশ

সরকারি কর্মকর্তাদের পদোন্নতিতে বিভিন্ন সময় জটিলতার সৃষ্টি হওয়ায় শূন্য পদের বাইরে পদোন্নতি বন্ধের সুপারিশ করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। কমিশনের প্রতিবেদনের নির্বাহী সারসংক্ষেপ থেকে এ তথ্য জানা গেছে। গতকাল প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন জমা দেন জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী। এরপর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং প্রতিবেদনটির নির্বাহী সারসংক্ষেপ প্রকাশ করে। শূন্য পদ ছাড়া পদোন্নতি না দেওয়ার বিষয়ে প্রতিবেদন বলা হয়েছে, বিভিন্ন সময়ে লক্ষ্য করা গেছে যে, শূন্য পদের চেয়ে অধিক সংখ্যক পদে পদোন্নতি দিয়ে জটিলতার সৃষ্টি করা হয়। এরূপ প্রবণতা অবিলম্বে বন্ধ হওয়া দরকার। কেবল শূন্য পদের বিপরীতে সমসংখ্যক পদে পদোন্নতি দেওয়ার বিধান করার জন্য সুপারিশ করা হলো।

১৫ বছর চাকরি করলে পেনশনসহ অবসর দেওয়ার প্রস্তাব

সব ক্যাডারের লাইন প্রমোশন নিশ্চিত করতে বিভিন্ন সার্ভিসের মধ্যে যে বৈষম্যের অভিযোগ রয়েছে বিশেষ করে যেসব সার্ভিসে ১ থেকে ৪ গ্রেড পর্যন্ত পদ নেই তা সমাধানের জন্য প্রত্যেক সার্ভিসে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে গ্রেড-১ থেকে গ্রেড-৪ এর প্রয়োজনীয় সংখ্যক পদ সৃষ্টি করা যেতে পারে বলে জানিয়েছে কমিশন।

একইভাবে নির্দিষ্ট সার্ভিসের কর্মপরিধির চাহিদার সমানুপাতিক হারে পদোন্নতির জন্য বিভিন্ন গ্রেডের পদ সৃষ্টি করার জন্য সুপারিশ করা হলো। সংশ্লিষ্ট সার্ভিসের পঞ্চম ও তৃতীয় গ্রেডের সমমানের পদে পদোন্নতির জন্য পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে পরীক্ষা বা মূল্যায়ন করার ব্যবস্থা থাকতে হবে বলে সুপারিশ করেছে কমিশন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মাঠ প্রশাসন ব্রিটিশ ভারত ও পাকিস্তান আমলের বিভিন্ন ঐতিহ্য ও বিধিবিধান অনুসরণ করে পরিচালিত হয়। কিন্তু ভারত ও পাকিস্তানে মাঠ প্রশাসনের জন্য আলাদা আইন থাকলেও বাংলাদেশে তা নেই। এ কারণে মাঠ প্রশাসনে অনেক সময় বিভিন্ন সরকারি বিভাগের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব দেখা দেয়। এ সমস্যা দূরীকরণের জন্য মাঠ প্রশাসনের জন্য আলাদা আইন প্রণয়ন করার জন্য সুপারিশ করা হলো।

‘রাজধানী মহানগর সরকার’ গঠনের সুপারিশ

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি আবুল কালাম আজাদ মজুমদার বলেছেন, বৃহত্তর ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জকে নিয়ে ‘ক্যাপিটাল সিটি গভর্নমেন্ট’ করার সুপারিশ করেছে জনপ্রশাসন সরকার সংস্কার কমিশন। গতকাল রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনার বাইরে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে আয়োজিত প্রেস ব্রিফিংয়ে একথা বলেন তিনি। 

আবুল কালাম আজাদ মজুমদার বলেন, কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, রাজধানী ঢাকা মহানগরীর জনসংখ্যা ও পরিসেবার ব্যাপ্তির কথা বিবেচনা করে নয়াদিল্লির মতো ফেডারেল সিটি নিয়ন্ত্রিত ‘ক্যাপিটাল সিটি গভর্নমেন্ট’ বা রাজধানী মহানগর সরকার গঠনের সুপারিশ করা হলো। অন্যান্য প্রদেশের মতো এখানেও নির্বাচিত আইনসভা ও স্থানীয় সরকার থাকবে। ঢাকা মহানগরী, টঙ্গী, কেরানীগঞ্জ, সাভার ও নারায়ণগঞ্জকে নিয়ে ‘ক্যাপিটাল সিটি গভর্নমেন্টের’ আয়তন নির্ধারণ করা যেতে পারে বলে সুপারিশে বলেছে কমিশন। তবে ঢাকা জেলা নারায়ণগঞ্জ জেলা অন্যান্য উপজেলা নিয়ে ভালো থাকবে। 

অপরদিকে, রাজধানী মহানগর সরকার গঠিত হলে টাঙ্গাইল জেলাকে ঢাকা বিভাগের সঙ্গে সংযুক্ত করা যেতে পারে।