মুদ্রানীতি ঘোষণা

অপরিবর্তিত আছে বেসরকারি ঋণ ও নীতি সুদহার

অর্থনৈতিক প্রতিবেদক প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১১, ২০২৫, ১২:১৭ এএম
অপরিবর্তিত আছে বেসরকারি ঋণ ও নীতি সুদহার
  • নীতি সুদহার ১০ শতাংশই থাকছে

  • সরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ১৭.৫০ শতাংশ

  • নতুন অর্থবছরে ৭-৮ শতাংশ নামানোর লক্ষ্য

বেসরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধি ও নীতি সুদহার অপরিবর্তিত রেখে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন, ২০২৫) মুদ্রানীতি (মনিটারি পলিসি স্টেটমেন্ট-এমপিএস) ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করেন। এটি অন্তর্বর্তী সরকারের এবং বর্তমান গভর্নরের প্রথম মুদ্রানীতি।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জনের মধ্যে ভারসাম্য রাখতে মুদ্রানীতি প্রণয়ন ও প্রকাশ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। দেশের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় মুদ্রানীতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ ঋণ, মুদ্রা সরবরাহ, অভ্যন্তরীণ সম্পদ, বৈদেশিক সম্পদ কতটুকু বাড়বে বা কমবে এর একটি পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বছরে দুইবার (জানুয়ারি-জুন ও জুলাই-ডিসেম্বর সময়ের জন্য) মুদ্রানীতি নীতি ঘোষণা করে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানায়, চলতি অর্থবছর শেষে মূল্যস্ফীতি ৭ থেকে ৮ শতাংশ নামানোর লক্ষ্য ঠিক করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যদিও এখন মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের কাছাকাছি।

নতুন মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি আগের মতো রাখা হয়েছে। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ৭.২৮ শতাংশ। আগামী জুন পর্যন্ত বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি ৯.৮ শতাংশ নেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে।

গত ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ১৮.১০ শতাংশ। নতুন মুদ্রানীতিতে সরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি ১৭.৫০ শতাংশ লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। যদিও গত ছয় মাসে লক্ষ্য ছিল ১৪.২ শতাংশ। অর্থ্যাৎ ব্যাংক খাত থেকে সরকারকে ঋণ নেওয়ার সুযোগ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন টাকা ছাপিয়ে (রিজার্ভ মানি) মুদ্রার সরবরাহ বাড়াবে না বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

গত জুনে রিজার্ভ মানির প্রবৃদ্ধি ছিল ৭.৯ শতাংশ। ডিসেম্বরে এ প্রবৃদ্ধি কমিয়ে ২ শতাংশ নামিয়ে আনার লক্ষ্য ঠিক করা হয়। নতুন মুদ্রানীতিতে আগামী জুন পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি কমিয়ে ১ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য ঠিক করেছে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা।

চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৯৭ হাজার টাকা। বিশাল অঙ্কের এ বাজেটের ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৫১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। আর অনুদান ছাড়া ঘাটতির পরিমাণ ২ লাখ ৬৬ হাজার কোটি টাকা। যা মোট জিডিপির ৪.৬ শতাংশ।

বাজেটের আয়-ব্যয়ের বিশাল ঘাটতি পূরণে প্রধান ভরসাস্থল হিসাবে ব্যাংক খাত বেছে নেওয়া হয়। ফলে বড় ঘাটতি পূরণে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ নেবে বলে লক্ষ্য ঠিক করেছিল বিগত সরকার।

এর আগে গত বছরের ২২ অক্টোবর দেশের মুদ্রানীতির অন্যতম টুল নীতি সুদহার (ব্যাংক রেট) ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ১০ শতাংশে উন্নীত করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ২৪ সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার ৯ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৯ দশমিক ৫ শতাংশ করে। গত ২৫ আগস্ট উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নীতি সুদহার ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৯ শতাংশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। পরে এটি ৯ দশমিক ৫ শতাংশ করা হয়। এর আগে ২০২২ সালের মে মাসে নীতি সুদহার ছিল ৫ শতাংশ। সেসময় থেকে এখন পর্যন্ত মোট ১০ বার বাড়ানো হয়েছে নীতি সুদহার।

দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ভোগাচ্ছে দীর্ঘদিন। নানান পদক্ষেপের সঙ্গে সুদহার বাড়িয়েও তা নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। এরই মধ্যে নীতি সুদহার (রেপো সুদ) আরেক দফা বাড়িয়ে চলতি (২০২৪-২৫) অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধ (জানুয়ারি-জুন) মুদ্রানীতিতে ঘোষণার কথা জানিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।

এতে উদ্যোক্তারা জানান, বর্তমান পরিস্থিতিতে সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি কমানো সম্ভব হবে না, বরং আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর প্রভাব পড়বে বিনিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্য ও কর্মসংস্থানে। অর্থনীতিবিদরাও এ নিয়ে পরামর্শ দেন। নীতি সুদহার বাড়িয়ে বিনিয়োগ চাইলে ব্যবসায়ীদের ওপর এর প্রভাব কিছুটা হলেও পড়বে বলে মত দেন তারা। এ পরিস্থিতির মধ্যে গত মাসে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে আসে। সার্বিক দিক বিবেচনায় এনে নীতি সুদহার অপরিবর্তিত রাখা হলো।

এদিকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বিনিময় হার স্থিতিশীল করা এবং রিজার্ভ বাড়ানোকে প্রধান চ্যালেঞ্জ বিবেচনায় গত বছরের ১৮ জুলাই চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধের মুদ্রানীতি ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। যা ছিল বিগত সরকারের শেষ মুদ্রানীতি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রেওয়াজ অনুযায়ী সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হতো। কিন্তু রেওয়াজ ভেঙে সে সময় নজিরবিহীনভাবে কোনো সংবাদ সম্মেলন না করে শুধু ওয়েবসাইটে মুদ্রানীতির ঘোষণাপত্র দেওয়া হয়। ব্যাংক খাতের বিভিন্ন অনিয়ম জালিয়াতির তথ্য আড়াল করতে তৎকালীন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সাংবাদিক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞার ধারাবাহিকতায় এমন পদক্ষেপ নেন।

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকারের পতনের পর ৯ আগস্ট অজ্ঞাত স্থান থেকে ই-মেইলে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে আত্মগোপনে আছেন সাবেক এ আমলা। নতুন সরকার গঠনের পর বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুরকে গভর্নরের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

নতুন গভর্নর দায়িত্ব নেওয়ার সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোর স্বল্পমেয়াদি ধারে ব্যবহূত রোপোর সুদহার ছিল ৮.৫০ শতাংশ। তিন দফায় ৫০ বেসিস পয়েন্ট করে তা বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। এতে করে গ্রাহক পর্যায়ে সুদহার বেড়ে এখন ১৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে। এরপরও মূল্যস্ফীতি না কমায় আরেক দফা নীতি সুদহার বাড়ানোর আলোচনা ছিল। তবে সর্বশেষ হিসাবে জানুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে। এ কারণে আপাতত নীতি সুদহার বাড়ানো হবে না। অবশ্য বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বিবেচনায় সুদহার না বাড়িয়ে বরং কমানোর দাবি জানিয়ে আসছেন উদ্যোক্তা ব্যবসায়ীরা। 

সংশ্লিষ্টরা জানান, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রথম ছয় মাসে অর্থনীতিতে বড় কোনো উন্নতি হয়নি; তবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ধারাবাহিক যে অবনতি হচ্ছিল, তা ঠেকানো গেছে। বিশেষ করে অর্থপাচারের বিরুদ্ধে কঠোর নীতির কারণে আগের মতো আর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে না। বরং দীর্ঘদিন ধরে তা ২০ বিলিয়ন ডলারে স্থিতিশীল আছে। গত বুধবার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২০.২০ বিলিয়ন ডলারে। বর্তমান সরকার দায়িত্বে আসার আগে গত জুলাই শেষে যা ২০.৩৯ বিলিয়ন ডলার ছিল; ৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে কমে যা ওই পর্যায়ে নেমেছিল।

গত ছয় মাসে বাংলাদেশ ৩৩০ কোটি ডলার আগের বকেয়া পরিশোধ করেছে। তারপরও রিজার্ভ একই জায়গায় থাকাকে আপাতত স্বস্তি বিবেচনা করা হচ্ছে। আবার ডলারের দর ১২২ থেকে ১২৪ টাকায় স্থিতিশীল আছে। এর মধ্যে স্বস্তির খবর নতুন বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি কমে ৯.৯৪ শতাংশে নেমেছে। আগের মাস শেষে যা ছিল ১০.৮৯ শতাংশ।

অনুষ্ঠানে ডেপুটি গভর্নর, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান, গবেষণা বিভাগের নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও অন্যান্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত নভেম্বরে বেসরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক ৬৬ শতাংশ, যা ২০২১ সালের মে মাসের (৭.৫৫ শতাংশ) পর সর্বনিম্ন। এ প্রবৃদ্ধি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক নিচে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ৯ দশমিক ৮ শতাংশ ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল, যা গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথমার্ধের প্রক্ষেপণের তুলনায় সামান্য কম।